ইরানের বিজ্ঞানী হত্যার পেছনে কী কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১১:০৮ পিএম, ২৯ নভেম্বর ২০২০ রবিবার | আপডেট: ১১:১০ পিএম, ২৯ নভেম্বর ২০২০ রবিবার
তেহরানে পোড়ানো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইজরায়েলের পতাকা, ২৮ নভেম্বর, ২০২০
শুক্রবার এক হামলায় তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইরানের অধিকাংশ মানুষের কোনো ধারণাই ছিলনা মোহসেন ফখরিজাদে কে। কিন্তু ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর যারা নজর রাখেন তারা তাকে ভালোই চেনেন। ইসরায়েল এবং পশ্চিমা গোয়েন্দারা মনে করেন, ফখরিযাদে ইরানের পারমানবিক কর্মসূচির প্রধান স্তম্ভ।
তবে ইরানের সংবাদ মাধ্যম ফখরিযাদের গুরুত্ব খাটো কারে দেখাচ্ছে। তারা তাকে বর্ণনা করছে একজন বিজ্ঞানী হিসাবে যিনি সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহ ধরে ইরানে করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে একটি টেস্ট কিট বানানোর গবেষণায় যুক্ত ছিলেন।
লন্ডনে গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মার্ক ফিটজপ্র্যাট্রিক, যিনি ইরানের পারমানবিক কর্মসূচির ওপর গভীর নজর রাখেন, মোহসেন ফখরিযাদের হত্যাকাণ্ডের পর টুইট করেন: “ইরানের পারমানবিক কর্মসূচি এখন এমন অবস্থায় চলে গেছে যেখানে তা আর একজন মাত্র ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়।“
যদিও আমরা জানি যে ফখরিযাদের ওপর যখন হামলা হয়, তখন তার সাথে বেশ কজন দেহরক্ষী ছিল। সুতরাং বোঝা যায় যে তার নিরাপত্তাকে ইরান কতটা গুরুত্ব দিত। সুতরাং তাকে হত্যার পেছনে ইরানের পারমানবিক কর্মসূচির সম্পর্ক যতটা না ছিল, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল তার চেয়ে বেশি।
হত্যার সম্ভাব্য মোটিভ
এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে সম্ভাব্য দুটো মোটিভ বা উদ্দেশ্য কাজ করেছে বলে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে: প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন সরকারের সাথে ইরানের সম্পর্ক ভালো হওয়ার যে কোনো সম্ভাবনা নষ্ট করা। দ্বিতীয়ত: ইরানকে বদলা নিতে উস্কানি দেওয়া।
মোহসেন ফখরিযাদের হত্যাকাণ্ডের পর তার প্রথম বক্তব্যে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি মন্তব্য করেন, “শত্রুরা গত কয় সপ্তাহ ধরে দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে।“ তিনি বলেন, “তারা বুঝতে পারছে, বিশ্বের পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে, এবং হাতের বাকি সময়টায় তারা এই অঞ্চলে একটি অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছে।“
সন্দেহ নেই যে “শত্রু“ বলতে রুহানি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প সরকার, ইসরায়েল এবং সৌদি আরবকে বুঝিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে পরিবর্তনের যে জোয়ার শুরু হয়েছে তা নিয়ে ইসরায়েল এবং সৌদি আরব উদ্বিগ্ন। জো বাইডেন ক্ষমতা নেওয়ার পর তার সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে এই দুই দেশ চিন্তিত।
তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় বাইডেন পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে তিনি ইরানের সাথে করা পারমাণবিক চুক্তিতে ফিরে যেতে চান। ২০১৫ সালে বারাক ওবামা সরকার এই চুক্তির প্রধান উদ্যোক্তা ছিল, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে একতরফাভাবে চুক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নেন।
ইসরায়েলি এবং পশ্চিমা অনেক মিডিয়ায় গত রোববার সৌদি আরবের নিওম শহরে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মধ্যে এক গোপন বৈঠকের খবর প্রচারিত হয়, এবং বলা হয় ইরান নিয়ে তাদের দুই দেশের উদ্বেগ নিয়ে ঐ বৈঠকে আলোচনা হয়।
বিভিন্ন রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে নিওমে ঐ বৈঠকে ইসরায়েলের সাথে এখনই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে নেতানিয়াহু যুবরাজ মোহাম্মদকে রাজী করাতে পারেননি। অবশ্য সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন কোন বৈঠক হওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।
যুবরাজ মোহাম্মদ এবং প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বৈঠকের পরদিনই সোমবার যখন ইয়েমেনের ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা জেদ্দায় একটি তেলের স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যেটিকে সৌদি আরব হয়তো বদলা নেওয়ার একটি সুযোগ হিসাবে দেখছে।
ঐ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইরানের কট্টরপন্থী মিডিয়ায় ঢাক-ঢোল বাজিয়ে প্রচার করা হয়, “হুথিরা কুদস-২ (ইরানে তৈরি) দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।“ ইরানের সরকার সমর্থক সংবাদ সংস্থা মেহের লেখে, “এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। সৌদি-ইসরায়েল বৈঠকের পর ঐ দুই দেশকে একটি সতর্ক বার্তা দেওয়া হলো যে ইরানের বিরুদ্ধে যেন কিছু করার আগে তারা যেন দশবার ভাবে।“
