একজন আনিসুল হক
সেলিম জাহান
প্রকাশিত : ১০:০১ এএম, ৩০ নভেম্বর ২০২০ সোমবার
আজ ৩০শে নভেম্বর। প্রয়াত আনিসুল হকের প্রয়াণ দিবস। ‘আনিসুল হকের ওপরে কিছু লিখুন’- অনুরোধ জানিয়েছেন এক শুভানুধ্যায়ী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আনিসুল হকের ‘ওপরে’ আমি লিখতে পারবো না। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। তাঁর শৈশব, কৈশোর বা যৌবনের বেড়ে ওঠার সাক্ষী আমি ছিলাম না। জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠান উপস্থাপক হিসেবে তিনি যখন খ্যাতির তুঙ্গে, তখন আমি প্রবাসে। সুতরাং প্রয়াত আনিসুল হকের কোন স্মৃতিচারনা আমার আয়ত্ত্বের বাইরে।
সব কিছু ভেবে-চিন্তে আমার মনে হয়েছে যে, প্রয়াত আনিসুল হকের ‘ওপরে’ নয়, কিন্তু আনিসুল হককে ‘নিয়ে’ আমি হয়তো কিছু লিখতে পারি! এই যে জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁর অনন্যসাধারণ অর্জনের কথা লোকমুখে ফেরে এই যে তাঁর অকাল প্রয়াণে সারা দেশের মানুষ শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল, এই যে পরম মমতা, ভালবাসায় আর শ্রদ্ধায় তাঁকে শেষ বিদায় জানিয়েছিলো এক জনসমুদ্র, তার রহস্যটা কোথায়?
জননেতা হিসেবে, জনপ্রতিনিধি হিসেবে, জনপ্রশাসক হিসেবে কি ছিল তাঁর মধ্যে যা অন্যদের মধ্যে নেই? কি শেখার আছে তাঁর কাছ থেকে বর্তমান প্রজন্মের ও ভবিষ্যতেরও যাঁরা জননেতৃত্ব দিতে চান, জনসেবাকে জীবনের লক্ষ্য করতে চান এবং জনপ্রতিনিধি হতে চান? আমার মনে হয়েছে সেই আঙ্গিক ধরে প্রয়াত আনিসুল হককে ‘নিয়ে’ কিছু হয়তো বা আমি লিখতে পারি - যেখানে আনিসুল হক এক অনন্য আধার সেই সব বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরার জন্য।
ঢাকা শহরের নগরপাল হিসেবে তাঁর অভাবনীয় কাজ দেখে, বিভিন্ন সময়ে তাঁর নানান উক্তি ও কথাবার্তা শুনে, ঢাকা শহর প্রশাসনের জন্য শহরের বিভিন্ন অংশে তাঁর পদচারনা দেখে জননেতা ও জনপ্রশাসক হিসেবে প্রয়াত আনিসুল হকের পাঁচটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং গুনাবলী আমার চোখে ধরা দিয়েছে। সবিনয়ে স্বীকার করি, এ শুধু আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে দেখা, না এটা পূ্র্নাঙ্গ, না এটা সার্বজনীন। তবে দেশে-বিদেশে নানান সফল ও জননন্দিত জননেতা ও জনপ্রশাসকের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে আমার উপলব্ধি হয়েছে যে তাঁদের মাঝেও ঐ সব অভিন্ন গুনাবলী প্রত্যক্ষ করেছি, যা প্রয়াত আনিসুল হকের মাঝেও চিহ্নিত করতে পেরেছি।
প্রথমত : আমার সব সময়ে মনে হয়েছে যে মানুষের জন্য আনিসুল হকের ছিল একবুক ভালবাসা। সবকিছু নির্বিশেষে সব মানুষকেই তিনি কাছে টেনে নিয়েছিলেন এবং সেই অর্থে প্রকৃত প্রস্তাবেই তিনি ছিলেন মানুষের নেতা। মানুষের মঙ্গলকেই লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছিলেন তাঁর চিন্তা-চেতনায়, মানব উন্নয়নকেই দিয়েছিলেন অগ্রাধিকার এবং অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন মানুষের কল্যানের প্রতি। তাই বারবার সুখে-দু:খে, বিপদে-আপদে, সংশয়-সংকটে তিনি বারবার মানুষের কাছেই ছুটে গিয়েছিলেন। মানুষ তাঁকে দেখে আশ্বস্ত হয়েছে, ভরসা পেয়েছে, আস্হা ও বিশ্বাস হারায় নি।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে তাঁর চেহারায়, ব্যক্তিত্বে, ব্যবহারে প্রয়াত আনিসুল হকের একটি মোহনীয় আকর্ষন-শক্তি ছিল। তিনি নিজও তা জানতেন। কিন্তু আর পাঁচজন আকর্ষনীয় জননেতার মতো তিনি তার অপব্যবহার করেন নি, লাগান নি নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য, করেন নি এমন কিছু যা মানুষের জন্য অমঙ্গলের কারণ হতে পারে।
দ্বিতীয়ত : আমরা জানি যে মানব সভ্যতার বিবর্তনে রাজনীতি একটি বিরাট শক্তি-যা মানুষের মঙ্গলের কাজে লাগানো যেতে পারে, আবার মানুষের ধ্বংসেও।দেশে-বিদেশে নানান সময়ে রাজনীতি রাজনৈতিক নেতাদের স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির অস্ত্র হয়ে উঠেছে, মানব-মঙ্গলের পন্হা হয়ে ওঠেনি। বহু সময়ে রাজনীতি সুস্হ থাকেনি, গঠনমূলক ভিত্তির ওপরেও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রয়াত আনিসুল হক কখনোই রাজনীতির অপশক্তির প্রতিনিধিত্ব করেননি, তিনি ছিলেন রাজনীতির শুভ শক্তির প্রতীক।
সে প্রেক্ষিতকে সামনে রেখেই তিনি সুস্হ ও গঠনমূলক রাজনীতি করেছেন। রাজনীতি মাত্রেই অসুস্হ-এমন একটা জনগ্রাহ্য বিশ্বাস আমাদের সমাজে বড়ই গভীর। আমার ধারনা, প্রয়াত আনিসুল হক এ নেতিবাচক বিশ্বাসটিকে ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর নিজের কর্প্রমকান্ডের মাঝ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন এ সত্যটিকে যে রাজনীতি মাত্রেই অসুস্হ হওয়ার প্রয়েজন নেই, সুস্হ রাজনীতিই মানুষের ও সমাজের স্হায়ী কল্যাণ বয়ে আনতে পারে।
তৃতীয়ত : নির্ভীক ছিলেন প্রয়াত আনিসুল হক - কথনে, কর্মে। সত্য কথা বলতে পেছ পা হন নি, ছেড়ে কথা কন নি কাউকে। দেশবাসী ও ঢাকাবাসী এটা বহুবার প্রত্যক্ষ করেছে। নিজে হয়তো বিশ্বাস করতেন, সত্য শুধু সুন্দর নয়, মঙ্গলময়ও বটে। তাঁর কর্মকান্ডেও এ নির্ভীকতা বারবার উঠে এসেছে। নগরপাল হিসেবে এমন সব কাজ করেছেন যা আগে কেউ করা তো দূরের কথা, করার সাহস পর্যন্ত কারো হয় নি; এমন সব কর্মকান্ড সম্পন্ন করেছেন, যা সবাই অসাধ্য বলে মনে করেছে।
এর অনেক কিছুই প্রয়াত আনিসুল হক করতে পেরেছেন, তা তিনি আনিসুল হক বলেই। ইস্পাতের মতো দাঢ়্যতা ছিল, ছিল মৃত্তিকার মতে আত্মবিশ্বাস। আর সে দাঢ়্যতা আর আত্মবিশ্বাসের জোরেই যে কারো সঙ্গে, যে কোন বিষয়ে বির্তকে মেতে তিনি তাঁর বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন, নিজস্ব মতামতের অনুসারী করতে পারতেন অন্যদেরও। বাংলাদেশ ছিল তাঁর অহংকার, ঢাকা ছিল তাঁর গর্ব। এ দুটোই হয়তো তাঁর দাঢ়্যতা আর আত্মবিশ্বাসকে আরো জোরালো হতে সাহায্য করেছে।
চতুর্থত : অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন প্রয়াত আনিসুল হক। কথার যাদুকরও বলা চলে। তার প্রথম প্রমান আমরা পেয়েছি তাঁর টেলিভিশন অনুষ্ঠান উপস্হাপনার কালে। যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের সবাই বলেছেন কি মনোমুগ্ধকর ছিল তাঁর উপস্হাপনা, শব্দশৈলী, বাচনভঙ্গী। হয়তো পরবর্তী সময়ের বাগ্মিতার হাতেখড়ি তাঁর ওখানেই।
একজন সফল জননেতার জন্য বাগ্মিতা একটি বড় মূলধন। কথার মাধ্যমেই মানুষের কাছে যেতে হয়, তার আস্হা অর্জন করতে হয়, তাকে নিশ্চিত করতে হয়। তারপর অবশ্যই আসে কাজ। একজন নেতাকে মানুষের কাছে পৌঁছুনোর জন্য কথা আবশ্যিক শর্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়। কথা ও কাজের অপূর্ব এক সমন্বয় আনিসুল হক ঘটিয়েছিলেন- যা যে কোন জননেতার জন্য অনুকরণীয়।
শেষত : প্রয়াত আনিসুল হক ছিলেন অপ্রথাগতভাবে মেধাবী ও এক অনন্যসাধারন স্বপ্নদ্রষ্টা। প্রথাগত ভাবে আমরা ‘মেধাবী’ শিরোনামটিকে পড়াশোনা আর পরীক্ষার ফলাফলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখি। যাঁরা তাঁকে জানতেন, তাঁদের মুখেই শুনেছি যে প্রথাগত নির্ণায়কে প্রয়াত আনিসুল হক মেধাবী ছিলেন না। কিন্তু তাঁর মেধা ব্যপ্ত ছিল বৃহত্তর পরিসীমায়- সৃজনশীল চিন্তায়, সৃষ্টিশীল কাজে। তাই নতুন নতুন ধারনায় সিক্ত হতেন তিনি, ভেতরে-বাইরে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ ছিল না তাঁর।
নতুন নতুন ধারনা আর দিক্-নির্দেশনা তাঁকে বারবার উজ্জীবিত করেছে। এক ভবিষ্যত স্বপ্নদৃষ্টি তাঁকে সম্ভবত: তাড়িয়ে বেড়িয়েছে নিত্য।হয়তো তাই পাগলের মতো কাজ করে বেড়াতেন। এত স্বপ্ন, অত কাজ- এত স্বল্প সময়। কিন্তু স্বপ্নদৃষ্টিই তো একজন সৃজনশীল মানুষকে অন্যদের থেকে পৃথক করে।
(লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে সংগ্রহ)
এসএ/