ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

সমস্ত ঘটনা এখনও আমার কাছে দুঃস্বপ্ন : জিনাত হাকিম

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:১০ এএম, ১২ ডিসেম্বর ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০৯:২২ এএম, ১২ ডিসেম্বর ২০২০ শনিবার

করোনায় আক্রান্ত হয়ে বেশকিছু দিন হাসপাতালে ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা আজিজুল হাকিম। সবার দোয়া ও চিকিৎসকদের সেবায় তিনি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে গেছেন। এখন তিনি বেশ ভালো আছেন। কিন্তু অসুস্থ থাকার সেই সময়ের জার্নিটা ছিল খুবই চিন্তার। যা নিজের ফেসবুকে প্রকাশ করে ভক্তদের উদ্দেশ্যে জানান দিলেন অভিনেতার স্ত্রী নির্মাতা জিনাত হাকিম।

তিনি লিখেছেন- 
‘১০ নভেম্বর ২০২০ তারিখে  আজিজুল হাকিমের করোনা শনাক্ত হলেও বিভিন্ন রিপোর্ট ভালো থাকায় ও স্বাস্থ্যগত সুস্থতার কারণে তাকে বাসায় নিয়ম মেনে চিকিৎসার পরামর্শ দিলেন (শ‍্যামলী) বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটালের চিকিৎসক ড. মহিউদ্দীন আহমেদ। তবে তিনি এটাও বলেন, ‘কভিড ভীষণ আনপ্রেডিক্টেবল’। তাই সাবধান ও সচেতন থেকে পরামর্শ মেনে চলতে হবে।

পরামর্শের মধ্যে ছিল অক্সিমিটারে অক্সিজেন স্যাচুরেশন এর মাত্রায় লক্ষ্য রাখা। সেই সাথে নতুন কোন উপসর্গ হলে ডাক্তারকে জানানো, ইমিউনিটি ঠিক রাখতে পর্যাপ্ত প্রোটিন ও তরল খাবার সহ সব  ধরনের খাবার খাওয়া। ভীত না হওয়া। হালকা ব্যায়াম করা ইত্যাদি।
 
১১ তারিখে আজিজুল হাকিমের জ্বর আসায় চিকিৎসক তার আরও কিছু শারীরিক পরিক্ষা করেন ও রাত আটটায় একজামিনের রেজাল্টে অস্বাভাবিক মাত্রার (CRP-C reactive Protein) কারণে  সিটিস্ক্যান করার পরামর্শ দেন। ১১ তারিখ রাত সাড়ে এগারোটায় হাকিম এর সিটিস্ক্যান হয় ও  রিপোর্ট  ভালো থাকায় রাত একটার দিকে দুজন নিশ্চিন্ত হয়ে বাসায় এলাম। মানসিক শান্তির জন্য আমি সমস্ত রিপোর্ট এমেরিকায় অবস্থানরত হাকিমের বন্ধু ও ছোট বোনের দেবর বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সেজান মাহমুধের কাছে হোয়াটসআপের মাধ‍্যমে পাঠাই। ও  সব রিপোর্ট দেখে আশ্বস্ত করে এবং ড.  মহিউদ্দিন আহমেদ এর পরামর্শ মত চলতে বলে।
  
১২ তারিখ ভোর পাঁচটায় আজিজুল হাকিমের কেঁপে কেঁপে জ্বর আসে ও হঠাৎ বমি শুরু হয়। আমার বোনের ছেলে স্পেশালাইজড হসপিটালের ডাক্তার, যে সারাক্ষণ হাকিমের সাথেই ছিল। ও যোগাযোগ  রাখছিল ওর স্যার অর্থাৎ ডাক্তার মহিউদ্দিন আহমেদের সাথে। ড. জামিলের সাথে সকালে ফোনে কথা বলে হাকিমকে ওষুধ দেই। জ্বর ও বমি কমে যায়। কিন্তু  দুর্বলতা অনুভব করে, গ্যাসের সমস্যা হয়। বিকেল থেকে কাশি হয় ও নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সন্ধ্যায় জরুরী ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে আজিজুল হাকিমকে হসপিটালে এডমিশন দেয়া হয়। 

