ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

৯ ডিসেম্বর : সাঁথিয়া ও দাউদকান্দি মুক্ত দিবস

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৫৭ এএম, ৯ ডিসেম্বর ২০২০ বুধবার

আজ ৯ ডিসেম্বর। পাবনার সাঁথিয়া ও কুমিল্লার দাউদকান্দি মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে এ দুই এলাকা মুক্ত হয়েছিল। ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে সে দিন এ অঞ্চলসমূহকে মুখরিত করেছিলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা।

এদিনে আরও শত্রুমুক্ত হয় খুলনার ঐতিহ্যবাহী কপিলমুনি, পাইকগাছা, কুমারখালী, নকলা, অভয়নগর, ত্রিশাল, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ, নেত্রকোনা, গাজীপুরের শ্রীপুর, পূর্বধলাসহ বিভিন্ন এলাকা।

সাঁথিয়া
১৯৭১ সালের এই দিনে সাঁথিয়া হানাদার মুক্ত হয়। এদিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদরদের পরাজিত করে সাঁথিয়ায় স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ পতাকা উড়ান বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক আবু সাইয়িদ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। তার নির্দেশে সাঁথিয়া হাই স্কুলের তৎকালীন শিক্ষক রুস্তম আলী, তোফাজ্জল হোসেন, কাশীনাথপুর হাইস্কুলের শিক্ষক আয়েজ উদ্দিন সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এলাকার ছাত্র সমাজ ও তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেন। যুদ্ধ অনিবার্য এটা বুঝতের পেরে সাঁথিয়া হাইস্কুল মাঠে তারা প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। সেনাসদস্য কাজী মোসলেম উদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। ওই বছর মার্চে পশু হাসপাতাল প্রাঙ্গনে যুদ্ধকালীন কমান্ডার নিজাম উদ্দিন, রাবি’র ছাত্র নেতা ফজলুল হক, মকবুল হোসেন মুকুল, লোকমান হোসেন, রেজাউল করিম, আলতাব হোসেন, আবু মুসা, আবু হানিফ, মোসলেম উদ্দিন, তোফাজ্জল হোসেন, আব্দুল ওহাব, সোহরাব, রউফ, মতিনসহ যুব তরুণ’রা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

দীর্ঘ ৯ মাস সাঁথিয়ার বিভিন্ন স্থানে পাকসেনাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে বীরমুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক, নজরুল ইসলাম (চাদু), আব্দুস সামাদ, দারা হোসেন, শাহজাহান আলীসহ অসংখ্য নিরীহ মানুষ শহীদ হন।

সাঁথিয়ার সংগ্রামী জনতা ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সাঁথিয়া থানা আক্রমণ করে অস্ত্র লুট করে নেয় এবং পশু হাসপাতাল চত্বরে আমগাছ তলায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। ১৯ এপ্রিল সাঁথিয়ার পাইকরহাটির ডাব বাগন (শহীদ নগর) যুদ্ধে পাক বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয় মুক্তিযোদ্ধা, পুলিশ ও বিডিআর। ওই যুদ্ধে ২০জন মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় দু’শ নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন।

২৬ সেপ্টেম্বর সাঁথিয়ার মুক্তিযোদ্ধারা সাঁথিয়া হাইস্কুলে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে ৯ জন রাজাকারকে হত্যা করে এবং অনেক অস্ত্র উদ্ধার করে। সাঁথিয়ার গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হয় ৯ নভেম্বর, পার্শ্ববর্তী ফরিদপুর উপজেলার কালিয়ানী গ্রামে। ওই যুদ্ধে সাঁথিয়ার ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সাঁথিয়ায় সবচেয়ে নারকীয় ও বেদনাদায়ক হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় ২৭ নভেম্বর ধুলাউড়ীতে। ওই দিন পাকসেনারা বাড়ি-ঘর জ্বালানো ছাড়াও রাতের অন্ধকারে পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় ১০০ জন গ্রামবাসীকে পুড়িয়ে, গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

