ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

অবহেলিত সন্দ্বীপের মানুষের হালহকিকত

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৭:৩৮ পিএম, ১০ নভেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার

নভেল করোনাভাইরাস শুরুর পর থেকে ঘরের বাহিরই হইনি। গ্রামে যাওয়া তো দূরের কথা। সর্বশেষ গিয়েছিলাম গেল বছর অক্টোবরে। তবে সেখানে অবস্থানরত আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হালনাগাদ থাকতে চেষ্টা করি সবসময়ই। করোনা ছাড়াও আমার গ্রামের বাড়ি দুর্গম এলাকায়। বিমান বা গাড়িতে চট্টগ্রাম, সেখান থেকে গাড়িতে কুমিরা, সেখান থেকে যাত্রীবাহী স্পিড বা সাধারণ বোটে সন্দ্বীপ ঘাট। সেখান থেকে বেবিট্যাক্সিতে বা রিকশায় বাড়ি। দ্রুততম পরিবহন নিলেও ঢাকা থেকে সকালে রওনা দিলে বাড়ি পৌঁছতে সন্ধ্যা নামে। সাধারণ যাত্রীদের জন্য একাধিক দিনও লাগতে পারে। একুশ শতকে রাজধানী ঢাকা থেকে আমাদের ভৌগোলিকভাবে ছোট এ দেশের একটা গ্রামে যেতে এতটা সময় লাগে ভাবাই যায় না!

যাত্রার বিড়ম্বনা 

সন্দ্বীপ যেতে হলে কেবল পিতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা থাকলে চলবে না। প্রয়োজন আর্থিক সংগতি ও শারীরিক সামর্থ্য। মূল সমস্যা হলো কুমিরা থেকে সন্দ্বীপ যাওয়া। স্পিডবোটে যাত্রার সময় মাত্র ৪৫ মিনিট হলেও দুই ঘাটে অপেক্ষা, স্পিডবোটে আরোহণ ও অবরোহণ করতে দুদিকে আবহাওয়া, নদীর জোয়ার-ভাটা বুঝে ৪-৫ ঘণ্টা এমনকি একাধিক দিনও লেগে যেতে পারে। আবহাওয়া খারাপ হলে বা নদী সামান্য উত্তাল হলেই স্পিডবোট আর চলে না। সুদিনে যেতে হলে আপনাকে জোয়ার-ভাটার হিসাব করে যাত্রার সময় নির্ধারণ করতে হবে। জোয়ার হলে স্পিডবোট খালের ভেতরে আসবে এবং মোটামুটি সহজেই বোটে ওঠা যায়। আর তা না হলে কাদা পেরিয়ে অন্য নৌকায় উঠে সেখান থেকে স্পিডবোটে আরোহণ। এখানেই কেবল কাদার ওপর মানুষের ঠেলা নৌকা চলে! বিপত্তির এখানেই শেষ নয়। সন্দ্বীপ পাড়ে গিয়ে একই অবস্থা। সব শেষে কেওড়া কাঠের সাঁকো পার হয়ে মূল ঘাটে ওঠা। সাঁকোটি পুলসিরাতের কথা মনে করিয়ে দেয়। ভারসাম্য হারালেই কাদাপানিতে একাকার। আর হাতে কিছু থাকলে তাও সর্বনাশ হয়ে যাবে। অসুস্থ, বয়োবৃদ্ধ বা নারী হলে সঙ্গী ছাড়া যাতায়াত করা অসম্ভব। 

অথচ সারা দেশ যখন অবহেলিত ছিল, সেই পাকিস্তান আমলেও, এমনকি এক দশক আগেও সন্দ্বীপে যাতায়াত ছিল প্রীতিকর অভিজ্ঞতা। চট্টগ্রামে সদরঘাট থেকে বড় স্টিমারে সন্দ্বীপ। সেখান থেকে মাথার ওপর গাংচিল আর নদীতে জলের খেলা দেখতে দেখতে দুপুর নাগাদ বাড়ি। ভাবা যায়, ষাটের দশকে জনপ্রতি ১৬ টাকা ভাড়ায় ১৫ মিনিটে হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপ যাতায়াত করেছি! মানতেই হবে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হলেও সন্দ্বীপের ক্ষেত্রে বরং অবনতি হয়েছে। 

তবে কি উন্নয়ন হয়নি

সন্দ্বীপে উন্নয়ন হয়নি এমন নয়। সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। তবে এর পুরো সুফল ভোগ করতে পারছে না সন্দ্বীপবাসীরা, বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধিদের কথিত দুর্নীতির কারণে। রাস্তাঘাটও পাকা হয়েছে। কিন্তু নিচু মানের নির্মাণকাজের কারণে কিছুদিন পরই আবার তা ভেঙে যাচ্ছে। বিপুল অর্থ ব্যয়ে সন্দ্বীপ ঘাটে দুই দুটি জেটি নির্মাণ করা হলেও সাধারণ মানুষ এর সুফল পাচ্ছে না। কারণ এগুলোয় কোনো নৌযানই ভিড়তে পারে না। সরকারের সদিচ্ছা ও বিপুল অর্থ ব্যয়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় ভুল পরিকল্পনা ও দুর্নীতির কারণে জনকল্যাণের সার্বিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না।