ঐ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিয়ে সৌদি ক্ষোভের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইরানে হামলার পরিকল্পনা ট্রাম্পের
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন তার ‘দি রুম হোয়ার ইট হ্যাপেনড‘ বইতে লিখেছেন কীভাবে ট্রাম্প প্রশাসন ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের প্রতি ইরানের সমর্থনকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করার একটি প্রয়াস হিসাবে দেখে।
মিডিয়ার খবর অনুযায়ী নিওমে যুবরাজ মোহাম্মদ এবং মিস্টার নেতানিয়াহুর বৈঠকের আয়োজন করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। ঐ বৈঠকের আগে তিনি কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে প্রধানত ইরান নিয়ে কথা বলে আসেন।
মার্কিন মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, তার দুই সপ্তাহ আগে ইরানের পারমানবিক স্থাপনায় হামলার উপায় নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার উপদেষ্টাদের সাথে পরামর্শ করেছিলেন। ট্রাম্প সম্ভবত তার বিদায়ের আগে ইরানকে এক হাত দেখে নেওয়ার চিন্তা করছিলেন।
জানুয়ারিতে, ইরানী সেনা কম্যান্ডার কাসেম সোলায়মানিকে ড্রোন হামলা করে হত্যা করার পর তা নিয়ে খোলাখুলি বাগাড়ম্বর করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যদিও ঐ হত্যাকাণ্ডকে জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা “বেআইনি“ বলে বর্ণনা করেন, কিন্তু ট্রাম্প সে সময় খোলাখুলি বলেন, তার নির্দেশেই কাসেম সোলায়মানিকে হত্যা করা হয়েছে।
সুতরাং পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিযাদের হত্যকাণ্ডের পেছনেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনুমোদন থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায়না। তবে ইরানের প্রেসিডেন্ট এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি ইসরায়েলকে দায়ী করেছেন।
২০১৮ সালে এক লাইভ টিভি অনুষ্ঠানে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ইরানের পারমানবিক কর্মসূচিতে ফখরিযাদের ভূমিকা উল্লেখ করে বলেছিলেন, “মোহসেন ফকরিযাদে নামটি মনে রাখুন।“
যদিও ইসরায়েল জানে জো বাইডেন তাদের নিরাপত্তার প্রতি প্রতিশ্রুতি-বদ্ধ থাকবেন, কিন্তু তাদের মনে একটি উদ্বেগ কাজ করছে যে জো বাইডেনের মনোনীত পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ইরানের সাথে করা পারমানবিক চুক্তির একজন ঘোরতর সমর্থক।
ইসরায়েল হয়ত এ নিয়েও শঙ্কিত যে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা সম্পর্কে ব্লিনকেনের দৃষ্টিভঙ্গি ফিলিস্তিনিদের সুবিধা দেবে। ট্রাম্প প্রশাসন জেরুজালেমকে ইসরায়েলের বৈধ রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়াকে পছন্দ করেননি নতুন এই সম্ভাব্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। যদিও জো বাইডেন বলেছেন তিনি জেরুজালেম নিয়ে মি ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত বদলাবেন না।
ইরানের দ্বিধা
ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতোল্লাহ আলি খামেনি মোহসেন ফখরিযাদেকে হত্যার জন্য দায়ীদের “নিশ্চিত শাস্তির“ কথা বলেছেন। ইরানের ভেতরেই নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা দুর্বলতা নিয়ে কথা উঠেছে। ইরানের রেভল্যুশনারী গার্ড বাহিনীর প্রভাবশালী একজন কমান্ডার মোহসিন রেজায়েই বলেন, “ভেতরে ঢুকে পড়া গুপ্তচর যারা বিদেশী গুপ্তচর সংস্থাগুলোকে খবর দিচ্ছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে।“
ইরানে সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন যে ইরানের সরকার যখন তাদের সেনা এবং গোয়েন্দা দক্ষতা নিয়ে এত বড়াই করে, তখন কীভাবে নিরাপত্তার আবরণে থাকা একজন বিজ্ঞানী এভাবে দিনে দুপুরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন। এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দেশের ভেতর নির্বিচারে ধরপাকড় নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।
ট্রাম্পের প্রস্থানে ইসরায়েল এবং সৌদি আরব যেখানে তাদের প্রধান একজন মিত্র হারাচ্ছে, সে সময় ইরান আশা করছে জো বাইডেন তাদের ওপর থেকে অনেক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবেন যা তাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সাহায্য করবে।
ফলে তারা ফখরিযাদের হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে এখনই কিছু করতে চাইছে না।
ড. মাসুমে তরফে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স এবং স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের একজন গবেষক। তিনি ইরান, আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার রাজনীতির একজন বিশেষজ্ঞ। সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসি