‘দাদা, যুদ্ধ কুন্দিন শ্যাষ হবো’
এম এম মেহেরুল
প্রকাশিত : ১১:০৬ পিএম, ১০ ডিসেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার
“প্রিয় এলাকাবাসী, আসসালামু আলাইকুম। মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা নিবেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করে এই মাসেই আমরা বিজয়ের স্বাদ পেয়েছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় আবারও জনগণের বিজয়, গণতন্ত্রের বিজয়কে সমুন্নত রাখতে আসছে আগামী ৫ জানুয়ারি, ২০২১ হলিপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আপনাদের সকলের সুপরিচিত, জনগণের বন্ধু, গরীবের একমাত্র ভরসা, বিখ্যাত দ্বীনি আলেম হজরত মাওলানা মোহাম্মদ মামুনুল সাহেবকে পুন:রায় চেয়ারম্যান পদে তাল গাছ মার্কায় ভোট দিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার তথা ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা ও গণমানুষের সেবা করার সুযোগ দিন।"
গত পাঁচ দিন হলো- এমনই নানান ধরনের প্রচার প্রচারণায় মুখর হলিপুরের গোটা এলাকা। চারিদিকে মাইকের প্রচার, রাস্তাঘাট চায়ের দোকানে বড় বড় ছবিযুক্ত পোষ্টারে সয়লাব। দিন যতো গড়াচ্ছে ভোটারদের বাড়িতে ভোট প্রার্থীদের আনাগোনা ঠিক দিগুণ থেকে চারগুণ হচ্ছে। সকালে একদল আসে তো, বিকালে আরেক দল। আবার মধ্যরাতেও কেউ কেউ কাঁচাঘুম থেকে উঠিয়ে পকেটে কিছু একটা গুঁজে দিয়ে দোয়া চায়।
শত বিরক্তি নিয়ে নিরুপায় কছিম মোল্লাও দোয়া দিতে বাধ্য হয় একপ্রকার। কি করবে কছিম মোল্লা? দোয়া না দিলে নির্ঘাত সেই ভোট প্রার্থী তাকে আরেকজনের সমর্থক কিংবা দালাল পর্যন্ত ভাবতে পারে। শুধু কি ভাবা পর্যন্তই শেষ?
না! নির্ঘাত ভোটের শেষে জুলুম নেমে আসবে তার নিজের ও পরিবারের ওপর। কছিম মোল্লা সেই ভয়ে ভোট এলেই অস্থির থাকে। কেননা বিগত কয়েক দশকে তাকে এমন নির্যাতন কম সহ্য করতে হয়নি। একবার তো ভোট কেন্দ্রে আনারস মার্কায় সীল দেয়ায় মামুনুল কেন্দ্রেই সবার সামনে তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে ব্যালট পেপার ছিড়ে কুটিকুটি করেছিলো। সেই সঙ্গে কিল-ঘুষি চলছিলো সমান তালে।
রাগে মুখ কিড়মিড় করে বলেছিলো– "শালা দ্যাশ প্রেম চোদাও, দ্যাশ প্রেম তোমার হোগার মদ্দি দিমু শালা চুতমারানির পো। তুই আমারে ভোট না দিয়া তোর আরেক বাপরে ভোট দ্যাছ; বান্দির পুত।“
স্থানীয় প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ সেদিন একটা প্রতিবাদও করেনি। সবাই শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে। গত কয়েক দশকে এই মামুনুল ফুলে ফেঁপে যে পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে তার রিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস এই তল্লাটে কারও নেই। বলতে গেলে সবাই মামুনুলের দাপটের কাছে একপ্রকার জিম্মি। তাই সব অপমান সহ্য করে তাকে বাড়ির দিকে চলে আসতে হয়েছিলো সেদিন। আজও সেদিনের অপমানের কথা ভুলতে পারেনা সে।
শুধু কি সেই দিনের সেই অপমান? না, তা নয়। বরং সেই নির্বাচনে মামুনুল বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবার পর কছিম মোল্লাকে একপ্রকার একঘরে করে রেখেছে। একমাত্র নাতিকে স্কুলে ভর্তি করাবে। সে জন্য ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন্ম নিবন্ধনের কাগজ দরকার। আগ পাছ না ভেবেই কছিম মোল্লা ইউনিয়ন পরিষদে যায় জন্ম নিবন্ধনের কাগজ আনতে।
কিন্তু সেদিনও মামুনুল চেয়ারম্যান তাকে অপমান করেছে। বলেছে– “বান্দির পুত এখন আসোস ক্যা। তোর মায়ের ভাতারের কাছে যাইতে পারোস না। যারে সীল দিছিলি তাঁর কাছে যা।“
অনেক অনুনয় করেও চেয়ারম্যানের মন গলাতে পারেনি, সেইসঙ্গে জন্মনিবন্ধনের কাগজও পাওয়া হয়নি তাঁর। অগত্যা স্কুলের হেড মাস্টারকে বলে একমাত্র নাতিকে জন্মনিবন্ধনের কাগজ ছাড়াই ভর্তি করিয়ে রেখেছে।
হেড মাস্টার বলেছে– “আপনার নাতি কছিম সাহেব, ভর্তি না করে উপায় আছে বলুন। সে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আপনার ছেলে দেশের জন্য যা করে গেছে তাঁর এই ঋণ তো আমরা জীবন দিয়েও শোধ করতে পারবো না। আপনি কোনও চিন্তা করবেন না কছিম সাহেব। আপনার নাতির জন্মনিবন্ধনের কাগজ পরে দিলেও চলবে।“
আজ ছেলের কথা মনে করে নিথর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে হু হু করে বোবা কান্না কাঁদছে কছিম মোল্লা। আর ছবিতে থাকা ছেলেকে জিজ্ঞেস করছে – “ও বাপ, তুই কি আইবি না? আর কত অপেক্ষা করমু বাপ? এই অপমান যে আর সহ্য হয়না। তোর পোলায় এখন আমারে জিগায়, দাদা আমার বাপে কই গ্যাছে? আমি তারে কই, তোর বাপ যুদ্ধে গ্যাছে। হেই তখন জিগায়, দাদা যুদ্ধ কুন্দিন শ্যাষ হবো। আব্বায় কুন্দিন যুদ্ধ শ্যাষ কইরা আইবো?
আমি ওর মাথায় হাত দিয়া কই, যুদ্ধ শ্যাষ হইলেই তোর বাপে আইবো। কিন্তু আমি তো জানি বাপ, যুদ্ধ এখনও চলতাছে, যুদ্ধ শ্যাষ হয়নাই, যুদ্ধ শ্যাষ হইতে আরও মে...লা---- দেরি! এখনও এই দ্যাশে মামুনুল রাজাকারের বাচ্চারা ঘুইরা বেড়ায়। চেয়ারম্যান গিরি করে, ইলেকশান করে। আর আমাগো বান্দির পুত কইয়া গালি দেয়। সগলেই চুপচাপ থাকে। কেউ কিছু কয়না বাপ! আমি বুইড়া মানুষ তোর বউ পোলা লইয়া এই ভিটাবাড়ি পাহারা দিতাছি।
তোর বইন ছবি রে যেদিন মামুনুল রাজাকার মিলিটারিগো হাতে তুইলা দিছিলো, সেদিনও কেউ কিছু কয় নাই বাপ! আমি কতো চিল্লাইছি, এরে ওরে হাতে ধরছি, পায়ে ধরছি। কিন্তু সগলেই খাড়ায়া দেখছে। এই দ্যাশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ কিছু কয় না রে বাপ! সগলেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ভূইলা গ্যাছে। নইলে কি আর মামুনুল রাজাকারের বাচ্চারা ভোটে খাড়াইয়া বারবার চেয়ারম্যান হইতে পারে; ক?