‘কভিড ভীষণ আনপ্রেডিক্টেবল’- এই কথাটা যেন সত্যি হয়ে হঠাৎ সুনামি ঘটিয়ে দিল হাকিমের শরীরে। তারপরের ঘটনা- ড. মহিউদ্দিন আহমেদ এর দ্রুত ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে চিকিৎসা চলতে থাকা, পাশাপাশি বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে হাকিমের লাইফ সাপোর্টে যাবার খবর প্রচারে সারা পৃথিবীর বাংলাদেশী যারা আজিজুল হাকিমকে চেনেন, টিভিতে দেখেছেন তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা- দোয়া- চোখের পানি, সহকর্মী-আত্মীয়-বন্ধু-স্বজন-ভক্ত-সাংবাদিক-সুহৃদ-চেনা-অচেনা সকলের দু হাতের মুনাজাতে দোয়া-হাকিমের জন্য ঘরে ঘরে, মসজিদে মসজিদে দোয়া করেন সবাই। আমাদের  অজানায়, জানায় কাবা শরীফে কোরান খতম-উমরাহ হজ্ব করে দেয়া হয় তার নামে। ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই তাহাজ্জুতের নামাজ পড়েন। এতিম খাওয়ানো, উপাসনালয়ে প্রার্থনা করা হয়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমীন কবুল করেন সবার দোয়া। তার রহমতে প্রাণ ভিক্ষা দেন আজিজুল হাকিমের। সকলের দোয়ার বরকতে আল্লাহর অশেষ রহমতের বর্ষণ। এটা এক অলৌকিক নজীর আমার কাছে। 

বোন ড. নায়লা আজিজ মিতা আপা আছেন অস্ট্রেলিয়া। প্রতি মুহুর্তে হাকিমের শারীরিক অবস্থা নিয়ে তার শঙ্কা ও দোয়ার পাশাপাশি বড় আপা রীতা আপার মাধ‍্যমে কাবা শরীফে আমাদের জন্য উমরাহ হজ্ব ও কোরআন খতমের ব‍্যবস্থা করেন। মিতা আপা আমার শারীরিক মানসিক সুস্থতার খবর নিয়েছেন। আমার সুস্থতা নিশ্চিত করতে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। 

ড. আবিদ হোসেন মোল্লা আমার বড় ভাই তূল‍্য। হাকিমের পাশাপাশি মুহাইমিনের স্বাস্থ্য বিষয়ে সারাক্ষণ তার পরামর্শ মেনে চলেছি। আসাদুজ্জামান নূর ভাই ও মামুন উর রশীদ ভাই নিয়মিত আমাকে হাকিমের শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে নিশ্চিত করেছেন। হাকিমের সব সহকর্মী তাদের প্রিয় ভাইয়ের জন‍্য উদ্বিগ্ন ছিল প্রতি মুহুর্তে। কান্নায় তারা তাদের ভাইয়ের সুস্থতা চেয়েছেন। সব প্রজন্মের ও সব ক্ষেত্রের শিল্পীরা দোয়া করেছেন।

ফেরেশতা তূল‍্য কিছু মানুষকে যেন আল্লাহ্সে ই সময় আমার পাশে এনে দিয়েছেন যাদের নাম বলেও আমি আমার কৃতজ্ঞতার এক বিন্দু প্রকাশ করতে পারবো না। আমার বোন জলি, বরপা জুই আপা, মিলন ভাই, ড.রবিন, সাকি পাখী, নাফিস, আহাদ ভাই, রেজাউল আলম ভাই, লিয়াকত ভাই, সুলতান ভাই, হাসান ভাই, সেলিম  ভাই, রাহি ভাবী, কাঁকন, বেলাল ভাই, ড.রুবাইয়াত ভাই, অলিক, নাসিম, চয়নিকা, হাকিমের ছোট ভাই সোহেল যেন আমার পাশে ছায়া হয়ে ছিলেন। মানসিক ভাবে তারা আমাকে ক্রমাগত প্রশান্তির ছায়ায় রেখেছেন। কত কত শুভাকাঙ্খী যে ফোনে খোঁজ নিয়ে সান্ত্বনা  দিয়েছেন! হাকিমের মা তূল‍্য বড় বোন রানী আপার আকুল কান্না আর দোয়া আল্লাহ্ক বুল করেছেন। আমাদের  পরিবারের অন‍্যান‍্য ভাই বোনদের সবার কথা বলে শেষ হবে না। একমাত্র ছোট ভাইটা আমার ভাই না, ও আমার বাবার মতই আমার সব বিপদে আপদে আর আনন্দ দিনেও সেই ছোট বেলা থেকেই। তেমনই  হাকিমের জানের টুকরো ছোট বোন পাপড়ি। তার দেশ থেকে দূরে থাকবার কারণে তার উৎকণ্ঠার শেষ ছিল না। কানে এখনো বাজে ফোনে আমার বন্ধু রিপার কান্নাজড়িত কন্ঠে বাংলা অর্থসহ মধুর কোরআন তেলাওয়াত যা আমাকে আত্মার শান্তি দিয়েছিল। দিয়েছিল ধৈর্য্য ধারণের এক আশ্চর্য  ক্ষমতা! হাকিম ওর কাছে নিজের বড় ভাই। শুভর বাবা ও মা অর্থাৎ আমার খোকন ভাই ও শাহীনা আপা যে কি উদার ও অসাধারণ  সুন্দর ও মানবিক তা নতুন করে উপলব্ধি করলাম।

