ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

মিরসরাইয়ের অদম্য জয়িতাদের গল্প

মিরসরাই সংবাদদাতা

প্রকাশিত : ০৬:৪৭ পিএম, ১২ নভেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার

উপরে বাঁ থেকে নিচে- খালেদা বেগম, শিউলি রানী পাল, হালিমা বেগম, জয়নব ফেরদৌস আরা ও জাহানারা বেগম।

উপরে বাঁ থেকে নিচে- খালেদা বেগম, শিউলি রানী পাল, হালিমা বেগম, জয়নব ফেরদৌস আরা ও জাহানারা বেগম।

সিনেমার অভিনয় কিংবা বইয়ের পাতায় লেখা গল্প নয়। বাস্তব জীবনে রুপকথার মতো পাঁচ সংগ্রামী সফল নারী নির্বাচিত করে শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মানে ভূষিত করেছে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। 

সংসারে সফল জননী, সমাজ উন্নয়নে নারী, অর্থনৈতিক সফলতায় নারী, শিক্ষা চাকুরীতে নারীর সাফল্য, পারিবারিক নির্যাতনে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় নারী। এই পাঁচ অধ্যায়ে বৈরী সমাজ ব্যবস্থায় অনবরত সংগ্রাম করে পদে পদে প্রতিকূলতাকে জয় করেছেন তাঁরা। জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়া এই পাঁচ সফল নারী আজ মিরসরাই উপজেলার নারী সমাজে এগিয়ে যাওয়ার বাস্তব প্রতিচ্ছবি। 

উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মেহের আফরোজ জানান, যেসব নারী সমাজের সকল প্রতিকূলতাকে জয় করে জীবনে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদেরকে উৎসাহ যোগাতে জয়িতা সম্মানে ভূষিত করা হয়। 

শ্রেষ্ঠ জয়িতা-২০১৯ এ ভূষিত মিরসরাইয়ের পাঁচ নারী হলেন- সফল জননী খালেদা পারভীন, শিক্ষা ও চাকুরিতে সাফল্য অর্জনে জয়নব ফেরদৌস আরা চৌধুরী, অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনে হালিমা বেগম, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন উদ্যমে বদলে যাওয়া নারী শিউলি রানী পাল ও সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখা জাহানারা বেগম।

সফল জননী নারী:
খালেদা পারভীন সংসার জীবন শুরু করেন ১৯৯০ সালে। স্বামীর আর্থিক অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না। বিয়ের আট-নয় বছর সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন তাঁর স্বামী। এসময় অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে পরিবারের আর্থিক অবস্থা। তিন মেয়ে আর অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়তে হয় তাঁকে। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রবল ইচ্ছা শক্তি তাঁকে এনে দিয়েছে সফলতা। 

খালেদা পারভীনের বড় ও তৃতীয় মেয়ে এমবিবিএস ডাক্তার। দ্বিতীয় মেয়ে বর্তমানে স্বাস্থ্য ক্যাডারে বিসিএস সম্পন্ন করেছে। আর ছোট মেয়ে চট্টগ্রাম সিটি কলেজে ম্যাথম্যাটিকসে অনার্স অধ্যায়নরত। 
খালেদা পারভীনের বাড়ি মিরসরাই পৌরসভার পূর্ব পোলমোগরা গ্রামে। তিনি মনে করেন- আর্থিক অনটনের মধ্যেও তিনি তাঁর মেয়েদের সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছন শুধুমাত্র প্রবল ইচ্ছা শক্তি আর সাহস দিয়ে। এর জন্য তিনি আজ সমাজে খুবই সম্মানিত।

সমাজ উন্নয়নে অবদান: 
কিশোরী বয়স থেকে সমাজসেবা করাই শখ জাহানারা বেগমের। ১৯৮০ সালে তাঁর বিয়ে হয় নিজ গ্রামে। বিয়ের পরও সমাজসেবাকে সবসময় গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। এ সুবাদে ১৯৮৩ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে স্থানীয় মায়ানী ইউনিয়নের সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। 

এলাকাবাসীর কাছে জাহানারা বেগম জানু আপা হিসেবে পরিচিত ও সর্বস্তরে তিনি জনপ্রিয়। এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয়তার দরুণ পরপর ৬ বার তিনি ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। অদ্যবধি তিনি মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি দীর্ঘ ৩৮ বছর দায়িত্ব পালন করছেন। 

এখানেই শেষ নয়, জাহানারা বেগম ১৯৯৭ সালে আনসার ভিডিপির ইউনিয়ন দলনেত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি পিটি প্যারেড ও রাইফেল ট্রেনিং নেন। এলাকার বাল্য বিয়ে, যৌতুক প্রতিরোধেও ভূমিকা রেখে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের সুনাম কুড়িয়েছেন। 

মিরসরাই উপজেলার মায়ানী ইউনিয়নের সৈদালী গ্রামের মেয়ে জাহানারা বেগম বলেন, ‘যতদিন বেঁচে থাকবো সমাজসেবা ও স্বেচ্ছাসেবী কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখবো।’ 

