ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

যেন ভুলে না যাই 

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ০৮:২৭ এএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০ সোমবার

আজ ১৪ ডিসেম্বর - শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ঊণপঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের -  শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুনী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরী করেছিল পাকিস্তানী শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা। 

বিজয়ের একেবারে অন্তিম সীমায় বাড়ী বাড়ী গিয়ে যারা এঁদের তুলে নিয়ে এসেছিলো,  তারা কিন্তু ভিনদেশী সৈনিক নয়, এদেশেরই মানুষ - কিংবা মানুষরূপী পশু। তাদের হাত কাঁপেনি এইসব সোনার মানুষদের চোখ বেঁধে দিতে, ঠোঁট কাঁপেনি সেই মিথ্যা আশ্বাস দিতে, ‘আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাবো’, বুক কাঁপেনি এই সব নরম মনের মানুষদের আঘাত করতে। না, তাঁরা ফেরেন নি সে দিনও না, কোনদিন না আজ তক্। বধ্যভূমিই হয়েছে তাঁদের শেষসজ্জা। 

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমার তিন দল মানুষের কথা বড় মনে হয়। যাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের কথা - বড় বেদনার সঙ্গে। সেই সব শহীদের সন্তানদের, যাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাঁদের কথা - বড় মমতার সঙ্গে, এবং সেই সব হন্তার কথা, যারা এমন পাশবিক কাজ করে আদও বহাল তবিয়তে আছেন - তীব্র ঘৃনার সঙ্গে।

আমার প্রায়শই মনে হয়, ১৪ ডিসেম্বর আমি নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। ভাবতেই পারি না যে আমার প্রানপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরন্ময় কিছু মানুষকে আর দেখতে পাই নি কিংবা পাবো না, বহু প্রিয় লেখকের নতুন লেখা আর পড়তে পাবো না, অনেক সঙ্গীত শিল্পীর কন্ঠ আর সামনা সামনি শুনতে পাবো না। আমরা অনেকেই এইসব স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষদের ঠিক চিনকে পারি নি, পাকিস্তানীরা কিন্তু ঠিকই পেরেছিল। বাংলাদেশের সৃষ্টশীলতা আর সৃজনশীলতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিতে, আমাদের দেশের শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যেই তারা বেছে নিয়েছিল এইসব অনন্যসাধারন মানুষদের। মানুষ চিনতে ওরা ভুল করে নি। 

অনেকেই জিজ্ঞেস করেন,  লাখ লাখ নিহত মানুষের মধ্যে কেন বার বার শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উঠে আসে। আমার মনে হয়, এর উত্তর দু’টো। - একটি প্রত্যক্ষ আর অন্যটি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ কারনটি হচ্ছে এ মানুষগুলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের অনন্য কিছু মানুষ ছিলেন - যাঁদের স্বপ্নদৃষ্টি, দিক্-দর্শন, চিন্তা-ভাবনা, শিক্ষা ও পরামর্শ আমাদের অনুপ্রানিত করছেন প্রতিনিয়ত। তাই আমাদের হৃদয়ে তাঁদের জন্যে বিশেষ স্হান আছে। পরোক্ষ কারনটি হচ্ছে, আমদের মতো সাধারন মানুষেরা বহু শহীদের স্মৃতি একসঙ্গে হৃদয়ে বহন করতে পারে না। তখন আমরা প্রতীক খুঁজে নেই। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সেই প্রতীক। এই প্রতীকের মাঝখান দিয়েই আমরা পৌঁছে যাই অন্য সব জানা-অজানা শহীদদের কাছে।

একাত্তর-উত্তর সময়ে শিক্ষক হিসেবে আমার সুবর্ন সুযোগ ঘটেছিল উপর্যুক্ত শহীদদের অনেকেরই সন্তানদের সঙ্গে - বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেনীকক্ষে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াতে গিয়ে দেখি যে শ্রেনীকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে বসে আছে মিতি (শহীদ চিকিৎসক ডা: মর্তুজার কন্যা), শোভন ও সুমন (শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জেল হায়দার চৌধুরীর পুত্র), তৌহীদ (শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র)।

শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, কিন্তু অন্যভাবেও কাছে পেয়েছি অন্য শহীদ-সন্তানদের। বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বৃহত্তর অঙ্গনে কাছাকাছি এসেছি ভাষন, প্রয়াত মিশুক আর তন্ময়ের সঙ্গে - শহীদ মুনীর চৌধুরীর সন্তানদের সঙ্গে। অবয়ব পত্রের মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি মাহমুদার সঙ্গে (শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের সন্তান)। অতি সম্প্রতি পরিচিত হয়েছি মাহমুদের সঙ্গে - শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের পুত্র সে।

সেই সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, সেদিনের যে শিশু, কিশোর- কিশোরীরা পশুশক্তির কাছে তাদের বাবাকে হারিয়েছে, তারা আজ পরিনত বয়সের মানুষ। তাদের মনে পিতৃ-হারানোর বেদনা আমরা কেউ বুঝব না - কারন সব দু:খই তো মানুষের ব্যক্তিগত, সব বেদনাই তো তার তো নিজস্ব। কিন্তু এটা তো বুঝি যে তাদের পিতার হন্তাদের ‘বিচারের দাবী তাদের মনে নিভৃতে কাঁদে’ অহর্নিশ।

যারা আমাদের সূর্যসন্তানদের হত্যা করেছিল ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর, সেই সব খুনীরা আজো বহাল তবিয়তে আছে পৃথিবীর নানান জায়গায় -ঘুরে বেড়াচ্ছে স্বাধীন মানুষ হিসেবে। এ লজ্জা, এ ক্ষোভ কোথায় রাখি? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে  জার্মানীর ৬ লক্ষ ইহুদী হন্তা পলাতক আইকম্যানকে যদি প্রায় ৭ দশক আগে আর্জেন্টিনা  থেকে ধরে ইসরাইলে নিয়ে গিয়ে তার বিচার করা যায়, তা’হলে আজকের আধুনিক জগতে আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী খুনীদের কেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ধরে নিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে বিচার করা যাবে না।

শহীদ বুদ্বিজীবীদের হত্যাকারীদের বিচার ভিন্ন কোন পথ নেই  - শুধু ন্যায্যতার কারনে নয়, শুধু মানবিকতার কারনেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবিদের আত্মার শান্তির জন্যে, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবী মেটানোর জন্য এবং জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্যে। সে দায় রাষ্ট্রের, সমাজের ও ব্যক্তি মানুষের। আগামী বছর, ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাকাল্লে এ দাবী আমাদের সকলের - পুরো বাঙ্গালী জাতির।
এসএ/