হারিয়ে যাচ্ছে মধুবৃক্ষ
আ নো য়া র কা জ ল
প্রকাশিত : ১২:০৭ পিএম, ৩ ডিসেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার
শীত মৌসুমে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষকে ঘিরে গ্রামীণ জনপদ থাকত উৎসবমুখর। এ সময় মেহমান আসা মানেই খেজুরের রস ও নতুন চালের ভাঁপা পিঠা, পুলি ও পায়েশ দিয়ে আপ্যায়ন। তা ছাড়া খেজুরের গুড় দিয়ে মুড়ির মোয়া, চিরার মোয়া ও মুড়ি খাওয়ার জন্য কৃষক পরিবার থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের শীতের মৌসুম ছিল অতি প্রিয়। কিন্তু আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের বাহক গ্রাম-গঞ্জ থেকে খেজুরগাছ আজ বিলুপ্তির পথে।
প্রভাতে মুক্তার দানার মতো শিশির ভেজা ঘাস। নতুন ধানের মৌ-মৌ ঘ্রাণ আর হালকা কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা, পাখি ডাকা, ছায়া ঘেরা, মায়া ভরা, দিগন্ত প্রসারী সবুজ-শ্যামলে নকশা আঁকা মাঠ-ঘাট ভরা ফসলে। এমনই শীতের সকালে মিষ্টি রোদে বসে সুস্বাদু খেজুরের রস খাওয়ার মজাই আলাদা।
মৌসুমি খেজুরের রস দিয়েই শীতের আমেজ শুরু হতো আবহমান বাংলার গ্রামীণ জনপদে। শীতকালে নতুন ধানের চাল দিয়ে বিভিন্ন রকমের পিঠা-পায়েস তৈরিতে খেজুরের রস ও গুড়ের কোন জুড়ি নেই। কিন্তু সেই গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু খেজুরের রস এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। সময়ের পরিক্রমায় আধুনিক নগরায়নের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার চির চেনা খেজুর গাছ এবং গাছের রস।
একসময় গ্রামীণ অধিকাংশ রাস্তার পাশে, পুকুরপাড়ে ও কৃষিজমির পাশে ছিল প্রচুর পরিমাণ খেজুর গাছ। শীত মৌসুম শুরু হতেই গাছীরা ব্যস্ত হয়ে পড়ত খেজুরের রস সংগ্রহ করার কাজে। সেই রসের চাহিদাও ছিল প্রচুর। বিভিন্ন পিঠা, পুলি ও পায়েসসহ নানা প্রকার খাবার তৈরির জন্য খেজুরের রস ছিল অন্যতম উপাদান। এ জন্য গাছীদের চাহিদার কথা আগেই বলে রাখতে হতো। ফলে যাদের খেজুর গাছ ছিল না তারাও রস খাওয়া থেকে বঞ্চিত হতেন না।
ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ
শীত মৌসুম এলে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ বলে খ্যাত খেজুরগাছের রস দিয়ে বিভিন্ন উপাদেয় খাবার তৈরির উৎসব শুরু হতো। খেজুরের রস দিয়ে তৈরি গুড় পাটালি, পিঠা, পায়েস ইত্যাদি নিয়ে গ্রামের মানুষ অতিথিদের আপ্যায়ন করত। আসলেই খেজুরের রস ও খেজুরের মিঠার গন্ধে গ্রামীণ জনপদ মৌ মৌ করতো। শীত আসতেই গাছিরা ব্যস্ত হয়ে পড়তো খেজুর গাছ রসের উপযোগী করতে। গাছিরা এই সময় অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হতো। কালের বিবর্তনে অর্থনীতির চাকাকে চাঙ্গা করতে গিয়ে গ্রামীণ ঐতিহ্যের অনেক গাছের মত খেজুর গাছকেও কেটে ফেলে লাগানো হয়েছে কাঠের গাছ।
শীতে গ্রামজুড়ে আনন্দময় পরিবেশ বিরাজ করত। বিশেষ করে পৌষ-মাঘ শীত মৌসুমে গাছীদের আনন্দের সীমা থাকত না। খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য মহাব্যস্ত হয়ে পড়তেন তারা। সকাল হলেই রস সংগ্রহ করতো আর বাজারে নিয়ে বিক্রি করতো।
খেজুরের রসের পুষ্টিগুণ ও সংগ্রহের সময়
খেজুর গাছ থেকে সংগৃহীত রস মিষ্টি স্বাদের। এই রস শুধু শীতকালে সংগ্রহ করা হয়। খেজুরের রস খনিজ ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। আশ্বিন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহ অর্থাৎ অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। ঠাণ্ডা আবহাওয়া, মেঘলা আকাশ ও কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল পর্যাপ্ত রসের জন্য উপযোগী। এই সময়ে প্রাপ্ত রসের স্বাদও ভালো হয়। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়। তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে রসের পরিমাণ ও মান কমতে থাকে।