গ্রামীণ সমাজের বিবর্তন

সারা দিন যাতায়াত করে ক্লান্তিতে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে সেদিন আর কিছু করার থাকে না। ভোরে উঠেই প্রাতঃভ্রমণে বের হই। বের হতেই দেখি, চায়ের দোকানের ভেতরে ভিড়। আর বাইরে লাইন। কিসের ভিড়, ভ্রমণসঙ্গীকে জিজ্ঞেস করি? ভেতরে সবাই সকালের নাশতা করছে, নান-রুটি, ডাল অথবা ভাজি আর চা দিয়ে। বাইরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা লাইনে দাঁড়িয়ে একই নাশতা কেনার জন্য। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, কেন বাড়িতে আবহমান কালের পিঠাপুলির কী হলো? মামাতো ভাই বলল, আপনি আসায় আমাদের বাড়িতে আজ পিঠা তৈরি হবে। কিন্তু আমাদের বাড়িতেও এখন আর সকালে নিয়মিত নাশতা তৈরি হয় না। আমরাও সকালে দোকান থেকে নাশতা কিনে খাই। হাঁটতে থাকি। ভোরের কুয়াশা আর সেই চিরচেনা গ্রাম। কিছু পরিবর্তন লক্ষ করি। রাস্তা পাকা হয়েছে। তাও মাঝেমধ্যে ভাঙা। বিদ্যুতের খুঁটি বসেছে কোথাও কোথাও। আর হয়েছে নতুন নতুন মার্কেট। দোকানের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। প্রায় সব বাড়িরই ১০০-২০০ মিটারের মধ্যেই দোকানপাট। আরেকটা জিনিস লক্ষ করি, পাকা বাড়ির সংখ্যা বেড়েছে অনেক। বেড়েছে টাইলসের ব্যবহার। বাসাবাড়ি, দেয়াল, মসজিদ সর্বত্র টাইলসের ছড়াছড়ি। প্রায় সব বাড়ির চাল বা ছাদেই সৌরবিদ্যুতের প্যানেল। চট্টগ্রাম ফেরার পথে দেখলাম বিত্তশালী ও সমাজমনস্ক ব্যক্তিদের উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে বেসরকারি স্কুল ও হাসপাতাল।  

রাস্তার দু’পাশে বাড়িঘর ছাড়া আর কিছু নেই। মাঠঘাট খালি। দেশের অন্যত্র কদাচিৎ খালি জমি চোখে পড়ে। ধান, পাট, রবিশস্য, শাকসবজি একটা না একটা পালাক্রমে চাষ হচ্ছে। কিন্তু এখানে অবস্থা ভিন্ন। চাষবাস খুবই কম। বেশির ভাগ জমিই খালি পড়ে আছে। এটা কেবল সন্দ্বীপের নয়, জাতীয় অপচয়। 

পরিবর্তনগুলো এসেছে প্রধানত রেমিট্যান্সের কারণে। সন্দ্বীপের মানুষ নিউইয়র্ক, লন্ডন, মধ্যপ্রাচ্য বা মালয়েশিয়া কোথায় নেই। নিউইয়র্কে সন্দ্বীপের গ্রামভিত্তিক সমিতি আছে, যেমন মুছাপুর, মাইটভাঙ্গা সমিতি! তাই বড় বড় মার্কেটে ব্যাংকের শাখা—রেমিট্যান্স তোলো আর খাও। বাড়িগুলোও বিরান হয়ে পড়ে আছে। কোনো কোনো বাড়িতে ১০-১২টি ঘর। বেশির ভাগ ঘরই তালাবন্ধ। বাসিন্দারা হয় বিদেশে অথবা সপরিবারে চট্টগ্রামে। 

রাজনীতি ও যুবসমাজ 

দেশের অন্যান্য জায়গার মতোই সন্দ্বীপের রাজনীতি মাস্তান নির্ভর। বিরোধী দল তো দূরের কথা, সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান বিরোধীদেরও সন্দ্বীপে জায়গা নেই। বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত সন্দ্বীপের এর আগের সংসদ সদস্য নিরাপত্তার অভাবজনিত কারণে সন্দ্বীপে নিজ বাড়িতেও অবস্থান করতে পারেননি। 

যুবসমাজের একাংশ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। আরেকটি বড় অংশ মাদকাসক্ত। মাদক বিশেষত ইয়াবা সহজেই পাওয়া যায়। মার্কেটগুলোতেই ছোট ছোট দোকানে এসব পাওয়া যায় বলে অভিযোগ আছে। আবার কেউ কেউ আছে যারা সন্ত্রাস, মাদক সেবন, কেনা-বেচা সবকিছুর সঙ্গেই জড়িত। সড়কপথে নজরদারি এড়াতে কক্সবাজার থেকে নদীপথে মাদক সন্দ্বীপ হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে সন্দ্বীপ মাদক চোরাচালানের একটি রুট হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ আছে। নভেল করোনাভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কম হলেও মাদকের মহামারী থেকে সন্দ্বীপের মানুষের নিস্তার নেই। 

