ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

অসাম্প্রদায়িকতার মেলবন্ধন-ই হোক বিজয়ের উল্লাস

ধীরা ঢালী

প্রকাশিত : ০৮:০৫ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার

'গাহি সাম্যের গান—
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান। 
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি, 
সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।— 

বিদ্রোহী কবি নজরুলের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই- জাত, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানুষ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদকে অসাম্প্রদায়িকতার মেলবন্ধনে রূপান্তরিত করাই হলো মানুষের একমাত্র পরিচয়। আর মানুষের এ প্রগতিশীল প্রণোদনার হাত ধরেই আমরা অর্জন করেছি আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয়। যে বিজয় কুড়িয়ে পাওয়া একমুঠো বদান্যতার উপহার নয়। যা এক সাগর রক্ত ও লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়।

যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ও বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনাকে শামিল করে আজ আমরা ৪৯তম বিজয় দিবসে পদার্পণ করেছি। এ বিজয় আমাদের তাজা রক্তে রঞ্জিত বিজয়, এ বিজয় এক অসাম্প্রদায়িক জাতির বিজয়। এ বিজয়ে, আমাদের জাতিগত মর্যাদার প্রাপ্তি কতটুকু? 

এমন প্রশ্নের বিশ্লেষণে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী হ্লামংউ মারমা বলেন, 'বিশ্বের মানচিত্রে আমরা এক স্বাধীন এবং সাহসী জাতিসত্তার পরিচয় দিয়েছি। আমাদের দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতার স্বপ্নকে যারা নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল, আমরা তাদেরকে জীবন দিয়ে প্রতিহত করেছি। তাদের অস্তিত্বকে করেছি নিঃস্ব। অথচ আজও আমাদের জাতিগত মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্ন ওঠে আমাদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অস্তিত্বকে নিয়ে। তবে আশার আলো এখনও দেখতে পাই। দেখতে পাই বলেই প্রত্যন্ত অঞ্চল বান্দরবানের থানচি থেকে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুয়োগ পেয়েছি। তবে বিজয়ের এই দিনে আমার অহংকার একটাই, আমি স্বাধীন। আমার প্রাপ্তি একটাই, আমি অসাম্প্রদায়িক।'

১৯৭১ সালের এই দিনে অর্জিত হয় আমাদের চূড়ান্ত বিজয়। পূর্ব বাংলার মানুষের সহজাত শান্তি- প্রত্যাশাকে নস্যাৎ করার অজস্র প্রয়াস কলঙ্কিত করে হানাদার বাহিনীরা। তবে বাঙালি জাতির অসাম্প্রদায়িক প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুখ থুবড়ে পড়ে। অর্জিত হয় আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয়। অথচ বিজয়ের প্রায় অর্ধশত বছরে এসেও কী আমরা আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে পেয়েছি? 

জানতে চাওয়া হয় গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তানজিনা ইয়াসমিন মেঘলার কাছে। প্রতিত্তোরে তিনি বলেন, 'বিজয়ের ৪৯ বছরে পদার্পণ করলো আমাদের রুপে, গুণে সেরা বাংলাদেশ। আমরা আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপে সকল ধর্মের  মানুষের একাত্মবোধের মাধ্যমে বিজয়ী হয়েছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের লক্ষ্য ছিল এক অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ার। আমাদের এ সোনার বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার কোনও ঠাঁই নেই। আমরা লড়াকু জাতি, লড়াই করে হলেও অসাম্প্রদায়িক এ সোনার বাংলাদেশকে আগলে রাখবো।'

সুদীর্ঘ রক্তঝরা ইতিহাসে রঞ্জিত আমাদের স্বাধীনতা। সকল ধর্মের মানুষের সম্প্রীতি ও মহিমায় মহিমান্বিত এ দেশ। এ দেশে স্থান নেই কোনও দেশদ্রোহীর, কোনও বিশ্বাসঘাতকের। আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি আমরা অসাম্প্রদায়িক। অসাম্প্রদায়িক এ বাংলায় সাম্প্রদায়িকতার আভাস কতটুকু দেখতে পান?  

এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তিশা মন্ডল বলেন, 'একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে হাসতে হাসতে বাংলার হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই জীবন দিয়েছিল। সেদিন কে কোন ধর্মের সেই প্রশ্ন আসেনি, আসেনি কোনও জাত পাতের বিভেদ। বরং সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে গিয়ে সবার সমান সুযোগ নিয়ে বসবাসের একটি জনপদ গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞায় ছিল প্রবল। কিন্ত স্বাধীনতার এতো বছরেও আমাদের সেই স্বপ্ন পূর্ণ হয়নি। আজও ধর্মকে নিয়ে চলছে রাজনীতি, চলছে আমাদের বন্ধন নষ্ট করার চেষ্টা। তবে এটা ঠিক যে, অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সম্প্রীতি অনেক দৃঢ়। এখনও আমরা মিলে মিশে একসঙ্গে বসবাস করছি, একে অন্যের আচার অনুষ্ঠানে আনন্দ-উল্লাস করছি, একে অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়াচ্ছি। তবে আজও আমি স্বপ্ন দেখি- হয়তো এমন একদিন আসবে যেদিন সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে ছাপিয়ে আমাদের পরিচয় হয়ে উঠবে আমরা বাঙ্গালি।'

বিজয় মানেই কত উল্লাস, কত উচ্ছ্বাস, কত আবেগ, কত রঙিন সূর্যের হাতছানি। বিজয় মানেই অসাম্প্রদায়িকতার এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। তাহলে বিজয়ের উল্লাস-ই কী হতে পারে অসাম্প্রদায়িকতার মেলবন্ধন? 

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু মুহাম্মদ রুইয়ামের কাছে। তিনি বলেন, 'অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আসলে একটা স্বপ্নের মতো। জন্মের পরপরই একজন মানুষ পরিবার ভিত্তিক কোনও না কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। সাম্প্রদায়িকতা কিন্তু শুধু ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিটি মানুষ পেশাগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে কোনও না কোনও সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। অসাম্প্রদায়িকতার অর্থ সম্প্রদায়হীনতা নয় বরং সম্প্রদায় নিরপেক্ষতা। 

"সাম্প্রদায়িক" নামক এই ব্যাধিটির কারণেই আজকের বাংলাদেশ সবদিক থেকে পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশ সেদিনই উন্নতির শিখরে পৌঁছাবে যেদিন দেশের মানুষ সম্প্রদায় নিরপেক্ষ হয়ে একযোগে কাজ করবে। "অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ"-এর একটি বাস্তব চিত্র দেখা গিয়েছিলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা এই বিজয়ের পরিপূর্ণ স্বাদ তখনই পাবো, যখন সম্প্রদায় নিরপেক্ষ এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ সৃষ্টি হবে। আর তখনই হবে আমাদের অসাম্প্রদায়িকতার বিজয় উল্লাস।'

কোনও খন্ডিত বিচ্ছিন্ন স্বপ্ন বা কল্পনার বাস্তবরূপ নয় আমাদের এই অর্জন। মুক্তিসেনার রক্তে রঞ্জিত এক সুদীর্ঘ সংগ্রামের ফসলই আজকের বিজয় দিবস। এ বিজয় আমাদের ঐক্যবদ্ধ জীবন প্রচেষ্টা, মিলন-বিরহ, আশা-নিরাশার বাস্তব অনুভূতি সম্বলিত এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী, অসাম্প্রদায়িক অপরাজেয় চেতনার মেলবন্ধন। আর এই অসাম্প্রদায়িকতার মেলবন্ধনই আমাদের আজকের বিজয়ের উল্লাস।

লেখক- শিক্ষার্থী, ভাষা যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।

এনএস/