ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

‘চড়ুইভাতি’র সেকাল-একাল

আ নো য়া র  কা জ ল 

প্রকাশিত : ০৩:৫৮ পিএম, ২৫ নভেম্বর ২০২০ বুধবার | আপডেট: ০৪:০১ পিএম, ২৫ নভেম্বর ২০২০ বুধবার

‘চড়ুইভাতি’। আমরা অনেকেই এই নামটির সঙ্গে পরিচিত। আবার কেউ কেউ আছেন যারা এ শব্দটি সম্পর্কে জনেনই না। বন বাদাড়ে চড়ুই পাখিদের কিচিরমিচির ডাকের ছন্দে সংগৃহীত খাবার একসঙ্গে খাওয়া থেকে হয়তো চড়ুইভাতি শব্দের উৎপত্তি। শিশুদের সংগ্রহ করা চাল ডালে রাঁধা খাবার খাওয়াই হচ্ছে চড়ুইভাতি।

পৌষ মাসে একদল কিশোর-তরুণ বাড়ি থেকে চাল-ডাল ডিম হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে কোন খোলা জায়গায় অথবা গাছের নিচে বসে রান্না করে খাওয়ার প্রচলন ছিল। যা দেশের অঞ্চল, এলাকাভেদে পুষ্ণা, পুষলা, পুষলি, পুষালি বা পুষরা নামে পরিচিত। এই শব্দগুলোও নতুন প্রজন্মের কাছে অচেনা।

কোথাও কোথাও একে টোপাপাতি, ভুলকাভাতও বলা হয়ে থাকে। কালের কড়ালচক্রে সেই চুড়ুইভাতি বা টোপাপাতি থেকে বনভোজন বা পিকনিকের প্রচলন এসেছে। কালে কালে বনভূমিতে গিয়ে প্রীতি সম্মিলনে প্রীতি উৎসবের সঙ্গে চুলা জ্বালিয়ে রান্নাবান্না করে প্রীতিভোজন। ভোজনের পর বিচিত্রানুষ্ঠান। প্রীতিপ্রদ উৎসবের নাম এভাবেই হয়ে যায় বনভোজন।

শাব্দিক অর্থ বিশ্লেষণ ও রূপান্তর
পিকনিক একটি ফ্রেঞ্চ শব্দ। এর অর্থ প্রকৃতির কোলে বসে খাওয়া-দাওয়া আর হৈ হুল্লোড় করা। খাওয়া-দাওয়া বলতে রোজকার সাধারণ খাবারের পরিবর্তে একটু অন্য ধরনের খাওয়ার কথাই এখানে বিবেচ্য। নদী তীর, পার্ক, গ্রামের প্রান্তে একটুকরো ময়দান অথবা সবুজে ঘেরা বনভূমিই চড়ুইভাতি অথবা বনভোজনের আদর্শ জায়গা। বিগত কয়েক দশক ধরে আমরা বাঙালিরা পিকনিক বলতে বুঝি একটা শীতকালীন গেটটুগেদার। আত্মীয়-স্বজনের পিকনিক, পড়ার ব্যাচের পিকনিক, বন্ধুদের পিকনিক। আমাদের ছেলেবেলার সেই চড়ুইভাতির এখন কতোই না রকমফের!

পিকনিক প্রথার বিবর্তন 
পিকনিক প্রথার শুরু ১৬৯২ সালের দিকে। সেকালে কয়েকজন মিলে শীতকালে কোন সরাইখানায় গিয়ে খানাপিনা, পরে যুক্ত হলো আড্ডা। এই পিকনিক ছিল শুধু রাজকীয় আয়োজনে। পরে সাধারণ মানুষ বিকল্প আয়োজন শুরু করল। এককালে রাজা-বাদশার ছেলেপুলে সৈন্যসামন্ত নিয়ে বনে-জঙ্গলে ভোজনের আয়োজন করতেন। বনভোজনের রেওয়াজ শুরু তখন থেকেই। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে রূপ বৈচিত্র্য। এখন বনভোজন হয় করপোরেট আদলে। বছরের শুরুতেই বিভিন্ন স্কুল-কলেজে, অফিসে রীতিমতো হুড়োহুড়ি লেগে যায় বনভোজন আয়োজনে। এ সময় পিকনিক স্পট, ক্যাটারিং কোম্পানি, যাতায়াত ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হয় অনেককেই।