আশা-নিরাশার দোলাচল

সাম্প্রতিক সময়ে সন্দ্বীপের জন্য সবচেয়ে বড় সুসংবাদ হলো, দ্বীপের পশ্চিম পাশে চর জেগেছে, যার আয়তন প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার, যার পরিমাণ সন্দ্বীপের বর্তমান আয়তনের প্রায় সমান। আরো আগেই মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জেগেছে ভাসানচর, যার আয়তন ২৫ বর্গকিলোমিটার। সন্দ্বীপ থেকে ভাসানচরের দূরত্ব মাত্র প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। যাতায়াত সময় ১ ঘণ্টারও কম। জায়গাটি ছিল মূলত নদীতে ভেঙে যাওয়া সন্দ্বীপের ন্যায়মস্তি ইউনিয়নের অংশ। গত ৭০-৮০ বছরে নদীভাঙনে বাস্তুচ্যুত হয়েছে হাজার হাজার পরিবার। সন্দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে তারা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই পরিবার দু-তিনবার নদীভাঙনের শিকার হয়েছে। সন্দ্বীপবাসীদের আশা ছিল তাদের ভেঙে যাওয়া ভূমিতে জেগে ওঠা ভাসান চরে তাদের পুনর্বাসন করা হবে। সন্দ্বীপবাসীকে হতাশ করে ভাসান চরকে নোয়াখালীর হাতিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের তোড়জোড় চলছে। সন্দ্বীপের মানুষ সরকারের এ অযৌক্তিক সিদ্ধান্তে হতাশ ও বিক্ষুব্ধ। তাদের দাবি, ভাসান চরকে সন্দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত করে সেখানে ন্যায়মস্তি ইউনিয়নের নদী সিকস্তি পরিবারদের পুনর্বাসন করা হোক।     

সর্বশেষ পরিস্থিতি

আগেই বলেছি, করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুহার বিবেচনায় সন্দ্বীপের পরিস্থিতি অনেকটা ভালো। কিন্তু করোনার আর্থিক প্রভাব এখানে ব্যাপক। বিদেশে কর্মরতদের অনেকেই দেশে ফিরে এসেছেন। ভিসা, ফ্লাইট ও বিমানভাড়া না থাকায় আটকে পড়ে আছেন। আবার কারো কারো বিদেশে চাকরি চলে গেছে। রেমিট্যান্সনির্ভর পরিবারগুলোর অনেকেরই ভীষণ দুরবস্থা। এটা কখন কাটবে, আদৌ কাটবে কিনা, কেউ তা জানে না। শুধু বিদেশ থেকেই নয়, চট্টগ্রাম ও দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে চাকরি হারিয়ে, ব্যবসায় লোকসান করে সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছে কেউ কেউ। 

করণীয় কী

সবচেয়ে আশু ও প্রয়োজনীয় কাজ হবে সারা বছর চলাচলের উপযোগী একটা যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে মানুষ ডাঙ্গা থেকে পরিবহনে উঠে আবার ডাঙ্গায় নামতে পারে। এজন্য সব ঋতুতে ও আবহাওয়ায় চলাচল করতে পারে এমন স্টিমার সার্ভিস, যা আগে ছিল, চালু করতে হবে। 

নদীভাঙা পরিবারগুলোকে নতুন জেগে ওঠা চরে পুনর্বাসন করতে হবে। খালি পড়ে থাকা জমি আবাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদেশফেরত প্রবাসী শ্রমিকদের তাদের কর্মস্থলে ফেরার সহায়তা হিসেবে টিকিট কেনার জন্য বিনা সুদে ঋণ সহায়তা দিতে হবে। এ অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে বহুগুণে ফিরে আসবে। সন্ত্রাস ও মাদকের হাত থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করতে হবে। সহনশীল রাজনৈতিক ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতায়। 

ধারণা করা হচ্ছে সন্দ্বীপের আশেপাশে জেগে ওঠা চরগুলো একসময় একত্র হয়ে যাবে। তাই মধ্যমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে এখন থেকেই মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযোগ ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সময় থেকে আলোচিত মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য ক্রসড্যাম নির্মাণ করতে হবে। তবেই কেবল সন্দ্বীপে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চল ফলপ্রসূ হবে। এ ব্যাপারে প্রকল্প অনুমোদিত থাকলেও প্রভাবশালী জাতীয় নেতাদের বিরোধিতা ও সন্দ্বীপের দুর্বল রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে তা অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন করা হয়নি। 

সমস্যা-জর্জরিত দ্বীপ সন্দ্বীপ। এর সব সমস্যার সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয়। কিন্তু অগ্রাধিকার স্থির করে কাজটা শুরু করতে হবে এখনই। 

লেখক-মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ।