ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১৮ ১৪৩১

মাছ ধরা উৎসব

আ নো য়া র  কা জ ল 

প্রকাশিত : ০৩:৫২ পিএম, ৯ ডিসেম্বর ২০২০ বুধবার | আপডেট: ০৩:৫৩ পিএম, ৯ ডিসেম্বর ২০২০ বুধবার

মাছে-ভাতে বাঙালির জীবন, সেই মাছ যখন হারিয়ে যাচ্ছে তখন দেশের খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওরে মাছ ধরার উৎসবের কথা অনেকটাই রূপকথার গল্পের মতো। গ্রাম বাংলার জনপদে নানাভাবে মাছ ধরার  পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। যা আবহমান বাংলার দীর্ঘদিনের লালিত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের স্মারক বহন করে। কিন্তু এ সংস্কৃতি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।

বাড়িতে মেহমান এলেই পার্শ্ববর্তী পুকুরে জাল ফেলে কয়টা মাছ তুলে রান্না করা হতো। আবার শখ করে দল বেঁধে জলাধারে ঠেলা জাল বা মই জাল দিয়ে কিংবা টানা জাল দিয়েও মাছ ধরা হতো। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে উপচে উঠা প্লাবনে পুকুর-ডোবা ডুবে যায়, ঠিক তখনই মাছ চলে যেতো মাঠে-ঘাটে। আর তখন রুই, কাতল, মৃগেল, বোয়াল বা হরেক রকম মাছ ধরতে সবাই ঘরের মজুত থাকা জাল নিয়ে নেমে পড়তো। তখন মাছ ধরার একরকম উৎসব লেগে যেত। 

স্বতঃফূর্ত উৎসব 
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বিল অভিমুখে মানুষের ঢল। কারও কাঁধে পলো, আবার কারও হাতে ঠেলা জাল, খুইরা জাল, বাদাই জালসহ মাছ ধরার নানা উপকরণ। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ জড়ো হচ্ছে এক স্থানে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সববয়সী মানুষের উপস্থিতিতে নদী-খাল, হাওর-বাওর ও বিলপাড়ে তৈরি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। 

প্রধানত পলো, উড়াজাল, টেলাজালসহ নানা ধরনের জাল ও মাছ ধরার নানা উপকরণ নিয়ে মাছ ধরায় নেমে পরে গাঁয়ের শত-শত ছেলে, বুড়ো, যুবক। সাথে থাকে খলুই হাতে ছোট্ট শিশুরাও। অনেকে আবার ছিটকির সারির পেছনে পেছনে টেলা জাল হাতে নিয়ে নেমে পড়ে। যার ছিটকি বা টেলা জাল কিছুই নেই সেও নেমে পড়ে খালি হাতে। সে সময়ে দেখা হয় বিভিন্ন গ্রামের মানুষের সঙ্গে। চলে একে-অপরের সঙ্গে কুশল বিনিময় আর হাসি-ঠাট্টা। এভাবেই প্রতিবছর শুরু হয় আবহমান বাংলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মাছ ধরার উৎসব।

এ উৎসবে মেতে উঠে নানা বয়সের মানুষ। দল বেঁধে হাজারো মানুষ বিলে নামে মাছ ধরতে। সবার চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক। কেউ পলোতে বোয়াল ধরে আবার কেউ বা জালে চিতল। এ যেন হারিয়ে যাওয়া এক মিলনমেলা।

উৎসবের সময়
প্রতিবছর শীত মওসুমে নদী, খাল, বিল ও হাওরের পানি কমতে শুরু করলে গ্রামের মুরব্বিদের পরামর্শক্রমে মাছ শিকারের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারিত দিনে কয়েক হাজার লোক পলো, বিভিন্ন জাল, দঁড়িসহ মাছ শিকারের বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে দলবদ্ধ হয়ে হাজির হয়। মাছ শিকারের দিন আশপাশের গ্রামগুলোতে বিরাজ করে উৎসবমূখর পরিবেশ। এই উৎসবে প্রায় হাজার হাজার সৌখিন মৎস্য শিকারী কয়েক লাখ টাকার মাছ শিকার করেন। মাছ ধরা পড়ার সাথে সাথে তাদের আনন্দে শরীক হন পাশের লোকজনও।

মাছ ধরার নান্দনিক পদ্ধতি ‘পলো’
মাছধরা উৎসবের অন্যতম নান্দনিক পদ্ধতি হলো পলো বা বাওয়া। এটি আবহমান বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের অংশ। বাঁশ দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি ঝাঁপিকেই বলা হয় পলো। শুষ্ক মৌসুম এলেই শৌখিন মাছ শিকারিরা পলো নিয়ে নদী নালার পানিতে দলবেঁধে নেমে পড়তেন। উৎসবমুখর পরিবেশে তারা শিকার করতো ছোট বড় অনেক মাছ। প্রতি বছর আশ্বিন মাস থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত চলে এই পলো বাওয়া উৎসব। তবে দখল, দুষণ ও ভরাটসহ নদীর অস্তিত্ব সংকটের কারণে এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না গ্রামীণ ঐতিহ্যের এই পলো উৎসব। 

পলো দিয়ে পানিতে একের পর এক ঝাপ দেওয়া আর হৈহুল্লোর করে সামনের দিকে ছন্দের তালে তালে এগিয়ে যাওয়া চিরচেনা গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্যময় এক দৃশ্য। মাছ শিকার উৎসবে পলো ছাড়াও ফার জাল, ছিটকি জাল, ঝাকি জাল, পেলুন ইত্যাদি দিয়েও মাছ শিকার করেন অনেকে। তবে পলো সহ দেশীয় উপকরণ দিয়ে মাছ শিকার করলে যেমন খরচ কম, তেমনি মাছের বংশ বিনাশ হয় না। মাছ শিকারের জন্য পলোর ব্যবহার হয়ে আসছে বহু কাল আগে থেকে। বাঁশের তৈরি এই পলো মাছ শিকারসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেন কৃষকরা।

পলো উৎসব যেসব এলাকায় জনপ্রিয়
সিলেটের বানিয়াচং, বিশ্বনাথ, রাজবাড়ির গোয়ালন্দ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, মাগুরা, ঝিনাইদহসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পলো উৎসব বেশ জনপ্রিয়। সিলেটের বিশ্বনাথের গোয়াহরি গ্রামের পশ্চিমের দরং বিলকে ঘিরে দুইশ’ বছরের পুরনো এই ঐতিহ্য আজও লালন করছেন গোয়াহরিসহ আশপাশ এলাকার বাসিন্দারা। সেই আদিকাল থেকেই ‘বড় বিলে’ বছরের পহেলা মাঘ ‘পলো বাওয়া’ উৎসব পালন করেন বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের গোয়াহরি গ্রামবাসী। 

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার মরা পদ্মা নদীর বিশাল জলাশয়েও পলো দিয়ে মাছ ধরার উৎসবে মেতে ওঠে শত শত সৌখিন মৎস্য শিকারি। গোয়ালন্দে মিঠা পানির মৎস্য ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত এ মরা পদ্মায় দীর্ঘদিন ধরে শীতের শেষে শুরু হয়ে গ্রীষ্মের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পালাক্রমে এভাবে মাছ ধরা হয় বহুকাল ধরে। 

উৎসবে ধরা পরে রকমারি মাছ
পুরো শীত মৌসুমেই গ্রামগঞ্জে মাছ ধরার এই চিত্র চোখে পড়ে। আর মাছ ধরায় সামিল হতে পেরে শিশু-কিশোরদের আনন্দ আর আনন্দ। কাদা-পানিতে সারা শরীর মাখামাখি করে তারা মাছ ধরার আনন্দে বিভোর থাকে। জাল ফেলে কই, মাগুর, পুটি, শিং, চিংড়ি, পুঁটি মাছসহ হরেক রকম মাছ ধরা হয়। কৈ, শিং, মাগুর প্রভৃতি দেশি জাতের জিয়ল মাছই ধরা পড়ে বেশি। তাছাড়া টেংরা, খইলসা, শোল, টাকি, বোয়াল, চিকরা, বাইন, কাতলা, সিলভার কার্প প্রভৃতি মাছ তো রয়েছেই। 

বর্ষাকালে ফিশারিসহ বিভিন্ন জলমহলের মাছ ভেসে গিয়ে ডোবা-পুকুর, খাল-বিল এবং নিচু জমিতে আশ্রয় নেয়। পরে শুকনো মওসুমে সেই সব মাছ ধরা পড়ে। সারাদিনের কাদা-পানিমাখা মানুষটিকে চেনাই দায় হয়ে পড়ে। এ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে পরিচিতজনদের মাঝে আর বাড়ি ফিরে নারী-মহলে চলে হাসি-ঠাট্টা আর রসিকতা। এভাবেই শেষ হয় দিনব্যাপী মাছ ধরা উৎসব।

সংকটের কারণ
দিনে দিনে ভরাট হয়ে যাচ্ছে পুকুর-ডোবা থেকে শুরু করে খাল, নদীসহ সব জলাশয়। মাছের চলাচলের ব্যবস্থা না রেখেই তৈরি করা হয় অপরিকল্পিত বাঁধ, রাস্তাঘাট। একদিকে যেমন মাছের প্রাকৃতিক আবাসের বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করেছে অন্যদিকে বিলের মত জলাশয়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছ চাষ বর্তমানে প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছের বৈচিত্রকে করছে কোণঠাসা। এদিকে মৎস্য বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে দেশীয় মাছের উৎপাদন ক্রমেই নিম্নমুখী হচ্ছে এবং দেশি মাছের প্রজাতি দিন দিন কমে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে যত প্রজাতির মিঠা পানির মাছ আছে, তার অর্ধেক কমে গেছে। প্রতিবছর ৯ শতাংশ হারে মিঠা পানির মাছ এখন কমে যাচ্ছে। কমার এই হার যদি অব্যাহত থাকে তবে আগামী ৫০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে মুক্ত জলাশয়ে দেশীয় প্রজাতির মাছ বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ১২০ প্রজাতির দেশীয় মাছ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে বর্তমানে ২৯৬ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এর মধ্যে মুক্ত জলাশয়ে রয়েছে ২৬০ প্রজাতির মাছ। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার বা আইইউসিএন বলছে, বাংলাদেশে মোট ৫৪ প্রজাতির দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ১২ প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব চরম হুমকিতে, ২৮ প্রজাতির মাছ বিপন্ন তালিকায় আর ১৪ প্রজাতির মাছের অবস্থা সংকটাপন্ন।

দিন দিন ছোট হয়ে আসছে খাল-বিল, নদী, হাওড়-বাওড়ের মাছের অভয়াশ্রম। প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে এসব জলাশয়। 

সার্বিক পরিস্থিতিতে বিলে মাছ ধরা উৎসব অনেকের কাছেই মাছের জীববৈচিত্রের জন্য একটি হুমকি স্বরূপও মনে হতে পারে। কিন্তু বাপ-দাদার সময় থেকে চলে আসা এই উৎসব নিশ্চিতভাবেই ততোদিন চলবে যতোদিন মাছ প্রাপ্তির খাতা শূন্য না হবে। দল বেঁধে মাছ ধরলে বিলে মাছের সঙ্গে অন্য উপকারী জীবও যেনো মারা না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে মাছ ধরার উৎসবকে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়ে তা টিকিয়ে রাখতে হবে।
এএইচ/এসএ/