কোনো  ভাষায় ব্যাখ্যা করে মহান সৃষ্টি কর্তার প্রতি ও সকলের কাছে আমার শুকরিয়া, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারবো না এই জীবনে। জ্ঞান ফিরবার পর  সকলের দোয়া, ভালোবাসা- সম্মান- শ্রদ্ধার কথা জেনে হাকিম অঝোরে কেঁদেছে। 

কভিডের চিকিৎসা শেষে সুস্থ শরীরে ২৫ নভেম্বর আমার বাচ্চারা বাবার বাসায় ফিরে আসার আনন্দে আত্মহারা হলেও নাযাহ বারবার বলছে মা বাবার পাশের বেডের আন্টি মারা গেছেন। খুব খারাপ লাগছে।

আজ কত কত পরিবার আপনজন হারা। আল্লাহ আপনি আমাদের সকলকে করোনা মহামারীর হাত থেকে রেহাই দিন। বিশুদ্ধ পৃথিবীতে বুক ভরে শ্বাস নেবার ব্যবস্থা করে দিন। আর কারো যেন অক্সিজেনের অভাবে লাইফ সাপোর্টে যেতে না হয়। সব অসুস্থ মানুষগুলোর কষ্ট দূর করে আপনি আমাদের সহায় হোন মালিক। সকল অপরাধ ক্ষমা করে মহামারি থেকে মুক্ত করে আমাদের স্বাভাবিক সুন্দর জীবন ফিরিয়ে দেন প্রভু। আমীন।

গত ৯ ডিসেম্বর ফলোআপ এর জন্য গিয়েছিলেন হাকিম। ডাক্তারের ভাষ্যে আজিজুল হাকিম আগের আজিজুল হাকিম আছেন। সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। আলহামদুলিল্লাহ্।

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটালে আজিজুল হাকিমের চিকিৎসা সেবায় ডাক্তার মহিউদ্দিন আহমেদ ভাই সহ তার টিমের যারা ছিলেন তাদের কারো মুখ আমি চিনি না। কারণ সবার শরীরে-মুখে ছিল কঠিন নিরাপত্তার বেষ্টনী। আল্লাহর উপর ভরসা করে আমি ও আমার পরিবার যাদের দিকে লাইফ সাপোর্টে দেবার সময় অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম তাদের চোখেও উৎকণ্ঠা দেখেছিলাম- কিন্তু সব আমার কাছে ছিল ঝাপসা। সুস্থ হবার পর ডিসচার্জের দিন দেখেছিলাম হাসির ঝলক। সেটাও ছিল আধা-আঁধি। করোনার ক্রান্তি শেষে সুদিন এলে আমি ডাক্তার মহিউদ্দিন আহমেদ ভাই সহ তার টিমের  সবাইকে দেখবো-ইনশাআল্লাহ।

জমে থাকা অনেক অনেক কথা বলার সঠিক ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। কারণ সমস্ত ঘটনা এখনও আমার কাছে দুঃস্বপ্ন- ঘোরের মত। তবুও আমার বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ আছে, থাকবে- আল্লাহ যা করেন তা নিশ্চয়ই আমাদের মঙ্গলের জন্য করেন। 

‘সুবহানাল্লাহি-ওয়ালহামদুলিল্লাহি-অলাইলাহা-ইল্লাল্লাহু-আল্লাহু আকবর।’
(জিনাত হাকিমের ফেসবুক থেকে সংগ্রহ)
এসএ/