বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ও আমাদের পরিস্থিতি
মো : রিয়াদুল আহসান নিপু
প্রকাশিত : ১১:৪৩ এএম, ৫ ডিসেম্বর ২০২০ শনিবার
পরিবেশের অন্যতম প্রধান উপাদান এবং এক অমূল্য সম্পদ হল মাটি। শুধু তাই নয় এটি কৃষির মূল মাধ্যম। International Union of soil science সারা পৃথিবীর মানুষের মাঝে মৃত্তিকা সম্পদ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ২০০২ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক ভাবে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পালন করে আসছে। পরবর্তীতে এর গুরুত্ত্ব অনুধাবন করে জাতিসংঘের সাধারন পরিষদ ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ৫ ডিসেম্বরকে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৪ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রথমবারের মত জাতিসংঘের FAO এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সারা পৃথিবীব্যাপী ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস’ পালিত হয়।
এদেশে এখনো ব্যাপকভাবে পালিত না হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ বছর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস এর প্রতিপাদ্য বিষয় হল ‘কিপ সয়েল অ্যালাইভ, প্রটেক্ট সয়েল বায়োডাইভারসিটি’ অর্থাৎ ‘মাটি বাঁচিয়ে রাখুন, মাটির জীববৈচিত্র্য রক্ষা করুন’। পৃথিবীর জীববৈচিত্রের মোট ২৫% এর সরাসরি আবাসস্থল হল মৃত্তিকা। মৃত্তিকার অনুজীব কর্মকান্ড মাটির গুনাগুন এবং কৃষি উতপাদনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। FAO এর মতে Soil microorganism মাত্র ১% সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন অর্থাৎ অধিকাংশই এখনো অজানা।
এছাড়া সারা পৃথিবীর জীব সমূহের প্রায় ৯০ ভাগই জীবনচক্রের কোন না কোন অংশ মাটিতে অতিবাহিত করে। কৃষি ও পরিবেশগত ঝুঁকিসহ বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে মাটির গুনাগুন হ্রাস পাচ্ছে। আমরা অনেকেই হয়ত জানিনা যে ভূমির উপর প্রাকৃতিকভাবে ১ ইঞ্চি পরিমান মৃত্তিকা গঠিত হতে ৫০০-১০০০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। অথচ নানা কারণে ভূমির উপরিভাগের মাটি যা চাষাবাদ ও বৃক্ষ জন্মাবার মাধ্যম তা নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশে soil biodiversity হ্রাসের কারণের মধ্যে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ন, কীটনাশক এর অপরিকল্পিত ব্যবহার, ব্যাপকভাবে বনভূমি ধ্বংস করা, পাহাড়ে জুম চাষ, ইটের ভাটা অন্যতম।
সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশ গত ছাড়পত্র (Environmental clearance certificate) ব্যাতিত প্রচুর পরিমান ইটের ভাটার কথা গণমাধ্যম এ প্রকাশিত হয়েছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কেননা এটি বিপুল পরিমান ভূমি ক্ষয় ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশে সেভাবে এখনো Land use planning না থাকাতে কৃষির জন্য খুবই উপযোগী জমিকেও অবলীলায় শিল্প কারখানা এমন কি ইটের ভাটা স্থাপনেও ব্যবহ্রত হচ্ছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে রিসোর্ট তৈরী, এমন কি শিল্প কারখানা পর্যন্ত স্থাপিত হচ্ছে যা মাটির ক্ষয় ও পরিবেশ দুষণ ঘটাচ্ছে।
উল্লেখ্য, আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩% করে বনভূমি বিনাশ হচ্ছে যা ব্যাপকভাবে ভূমি ক্ষয়ের কারণ এবং বাংলা পিডিয়ার তথ্য মতে এভাবে মৃত্তিকা ক্ষয়ের পরিমান বছরে ১০২ টন/হেক্টর। এছাড়া এদেশের পাহাড়ি অঞ্চল যেখানে জুম চাষ হয়ে থাকে সেখানেও মৃত্তিকা ক্ষয় এর পরিমান স্বাভাবিক এর চেয়ে অনেক বেশি (বছরে ৭-১২০ টন/হেক্টর)।
এছাড়া বিগত এক দশকে সিডর, আইলা, ফনিসহ একাধিক সাইক্লোন ঘুর্নিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস এবং ফারাক্কা বাধের কারনে আমাদের উপকুলীয় জেলা গুলোতে লবনাক্ততা ব্যাপকভাবে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশগত ভারসাম্য কে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে জীববৈচিত্র।
দেশের কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় মৃত্তিকা সম্পদের সঠিক ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই। ভবিষ্যতে দেশের আবাদি জমির পরিমান আরেও কমবে যা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে।
আমাদের দেশে মৃত্তিকা বিজ্ঞান এবং পরিবেশ বিজ্ঞান স্কুল কলেজ পর্যায়ে এখনো সেভাবে পাঠ্য নয়। কাজেই বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। soil Olympiad সহ নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে ঢাবি, কৃষি মন্ত্রণালয় সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ব্যাতীত টেকসই উন্নয়ন বা sustainable Development সম্ভব নয়। সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদেও বর্তমান ও ভবিষ্যত নাগরিকদের জন্য পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে, জলাভূমি সংরক্ষণকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আমাদের কৃষি ও পরিবেশবান্ধব বর্তমান সরকার অন্তত সকল জেলায় মৃত্তিকা গবেষণাগার তৈরীসহ মৃত্তিকার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরন ও জীববৈচিত্র্যে সংরক্ষণে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : ঢাবি, মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, (বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকে কর্মরত)
এসএ/