সবচেয়ে প্রেডিক্টেবল নির্বাচনের পথে ব্রিটেন
মুনজের আহমদ চৌধুরী
প্রকাশিত : ০৬:৩০ পিএম, ২০ মে ২০১৭ শনিবার | আপডেট: ০৬:২৭ পিএম, ১১ জুন ২০১৭ রবিবার
ব্রিটেনের অগামী ৮ জুনের সংসদ নির্বাচনের ফলাফল কি ঘটবে এটি নিঃসন্দেহে ধারনা করা যায়। নিদেনপক্ষে, ব্রিটেনের রাজনীতি নিয়ে যাঁরা ন্যূনতম ধারনা রাখেন তারা জানেন, ক্ষমতাশীন কনজারভেটিভ পার্টিই জিতবে। যে নির্বাচনে ক্ষমতায় থাকা দলটির সন্দেহাতীতভাবে জয়ী হবার সমূহ সম্ভাবনা, এমন নির্বাচন কেন সরকারই হঠাৎ করে আয়োজনের তাগিদ অনুভব করলো? এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ব্রিটেন রাষ্ট্র বা জনগনের প্রাপ্তি-প্রত্যাশা কোথায়; এ লেখার গন্তব্য আসলে সে প্রশ্নের উত্তরের সন্ধান।
এক.
ব্রেক্সিট ট্রিগারের পর্যায়ে ব্রিটেনে একটি অর্ন্তবর্তীকালীন নির্বাচন অনুষ্টিত হতে পারে, সেটি প্রায় বছরখানেক আগ থেকেই লিখছি। কারণ, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খেরেনা মের এ সরকারের এক অর্থে জনগণের সরাসরি ম্যান্ডেট নেই। বহুবার অর্ন্তবর্তী নির্বাচনের দাবী উঠলেও প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে ছিলেন নিশ্চুপ। তাহলে হঠাৎ তিনি কেন গত ১৮ ই এপ্রিল আচমকাই নির্বাচনের ঘোষনা দিলেন? তাও খুব কম সময় মাঝখানে রেখে।
ব্রিটেনের বিরোধীদল লেবার পার্টি স্মরণকালের মধ্যে নেতৃত্বের জটিলতায় এখন সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। দলের অভ্যন্তরে প্রশ্নবিদ্ধ পার্টি লীডার জেরেমী করবিনের নেতৃত্ব। স্যোশাল বেনিফিট বা শুধু নাগরিক সুবিধার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দলটি নতুন প্রজন্মের ভোটারদের আগের মত ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। পক্ষান্তরে, ব্যক্তিগত সুবিধার আগে ব্রিটেনের অর্থনীতি; কনজারভেটিভের এমন নীতির পাশাপাশি লিবডেম ও ইউকিপে আস্থা হারানো বিরক্ত ভোটার শেষ পর্যন্ত মন্দের ভালো খুজঁছেন টোরির দলেই।
গত দশকে আস্তে আস্তে বাম ধারার দল লেবার পার্টি ক্রমশ নেতৃত্বের পথ বেয়ে ডান ধারায় ঝুকঁছিল। আর, দুনিয়াজুড়েই একধরনের জোয়ার ছিল উগ্র জাতীয়তাবাদের। সেটি কেবল যে আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প বা ইউরোপের কিছু দেশে তা কিন্তু নয়। ভারতের সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনেও দেখেছি অভিন্ন চিত্র। ছিল বলছি একারণে, সম্প্রতি ফ্রান্স ও এর আগের বছরের শুরুতে নেদাল্যারন্ডসের নির্বাচনেও অতি ডানদের পিছু হটা শুরু হয়েছে।
এখন, ব্রিটেনে ফের ফার লেফটের পথে জেরেমীর নেতৃত্বে লেবার পার্টির মূল নীতিতে ফিরবার পুনঃযাত্রায় ব্রিটিশ, বিশেষ করে ইংলিশ জনগণ কতটা প্রস্তুত, সেটিও প্রশ্নবোধক। লেবার পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে ঘনীভূত সংকটের শতভাগ সুযোগ নিতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা। বিরোধী শিবিরের প্রতিকূল বাস্তবতাকে শতভাগ নিজের অনুকূলে কাজে লাগাতে চেয়েছেন তিনি। যেখানে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে লেবার পার্টি ভোটের লড়াইয়ের জন্য দল হিসেবে অনেকটাই অপ্রস্তুত। সরকারের উপকূলে থাকা মাঠে এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে লেবার পার্টি টানা তৃতীয় বারের মত জনগণের ভোটে প্রত্যাক্ষাত হবে। এ পরাজয় আর দলীয় সংকটের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা হবে দলটির জন্য যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ।