যেই মামুনুল আসলামের বউয়ের ঘরে ঢুইকা ইজ্জত লুটছিলো, সেই এখন মক্কায় হজ্ব কইরা দ্বীনি আলেম হইছে। বিশাল প্যান্ডেলে মাইয়াগো ইজ্জ্বত রক্ষার বয়ান শুনায়। ক তো বাপ, তুই যুদ্ধ শ্যাষ কইরা কবে আইবি?”
আচমকা ঘোর কাটতেই পেছন থেকে কছিম মোল্লার নাতি হাত ধরে– “ও দাদা, চেয়ারম্যান আইছে তো। তোমারে ডাকে।“ কে আইছে? চেয়ারম্যান? একটু ভেবে কছিম মোল্লা নাতির হাত ধরে ঘরের বাইরে আসে। বারান্দার কোনায় মামুনুল চেয়ারম্যান দাঁড়িয়ে।
আসসালামু আলাইকুম কছিম ভাই, কেমুন আছো? ওয়ালাইকুম সালাম। জি ভালো আছি। (যে মামুনুল তাকে বান্দির পুত ছাড়া ডাকে না। আজ সে নিজেই তার বাড়িতে আসছে, তাকে সালাম দিচ্ছে। কছিম মোল্লা যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে)।
“কছিম ভাই সামনের ৫ তারিখে তো ইলেকশান। আমার মার্কাডা মনে আছেনি এবার? নাকি ভুইলা গ্যাছো। ভুইলা যাতে না যাইতে পারো তাই নিজেই মনে করাইয়া দিতে আইলাম। এইবার সীল মারতে যদি উলটাপালটা হয় তাইলে কিন্তু--------?”
কছিমের হাতে মামুনুলের ছবি আর তালগাছের ছবি সম্বলিত ছাপা সাদাকালো একটা পোষ্টার গুঁজে দিয়ে– “আসি তাহলে আসলামুলাইকুম, ভালো থাইকো কেমন।“
কছিম কোনও উত্তর দেয় না, শুধু মাথা নাড়ায় একটু। আসলে মুখের উপর “না” বলার শক্তি কছিমের নেই। কেবল মনের শক্তিতেই সে আজও বেঁচে আছে এই জন্য যে, কবে দেশ স্বাধীন হবে, কবে তাঁর ছেলে ফিরে এসে মামুনুল এর ঘাড় ধরে বলবে- “রাজাকারের বাচ্চা তুই আমার বাপরে বান্দির পুত কইয়া গালি দ্যাশ?“ সেই অপেক্ষায় দিন কাটে কছিম মোল্লার।
ওদিকে রাস্তা থেকে মাইকের আওয়াজ ভেসে আসে– "প্রিয় এলাকাবাসী, আসসালামু আলাইকুম। মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা নিবেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করে এই মাসেই আমরা বিজয়ের স্বাদ পেয়েছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় আবারও জনগণের বিজয়, গণতন্ত্রের বিজয়কে সমুন্নত রাখতে আসছে আগামী ৫ জানুয়ারি, ২০২১ হলিপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আপনাদের সকলের সুপরিচিত, জনগণের বন্ধু, গরীবের একমাত্র ভরসা, বিখ্যাত দ্বীনি আলেম হজরত মাওলানা মোহাম্মদ মামুনুল সাহেবকে পুন:রায় চেয়ারম্যান পদে তাল গাছ মার্কায় ভোট দিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা ও গণমানুষের সেবা করার সুযোগ দিন।"
কছিম মোল্লার নাতি মাইকের শব্দ শুনে দৌড়ে ছুটতে থাকে মাইক আটকানো ভ্যানের পেছন পেছন...!
লেখক- সাবেক চেয়ারম্যান, আলোর প্রদীপ
ই-মেইল- meharul.islam.1991@gmail.com
এনএস/