গাছের বয়স
নূন্যতম ৫ বছর বয়সী গাছ থেকে রস সংগ্রহ শুরু করা হয়। গাছের বয়স, এলাকা বা মাটির প্রকারভেদ ছাড়াও একই মৌসুমের বিভিন্ন সময় ও গাছের যত্নের ওপর রসের প্রাচুর্যতা নির্ভর করে। আবার পুরুষ গাছ স্ত্রী গাছের চেয়ে বেশি রস দেয় এবং রসও তুলনায় বেশি মিষ্টি হয়।
খেজুরের রস সংগ্রহ
খেজুর শুষ্ক ও মরু অঞ্চলের উদ্ভিদ হওয়ায় এ অঞ্চলের খেজুর খাদ্য হিসেবে খুব একটা ব্যবহার হয় না। তবে এই গাছের রস আকর্ষণীয়। গাছ থেকে রস সংগ্রহের নিয়ম হলো প্রথমে খেজুর গাছের মাথার অংশের কাছাকাছি ভালো করে পরিষ্কার করে গাছের ভেতরের রস বের করার জন্য গাছের সাদা অংশ বের করতে হবে। এরপর পরিষ্কার করা সেই সাদা অংশ থেকে বিশেষ কায়দায় ছোট-বড় মাটির পাত্র যেমন ঘটি, কলস ইত্যাদি দিয়ে রস সংগ্রহ করা হয়।
ছোট বড় বিভিন্ন রকমের খেজুর গাছে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে কোমড়ে মোটা রশি বেঁধে গাছে ঝুলে খেজুর গাছের রস সংগ্রহের কাজ করতে হয় গাছিদের। গাছিরা প্রতিদিন বিকেলে খেজুর গাছের সাদা অংশ পরিষ্কার করে ছোট-বড় কলসি বাঁধে রসের জন্য। আবার কাকডাকা ভোরে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে নিয়ে যায় বিভিন্ন এলাকায়। কেউ কেউ এই রস এলাকার বিভিন্ন স্থানে ও হাটে-বাজারে (কাঁচা রস) বিক্রয় করে আবার কেউ কেউ সকালেই এই রস দিয়ে বিভিন্ন রকমের পাটালি ও গুড় তৈরি করার কাজ শুরু করেন।
গ্রামের অনেক মানুষ শীতের সকালে সুস্বাদু এই খেজুরের রস ও খেজুর রসের তৈরি গুড় নেওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকে। যা দিয়ে তৈরি হয় মুখরোচক খাবার পায়েস ও হরেক রকমের পিঠা।
হারিয়ে যাওয়ার কারণ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাসজনিত কারণে এখন আর আগের মত খেজুরের রস খেতে চায় না মানুষ। আর খেজুর রস বিক্রি না হওয়ায় কমে গেছে গাছির সংখ্যাও। মাঝে মধ্যে দু’ একজনকে দেখা যায় রস সংগ্রহ করতে। তবে বাজারে ক্রেতা কমে যাওয়ায় তারা এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। আগের মত আর গাছিদের দেখা যায় না, হাতেগোনা দু’একজনকে দেখা যায় মাটির হাড়িতে করে ভাড় সাজিয়ে রস ও খেজুর গুড় নিয়ে বের হয়েছেন গ্রামে।
খেজুরের রসের দানা গুড়, ঝোলা গুড়ের ঘ্রাণ এখন আর গ্রামের হাটবাজারে তেমন পাওয়া যায় না। শীতে মিষ্টি খেজুরের রসের স্বাদ আজ ভুলতে বসেছে মানুষ। আগের মতো আর বাজারে পাওয়া যায় না আসল খেজুরের পাটালি। খেজুরের গুড় হিসেবে যা পাওয়া যায় তার বেশির ভাগই চিনি দিয়ে তৈরি।
স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা ও কঠোর নজরদারির অভাবে ইটের ভাটায় অবাধে খেজুরগাছসহ ফলবান বৃক্ষ পোড়ানোর কারণে খেজুর বৃক্ষের বিরাট অংশ উজাড় হয়ে যাচ্ছে।
এভাবে চলতে থাকলে একসময় খেজুর রসের ঐতিহ্য চিরতরে হারিয়ে যাবে। একসময় দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশে খেজুরের গুড় রপ্তানি হতো। এখন তা অতীত। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারি উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। আগে শীত আসলে মিষ্টি রোদে বসে খেজুরের রস খেতাম। কিন্তু এখন সারা গ্রাম খুঁজেও কোথাও খেজুরের গাছ বা গাছি কারো সন্ধান পাওয়া যায় না।
তাই সকলেরই খেজুর গাছ লাগানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম খেজুরের রসের কথা শুধু বই পুস্তকে পড়বে, কিন্তু বাস্তবে তা পাবে না।
এএইচ/এসএ/