বর্তমান পার্টি লীডার জেরেমি করবিন একই সাথে ব্যর্থ নেতৃত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন। এর অব্যাবহিত পরবর্তী সময়ে লেবার পার্টি দলটির নতুন নেতৃত্বের জন্য ব্যাস্ত থাকবে। আর ঐ সময়ে থেরেসা মের সরকার থাকবে বিরোধীদলের অভ্যন্তরীণ বিরোধের সুযোগে নিরাপদ। এরই মাঝে অবশ্য দু শিবিরের অনেক সিনিয়র পার্লামেন্টারীয়ান আসছে, নির্বাচনে না লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সার্বিক বিচারে এখন পর্যন্ত এ নির্বাচন কার্যত দেশটির সবচেয়ে আকর্ষণহীন সংসদ নির্বাচনে রূপ নিয়েছে।
আসন্ন নির্বাচনে লেবার পার্টি কেন পরাজিত হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে এটুকু বলতে পারি, ব্রেক্সিটই একমাত্র কারণ নয়। লেবার পার্টির যে এমপি প্রার্থীরা এবারের নির্বাচনে লড়ছেন, তাদের বেশিরভাগ ব্রেক্সিটের গণভোটে রিমেইনের পক্ষে ক্যাম্পেইন করে হেরেছেন। গত বছরের ২৩ জুন থেকে এ বছরের ৮জুন। মাঝখানের সময়টা সল্পতার নিরিখেই ভোটারদের ভুলবার নয়।
দলীয় অভ্যন্তরীণ সংকটে দলটির বহু নেতাকর্মী নিজেরাই দল এ নির্বাচনে ক্ষমতায় যাবে, এটি বিশ্বাস করেন না। যদিও, লেবার সমর্থকরা বলছেন, এ নির্বাচন থেরেসা মে আয়োজন করছেন তার নিজের নেতৃত্বে আরও শক্তিশালী সরকার ও পছন্দসই ব্রেক্সিটের জন্য, আসলে ব্রিটেনের জনগণের জন্য নয়। দৃশ্যত, থেরেসা মে বিরোধী শিবিরের প্রতিকূলতাকে কাজে লাগাতে এ সময়টিকে মোক্ষম মনে করেছেন। আর নির্বাচন ঘোষণার পর পুজিঁবাজার ও পাউন্ডের দরপতনের যে আশংকা করা হয়েছিল, তাও সত্য হয়নি।
একথাও সত্য, ব্রিটেনে জনগণ ভোট দেয় দলগুলোর মূলত ম্যানিফেষ্ট দেখে। শুধুমাত্র শুরু থেকে ফেভারিট হিসেবে নয়, লন্ডনের গত মেয়র নির্বাচনে লেবার পার্টির সাদিক খানের জয়ের নেপথ্যে তার হোপার টিকেট, হাউজিংয়ের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেয়া ইশতেহারটিও প্রভাবক ভূমিকা রাখে। যদিও শুরু থেকে তার প্রতিদ্বন্দী জ্যাক গোল্ডস্মিথ সাদিকের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন। লন্ডনের বারগুলোর বেশির ভাগই লেবার অধ্যুষিত। সাদিক খান ঐ নির্বাচনে ৫৬.৮ শতাংশ ভোট পান। গোল্ডস্মিথ পান ৪৩.২ শতাংশ। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে কোন দলের এককভাবে সরকার গঠন করতে হলে ৬৫০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে জিততে হবে ৩২৬টি আসনে। গত নির্বাচনে কনজারভেটিভ ৩৩০ আর লেবার পার্টি ২২৯ টি আসনে জেতে।
বাংলাদেশে বর্তমানে বিনা প্রতিদ্বন্দীতার নির্বাচিত সরকার দেশ শাসন করছে। বিএনপির রাজনৈতিক ব্যর্থতার উপর সরকার যেভাবে দেশ চালাচ্ছে, এখানকার সরকারী দলেরও এগিয়ে থাকার নেপথ্যে রয়েছে লেবার পার্টির সিদ্বান্তগত, কৌশলগত রাজনৈতিক ব্যর্থতা। ব্রিটেনের জনগণ সবসময় শক্তিশালী সরকার চায়। এবার এক্ষেত্রে লেবার পার্টি সরকার গঠন যদি শেষবধি গঠন করেও ( যদিও সবগুলো জনমত জরিপ বলছে সে সম্ভাবনা নেই) সেটি হবে দুর্বল কোয়ালিশন সরকার। একথা সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও বল্টনে নির্বাচনী প্রচারনায় নিজে বলেছেন।
নির্বাচনে আমার ধারনা, বড় জয় পাবে কনজারভেটিভ। আসন সংখ্যা বাড়বে ব্যবধানে। বর্ণবাদী দল হিসেবে চিহ্নিত ইউকিপের ভোট কমতে পারে বড় ব্যবধানে। গত নির্বাচনে যেসব ভোট পড়েছিল ইউকিপের বাক্সে, এবার সেসব ভোটের একটি বড় অংশের গন্তব্য হতে পারে কনজারভেটিভ। লিবডেম কিছুটা পরিসংখ্যানের গ্রাফে এগুলেও সেটি ক্ষমতার নিয়ামক হবে না। বর্তমান পার্লামেন্টে ৫৪টি আসন নিয়ে স্বতন্ত্র স্বদেশের দাবীদার স্কটিশ ন্যাশন্যাল পার্টি আগামীতেও ফ্যাক্টর হিসেবে থাকবে ব্রিটেনের রাজনীতিতে।