অর্থনৈতিক সফলতা:
বিয়ের ১১ বছর সময়ে ১৯৯৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারান হালিমা বেগম। সংসারে তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে অভাব সঙ্গী হয় তাঁর। জীবনে নেমে আসে দুঃসহ যন্ত্রনা। তবুও থেমে থাকেননি তিনি। ঘরে বসে বেত ও বাঁশের কাজ করে সংসারের হাল ধরার প্রাণন্ত চেষ্টা। তবুও দু’বেলা খাবার জোটেনা। এরপর সেলাইয়ের কাজ শিখে গ্রামের বিভিন্ন পরিবার ও দোকানপাটে জামা কাপড় সাপ্লাই করে সাবলম্বী হতে শুরু করেন। 

এরই মধ্যে ২০০০ সাল নাগাদ স্থানীয় একটি সড়ক দুর্ঘটনায় হালিমার ছোট মেয়ে মারা যায়। শোক যেন কিছুতেই পিছু ছাড়তে চাইছিলো না তাঁকে। তবুও থেমে থাকেননি তিনি। বাকি তিন সন্তানকে নিয়ে সামনের দিকে এগুতে থাকেন। প্রথমে বড় দুই মেয়েকে এসএসসি পাশ করিয়ে বিয়ে দেন। একমাত্র ছেলে বর্তমানে দর্শন শাস্ত্রে মাস্টার্স ডিগ্রীতে অধ্যায়ন করছেন। 

বর্তমানে হালিমা নিজের কাজের পাশাপাশি গ্রামের অন্য অসহায় নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে সাবলম্বী করে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁর বাড়ি মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিন সোনাপাহাড় গ্রামে।

শিক্ষা-চাকুরীতে সাফল্য:
বেকার বাবার ঘরে জন্ম জয়নব ফেরদৌস আরা চৌধুরীর। সংসারে আয়ের কোনও উৎস ছিল না। ভাই বোন সকলের পড়াশুনার খরচ জোগাড় ছিল অসম্ভব। তবুও তিনি আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় কোনওমতে অষ্টম শ্রেণি পাশ করে শুরু করেন প্রাইভেট টিউশনি। পাশাপাশি তার আর এক বোন তাঁর সঙ্গে প্রাইভেট পড়াতেন। এভাবে অনেক কষ্টে এসএসসি পাশ করে ২০০৩ সালে স্থানীয় একটি কমিউনিটি স্কুলে সহকারী শিক্ষকের চাকুরী নেন জয়নব। এরপর সংসারের অভাব কিছুটা দূর হয়। 
চাকুরীর পাশাপাশি নিজের পড়াশুনাও চালিয়ে যান জয়নব। ২০১২ সালে তিনি এইচএসসি পাশ করেন। নিজের আয়ে তিনি ভাই-বোনদের পড়াশুনার খরচ চালান। তাঁর ছোট ভাই বর্তমানে খুলনা মেডিকেলে এমবিবিএস পড়াশুনা করছেন। 

জয়নব ফেরদৌস আরা চৌধুরী বিশ্বাস করেন- অদম্য ইচ্ছা শক্তির কারণেই তিনি আজ প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। নিজের ভাই-বোনদের আর্থিকভাব স্বাবলম্বী করতে পেরেছেন। তাঁর বাড়ি মিরসরাই উপজেলার ওচমানপুর ইউনিয়নের পশ্চিম সাহেবপুর গ্রামে।

নির্যাতন থামাতে পারেনি তাঁকে:
শিউলি রানী পাল। বাংলার এক নির্যাতিত সফল নারীর প্রতিচ্ছবি। তাঁর বাড়ি মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের গোপীনাথপুর গ্রামে। বিয়ের অল্প সময়ে অকাল মৃত্যু হয় স্বামীর। তখন তার সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান। আর্থিক অনটনে অনেকটাই বিপর্যস্থ হয়ে পড়ে জীবন। তাঁকে এবং তাঁর সন্তানদের ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়। এমন বিপদের দিনে সমাজের কেউই এগিয়ে আসেনি অসহায় নির্যাতিত শিউলি রানীর সাহায্যে। 

পরে তাঁর ঠাঁই হয় একটি ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘরে। নিজের সন্তানদের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দেবার উপায়ন্ত না পেয়ে কাজ করেন আশপাশের বাসা বাড়িতে। পাশাপাশি তিনি সেলাইয়ের কাজ শেখেন। পরে নিজের ভাইয়ের টাকায় একটি সেলাই মেশিন কিনে কাপড় সেলাই করেন। বর্তমানে তিনি আর্থিকভাবে সচ্ছল। তাঁর বড় মেয়ে গত বছর জেএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। ছোট ছেলে পড়ছে চতুর্থ শ্রেণিতে। 

শিউলি রানী পালের মতে, বর্তমান সমাজে সেলাইয়ের কাজ শিখে যে কোনও অসহায় নারী আমার মতন স্বাবলম্বী হতে পারে।

এনএস/