ডিসেম্বরের ৭ তারিখে মুক্তিযোদ্ধারা সাঁথিয়ায় প্রবেশের তিনটি ব্রিজ ও কালভার্ট বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। যাতে পাক সেনারা গাড়িবহর নিয়ে সাঁথিয়ায় প্রবেশ করতে না পারে।

অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজের নিচে বাঙ্কার তৈরি করে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে চরম প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক আক্রমণে পাক সেনারা ক্ষতিগ্রস্ত দুটি গাড়ি ফেলে পিছু হটে ।

৮ ডিসেম্বর সাঁথিয়ার সব মুক্তিযোদ্ধা থানা সদর থেকে ২ কি. মি. পশ্চিমে নন্দনপুরে পাক হানাদারদের সঙ্গে চূড়ান্ত যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরদিন ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে পাকহানাদার বাহিনীদের আক্রমণের চেষ্টা চালালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র বাধার মুখে পড়ে। ৯ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা সাঁথিয়া থানাকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা দেন।

দাউদকান্দি
একাত্তরের এই দিনে যেসব অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয় সেগুলোর অন্যতম ছিল দাউদকান্দি। দাউদকান্দি জয়ের মধ্য দিয়ে একাত্তরের ৯ ডিসেম্বর মেঘনার পুরো পূর্বাঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। 

একাত্তরের এ সময়টায় দ্রুত পাল্টে যাওয়া দৃশ্যপট এটাই স্পষ্ট করে দেয় যে, খুব শিগগিরই অবসান হতে যাচ্ছে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পিছু হটার মধ্য দিয়ে প্রতিদিনই তখন দেশের একাধিক এলাকা শত্রুমুক্ত হচ্ছিল। তবে এর মধ্যেই মুক্তিপাগল অকুতোভয় বাংলার দামাল ছেলেদের মনোবল ভেঙে দিতে পাকিস্তান আর তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  ষড়যন্ত্র করছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন যুদ্ধের শেষ সময়ে এসে পাকিস্তানকে সহযোগিতার পদক্ষেপ নেন।

একাত্তরের এ দিনে সপ্তম নৌবহরকে তিনি বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি ভেবেছিলেন এর মাধ্যমে অন্তত বাঙালির মনোবল ভেঙে দেয়া যাবে। কিন্তু সে ধারণা সঠিক হয়নি। রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা পলিমাটির সন্তানদের দৃঢ় মনোবল তো আর এত সহজে ভেঙে দেয়া যায় না!

৯ ডিসেম্বর কপিলমুনির মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আনন্দের দিন। এদিনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় সুনিশ্চিত হতে থাকলে হানাদার পাকসেনারা বিভিন্ন স্থান থেকে পিছু হটে। 

এদিন কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বেলা ১১টায় শহরের চারদিক ঘিরে ফেললে পৌর এলাকার কুণ্ডুপাড়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর দেশীয় সহযোগী আল-বদর কমান্ডার ফিরোজ বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয়। এ সংবাদে জেলা শহরে অবস্থানরত পাকসেনারা দ্রুত এসে শহর ঘিরে শুরু করে গণহত্যা। ৯ ডিসেম্বর পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা শহর ঘিরে রাজাকার-পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালালে তারা পালিয়ে যায়। ৪ থেকে ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্ত হয় গাইবান্ধার সব থানা।

১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর ১১নং সাব-সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার আবদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে টুআইসি আবদুর রশীদ ও সিকিউরিটি অফিসার একলিম শাহসহ ১৫০ বীর মুক্তিযোদ্ধা নকলাকে পাকহানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করেন। এরপর তারা স্থানীয় নকলা পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।

এদিন মুক্ত হয় তিতাস। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিতাসের বাতাকান্দি এবং কড়িকান্দিতে মুখোমুখি যুদ্ধে ৩৫ পাকসেনা নিহত হয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে পাক হানাদারদের হটিয়ে অভয়নগরকে শত্রুমুক্ত করেন।
এসএ/