বিশ্বজুড়ে উগ্র আর একাধিপত্ববাদী জাতীয়তাবাদের জোয়ারের বিপরীতে ব্রিটেনে কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম আছে। এখানে আগামী নির্বাচনে রাইট ব্লক বিজয়ী হবে কিন্তু ফার রাইটিষ্টরা নয়। অন্তত ইউকিপের মত বর্ণবিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত দলগুলোর যে ক্ষমতার নিয়ামক হতে পারছে না, উল্টো হারিয়ে যাচ্ছে; সেটি ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ভারসাম্যের বাহ্যিক সৌন্দর্য।
দুই
আগামী নির্বাচন ব্রিটেনের জন্য কেন দরকার, এ প্রশ্নের উত্তর খুজঁবার আগে একটি কথা বলে নিই। থেরেসা মে ইজ ভেরি স্পেসিফিক এন্ড ইউনিক এজ অ্যা লীডার। অনেকে তাঁকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের অনমনীয় চরিত্রের সাথে তুলনা করতে ভালবাসেন। আগামী নির্বাচনেও জয়ের পথ বেয়ে থেরেসা মের সরকার ব্রেক্সিট সংহতভাবে বাস্তবায়ন করবে। জনগণের পুনঃরায় সরকারকে সার্বিক বিচারে আরো শক্তি যোগাবে। লেবারের ঐতিহাসিক পরাজয়ে কনজারভেটিভ পাবে আলটিমেট এন্ড এবসলিউট পাওয়ার।
তিন
এ লেখার পাঠকদের কথা মাথায় রেখেই কিছু শব্দের বাংলা অনুবাদে সচেতনভাবেই যাইনি আমি। এ লেখা নিবেদিত বিলেত প্রবাসী আমাদের পাঠকদের জন্য। যাহোক, এবার যেতে হবে লেখার মূল উপজীব্যে। কেননা, এ বিষয়টি এখনো ব্রিটেনের কোন ধারার মিডিয়াতে আলোচনায় আসছে না। যেটি আমি অনুভব করি, ব্রিটেনে এখন ব্রেক্সিটই একমাত্র সংকট নয় কিন্তু। ৮০০ বছর ধরে দেশটি লিখিত সংবিধান ছাড়া চলছে। কিন্তু, জেনোফোবিয়া বা প্রবাসীদের প্রতি বিদ্বেষ, বর্ডার, নাগরিক অধিকার বা প্রতিরক্ষায় জনগণের জবাবদিহিতার প্রশ্নে লিখিত সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়ছে। আর বিশেষত ব্রেক্সিট চুড়ান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, তৎপরবর্তী প্রতিবেশী আর সীমান্ত সমস্যার সমাধান, সার্বিক বাস্তবতায়
সাংবিধানিক উদ্যোগ এসবের জন্য দরকার সর্বতভাবে শক্তিশালী সরকার। সঙ্গত কারণে, আসন্ন আকস্মিকতাময় এ নির্বাচন শুধু ব্রেক্সিট কেন্দ্রীক নয়, এখানে অনেকগুলো সামাজিক, ভূ-রাজনৈতিক এবং মনোস্তাত্বিক ইস্যু অ-নিস্পন্ন।
আসছে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনরায়ের পথ বেয়ে সরকার আসলে সাংবিধানিক সংস্কারের রুদ্ধ দুয়ারটিই উন্মুক্ত করতে চায়। আমি বিশ্বাস করি, ব্রেক্সিটের কিছুদিন পরই আমরা সিটিজেন এসেম্বলী কনসালটেশনের আলোচনা শুনতে পাব। আমাদের তিন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপির অন্তত দুজন ফের জিতে আসবেন বিলেতের পার্লামেন্টে এ আশা করাই যায়।
চার
ভোটের গণতন্ত্রের একটা মানে দাড়ায় ৫১ শতাংশের জয়ের বিপরীতে ৪৯ শতাংশ জনগণের নীতিবদ্ধ পরাজয়। কুট-কৌশলের খেলা দেশে দেশে রাজনীতির অন্দরমহলের যাপিত সৌন্দর্য। কিন্তু শেষ বিচারে ব্রিটেনে বহমান গণতন্ত্রেরই জয় হয়। এ নির্বাচনে বাংলাদেশের জন্য উদাহরণীয় বিষয়টি অনুল্লেখ করলে লেখাটি অসমাপ্তই থেকে যাবে। ৮ জুন অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনের জন্য কিন্তু ব্রিটেনে একজন ব্যক্তিকেও মাঠে নামতে হয়নি। নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনও করতে হয়নি। শুধু কয়েকটি বিবৃতির আহ্বান এসেছিল, তাতেই সাড়া দিয়ে নির্বাচনের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী।
লন্ডন মে ২০, ২০১৭
লৈখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক, সদস্য- রাইটার্স গীল্ড অফ গ্রেট ব্রিটেন।