ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

গাম্বিয়ার আইনী লড়াইয়ে ওআইসি’র আর্থিক সহায়তা চায় ঢাকা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:০৬ পিএম, ২৪ নভেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার

বাংলাদেশ রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে)-তে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইনী লড়াইয়ে গাম্বিয়াকে সহায়তার জন্য তহবিল সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিয়েছে। চলতি সপ্তাহে নাইজারে ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এক বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। মোমেন ২৭-২৮ নভেম্বর নাইজারে ৫৭ সদস্য বিশিষ্ট ওআইসি’র কাউন্সিল অব ফরেন মিনিস্টার্স (সিএফএম) এর ৪৭তম অধিবেশনে যোগ দিবেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন তার আসন্ন নাইজার সফর সম্পর্কে বলেন, গাম্বিয়ার এই লড়াইয়ে ঢাকা দেশটিকে আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দেয়ার পাশাপাশি অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন (ওআইসি)’র সদস্য দেশগুলোকেও পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিকে আর্থিক সহায়তা দেয়ার আহ্বান জানাবে। মোমেন বলেন, ‘আমরা গাম্বিয়াকে আইসিজে-তে এই আইনী লড়াই চালাতে আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য ওআইসি’র কাছে অর্থ দেব। এই মামলায় আইনজীবী নিয়োগ করায় তাদের এই সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে।’ 

তিনি বলেন, ওআইসি’র সদস্য এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে স্বপ্রণদিত হয়ে আইসিজে-তে এই মামলা দায়েরকারী গাম্বিয়ার এই আইনী লড়াই চালাতে আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন। এ ব্যাপারে ‘ঢাকা জোরালো আহ্বান জানাবে।’

বাংলাদেশের এই আর্থিক সহায়তার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত কর্মকর্তারা বলেন, ঢাকা এখন এই মামলায় গাম্বিয়ার সহায়তায় ওআইসি-কে একটি তহবিল দিয়েছে। কিন্তু তারা তহবিলের পরিমাণ সম্পর্কে জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছেন, সিএফএম-এর অধিবেশনই তহবিলের পরিমাণটি জানানোর উপযুক্ত স্থান।

সিএফএম-এর এই বৈঠকের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘শান্তি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঐক্য’। ওআইসি মহাসচিব নাইজারের রাজধানী নিয়ামেই-তে এই আয়োজনের সভাপতিত্ব করবেন। রোহিঙ্গা সংকট ও সিএমএফ-এ মামলার এজেন্ডাটিই অধিবেশনে সর্বাধিক প্রাধান্য পাবে এবং অধিবেশনে বাংলাদেশ থেকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে চাপ দেয়া হবে বলে মোমেন আশা করছেন।

রোহিঙ্গাদের হত্যাযজ্ঞের ঘটনার ‘জবাবদিহিতা ও ন্যায় বিচার’ নিশ্চিতে মিয়ানমারের উপর চাপ দেয়া হবে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, ‘ওআইসি রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে গুরুত্বের সাথে দেখছে। জাতিসংঘে এই ইস্যুতে ওআইসির সকল সদস্য জোরালোভাবে আমাদের সমর্থন করছে। এই সংকটটিতে ওআইসি লক্ষ্যণীয়ভাবেই সাড়া দিয়েছে।’

বাংলাদেশ নিজভূমি থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যূত ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিচ্ছে। এদের অধিকাংশই ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কঠোর দমনপীড়ন শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে প্রতিবেশী দেশটিতে আশ্রয় নিয়েছে। ওআইসি মহাসচিব ড. ইউসেফ আল-ওসমানী এর আগে এক বিবৃতিতে বলেন, বিদ্যমান যে সমস্যাগুলো নিয়ে মুসলিম দেশগুলো উদ্বিগ্ন সেগুলোর মধ্যে ফিলিস্তিন সমস্যা, সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াই, চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ, ইসলামভীতি ও ধর্ম অবমাননা অন্তর্ভূক্ত।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কিভাবে আইসিজে’র রোহিঙ্গা সংক্রান্ত এই মামলার তহবিল সংগ্রহ করা হবে সে বিষয়েও সেখানে আলোচনা হবে।