পিকনিকের আতুঁড়ঘর
পিকনিকের আঁতুড়ঘরের ফরাসী বিপ্লবের রাজপুরুষরা ফ্রান্স ছেড়ে পালিয়ে অস্ট্রিয়া, প্রুশিয়া, আমেরিকায় জড়ো হয়। বেশিরভাগ পাড়ি দেয় ইংল্যান্ড। ফ্রান্স জার্মানী সুইডেন ঘুরে পিকনিক চলে আসে ইংল্যান্ডে। ১৭৬৩ সালে লেডি মেরি কোক বোনকে লেখা চিঠিতে পিকনিক পার্টির কথা উল্লেখ করেছেন। উনিশ শতকের শুরুতে ইংল্যান্ডে একত্রে বসে খাওয়ার ‘পিকনিক সোসাইটি’র উদ্ভব ঘটে। ভিক্টোরিয়ান ব্রিটেনে পিকনিক ছিল সামন্ত প্রভুদের এস্টেটের আউটডোরে খাওয়া-দাওয়ার অলস অবসর। পরে মধ্যবিত্তের জীবনে আসে পিকনিক অবকাশ। ইনডোরের বদলে আউটডোরে পিকনিক হয়ে ওঠে জনপ্রিয়।

চড়ুইভাতির সেকাল-একাল
চড়ুইভাতি বা বনভোজনের ইতিহাস আমাদের বেশ পুরনো। একটা সময় গ্রাম্য আবহে চোখে পড়ত দল বেঁধে রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া। তার আগে সংগ্রহ করা হতো চাল-ডাল, কেউ দিত মসলাপাতি। গরু না মুরগি? এ দ্বন্দ্ব মেটাতেন মা-চাচিরা। বাড়ির উঠোনেই চলতো রান্নাযজ্ঞ। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই রান্নার ঘ্রাণে মৌ মৌ করত পুরো বাড়ি। তাতেই আনন্দে আটখানা হতো কচি-কাঁচার মুখ। এটিই ছিল চড়ুইভাতি।

বনভোজনে রান্না-বান্নাসহ যাবতীয় কাজে নিজেকে প্রণোদিত করা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, বন্ধুরা মিলে ঘুরতে যাওয়া, স্কুল-কলেজের বার্ষিক আয়োজনসহ বনভোজনে এসেছে নানা বৈচিত্র। বনভোজনের অর্থ বঙ্গীয় শব্দকোষে এসেছে রন্ধনপূর্বক ভোজন। পরে অভিধানে বিস্তৃত বর্ণনায় বলা হয়েছে বন বা রম্য স্থানে গিয়ে সংঘবদ্ধ রন্ধন, প্রীতিভোজন। 

শীতে পাড়ার মানুষ একদিন তরিতরকারি চাল-ডাল নিয়ে কোথাও গিয়ে রান্না করে খাওয়ার আয়োজন করত। দল ছোট হলে জোগাড় করা হতো ডিম, মুরগি। আর বড় হলে হাঁড়িকুড়ি, চাল-ডাল সবজি ছোট খাসির গলায় দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হতো গায়ের বাইরে। বড় কোন গাছ তলায়। চুলা খুঁড়ে খড়ি জ্বালিয়ে শুরু হতো প্রাক রন্ধন পর্ব। একদল রাঁধতো, অন্য দল হৈ হুল্লোড় রং তামাশায় মেতে উঠত। কাছে নদী বা জলাশয় থাকলে ডুব সাঁতারও চলতো। কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনে অংশ নিত নারী-পুরুষ সবাই। উচ্ছ্বাস-আনন্দের পালায় একত্রে বসে প্রীতিভোজন ছিল মহা-আনন্দের। খাওয়া-দাওয়া হতো কলাপাতায়।