গত বছরের নভেম্বর মাসে, গাম্বিয়া আইসিজে-তে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এই মামলাটি দায়ের করে। ওআইসি, কানাডা ও নেদারল্যান্ডস গাম্বিয়াকে সমর্থন দেয়। ১০-১২ ডিসেম্বর আসিজে-তে মামলাটির প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ডিসেম্বরের শুনানিতে গাম্বিয়া মামলার আর্জিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সালের গণহত্যা সনদের আলোকে অভিযোগ এনে বলে, ভয়াবহ সামরিক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ‘মিয়ানমার তাদের নিজ দেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দমনপীড়ন চালিয়েছে।’

গত ২৩ জানুয়ারিতে আইসিজে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নতুন করে গণহত্যার মতো ঘটনা ঠেকাতে প্রয়োজনীয় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয়।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে, এই মামলার চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত গাম্বিয়াকে অব্যহতভাবে সমর্থন প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ওআইসি’র প্রতি আহ্বান জানায়। পাশাপাশি বাংলাদেশ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমিতে তাদের সম্মানজনক, নিরাপদে ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে ওআইসি’র সহায়তা চায়।

ওআইসি’র জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ৪৭তম সিএমএফ-এর প্রস্তুতিমূলক বৈঠকে এই প্রস্তাব উত্থাপন করে। জেদ্দায় ওআইসি’র জেনারেল সেক্রেটারিয়েটে অনুষ্ঠিত বৈঠকটিতে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বাংলাদেশী প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। বৈঠকে ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের প্রস্তাবে সম্মত হয়।

এর আগে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বিভিন্ন বৈশ্বিক বহুপক্ষীয় প্লাটফর্মে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের আন্তর্জাতিক বিচার ও জবাবদিহিতার জন্য ‘ফ্রেন্ডস অব জাম্বিয়া গ্রুপ’ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। কানাডা ও নেদারল্যান্ডস ইতোমধ্যেই গ্রুপটিতে যোগ দিয়েছে এবং আইসিজে’র এই মামলায় গাম্বিয়াকে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এদিকে কোভিড ও ভ্যাকসিন প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তিনি সিএমএফ এ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মতো একটি ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশে করোনা ভাইরাস মোকাবেলা ও মহামারিটির বিস্তার ঠেকাতে ঢাকার অসামান্য সাফল্য তুলে ধরবেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন ধনী-দরিদ্র সকলের মাঝে সমানভাবে বন্টন করবে। ‘এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। ভ্যাকসিনটি বিতরণ ও বন্টনের ক্ষেত্রে কোন বৈষম্য করা হবে না। প্রতিটি করোনা আক্রান্ত রোগীকে এই ভ্যাকসিন দেয়া হবে। আমরা এই নীতিতে বিশ্বাস করি যে কোভিডমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কেউই করোনা থেকে নিরাপদ নয়।’

অভিবাসী শ্রমিক প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সিএফএম এ অভিবাসী কর্মীদের অধিকার বাংলাদেশের জন্য আরেকটি এজেন্ডা। তিনি বলেন, ‘এই মহামারিকালে আমাদের দেশের নাগরিকদের সহায়তা দেয়ার জন্য ওই দেশগুলোর প্রতি আমরা ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাব। সৌদি আরব ইতোমধ্যেই ৮৬ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিককে ফেরত নিয়েছে। এদের মধ্যে লকডাউনের পর ৩৪ হাজার নতুন কর্মী।’ দেশটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ড. মোমেন বলেন, ‘এটা সহজ কাজ নয়।’

দ্বিপক্ষীয় বৈঠক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সিএফএম এর ফাঁকে সৌদি আরব, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে তিনি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসবেন। এছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথেও তিনি পৃথক বৈঠকে বসতে পারেন বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।

এই সফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরসঙ্গীরা হলেন- পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত ড. মোহাম্মদ জাভেদ পাটোয়ারি এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর জেনারেল অব ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (আইও) ওয়াহিদা আহমেদ। ড. মোহাম্মদ জাভেদ পাটোয়ারি ওআইসি-তে বাংলাদেশী স্থায়ী প্রতিনিধি।

ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা দুই দিনব্যাপী এই অধিবেশনে রাজনৈতিক, মানবিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক-সংস্কৃতিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত অন্যান্য ইস্যু, গণমাধ্যম এবং ওআইসি’র ২০২৫ কর্মপরিকল্পনা নিয়েও আলোচনা করবেন। এছাড়াও অমুসলিম দেশগুলোতে মুসলিম সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতির বিষয়টিও আলোচনায় স্থান পেতে পারে।- বাসস

এসি