চড়ুইভাতি ও রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর 
বনভোজন নিয়ে কথার শেষ নেই। অনেকের মতে ‘বনভোজনে’র সঙ্গে বাঙালিকে প্রথম পরিচিতি ঘটিয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘অচলায়তন,’ নাটকে কবিগুরু নতুন শব্দ তুলে ধরলেন- বনভোজন। চোখের বালি উপন্যাসে আশালতা আর বিনোদিনীর সেই শান্ত সুন্দর পিকনিকের বেলা হৃদয়ে গেঁথে যায়। সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র একটি দৃশ্যে পিকনিকে খেলতে বসে মেমোরি গেম দৃষ্টিনন্দন হয়ে আছে। মার্গারেট মিসেলের ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ নির্মিত হয়েছে একদল নগরবাসীর বনে গিয়ে পিকনিকে খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে।

বনভোজন ও শিক্ষা সফর
বাঙালির জীবনে শীত মৌসুম এখন প্রীতি উৎসবে পরিণত হয়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে বিচিত্র অনুষঙ্গ। দর্শনীয় স্থান পর্যটন এলাকা, কিংবা নিসর্গের কোন স্থানে দলবল নিয়ে ভ্রমণে গিয়ে একদিন বা কয়েক দিন অবস্থান পিকনিকের আমেজ পেয়েছে। কখনও সবাই মিলে পিকনিকের স্থান নির্ধারণ করা হয়। বনভোজনের আরও আধুনিক নাম হয়েছে শিক্ষা সফর। অর্থাৎ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর বিশেষ করে শীত মৌসুমে দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে বনভোজন বা শিক্ষা সফরের নামকরণে বনবোজন বা পিকনিক হচ্ছে।

হারিয়ে যাওয়া চড়ুইভাতি
‘একদিন দল বেঁধে ক’জনে মিলে যাই ছুটে খুশিতে হারিয়ে’… মান্না দের কণ্ঠের জাদুকরী গান মনে করিয়ে দেয়। ছেলেবেলার ‘রাঁধাবাড়া খেলা’ আজ কলেজ-ভার্সিটির জীবনে বাসে ‘বনভোজন’ ব্যানার টাঙ্গিয়ে দূরে কোথাও যাওয়া, বিচিত্রানুষ্ঠান কতই না মধুর। সুন্দর কণ্ঠের সঙ্গে হেড়ে গলার গানও চলে। দেশে দেশে পিকনিক প্রীতিপ্রদ চিরন্তন উৎসব হয়ে গেছে। বাঙালির বনভোজন কাল পৌষে যাত্রা করে বসন্তের অনেকটা সময় ধরে চলে, রূপ নিয়েছে শীতবসন্তের প্রীতি উৎসবে। বিদেশে চেরি ফুলের আনন্দের সঙ্গী হয়েছে পিকনিক। 

ধীরে ধীরে চড়ুইভাতি, বনভোজন বা পিকনিকের তকমা নিয়ে করপোরেট কালচারে রূপ নিয়েছে। বর্তমানে বনভোজন দুই তিনদিনও স্থায়ী হয়। মাঝে মধ্যে বনভোজনকে আধুনিকীকরণের সুরে আউটিং বা শিক্ষাসফর বলেও চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব আউটিং বা শিক্ষাসফরে সাধারণত কোনো ট্যুর কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়া হয়।

আমাদের গ্রামীণ পরিবেশের সেই ছোট্টবেলার চড়ুইভাতি আজ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় চড়ুইভাতি হারিয়ে যাচ্ছে বনভোজন পিকনিক আর শিক্ষা সফরের ভীরে। তাই আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে চড়ুইভাতির আসল নামকরণ ও বিশেষত্বটা তুলে ধরা উচিত। এতে করে বাঙালির ঐতিহ্য ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে হাজার বছর ধরে।

এএইচ/