মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লায় শহীদ হন জেলার ৪১৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৩:১২ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০ বুধবার | আপডেট: ০৩:১২ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০ বুধবার
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কুমিল্লায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা কুমিল্লায় যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং পাশবিক নির্যাতনের যে ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, তার তুলনা পাওয়া সত্যিই কঠিন। মুক্তিযুদ্ধে হাজারো নিরীহ মানুষ ছাড়াও শহীদ হয়েছেন জেলার ৪১৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
পাকবাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক একেএম শামসুল হক খান পিএসসি ও পুলিশ সুপার কবির উদ্দিন আহমদ পিপিএম, পিএসসি। সেইসব বেদনাভরা স্মৃতি এবং সেইসঙ্গে বিজয়ের আনন্দঘন মুহূর্তের কথা তুলে ধরেছেন বাসস এর কুমিল্লা (দক্ষিণ) প্রতিনিধি কামাল আতাতুর্ক মিসেল।
হানাদারদের নৃশংসতা : পাকবাহিনী কুমিল্লায় এসেই তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদরদের নিয়ে গোটা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। হায়েনার দল বিভিন্ন স্থানে হানা দিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে নিরীহ মানুষকে। ধরে নিয়ে যায় যুবতী মেয়েদের। লাকসামের একটি সিগারেট ফ্যাক্টরিতে হানা দিয়ে সেখানে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তারা। লাকসাম রেলওয়ে জংশনে অপেক্ষমাণ ট্রেন থেকে যাত্রীদের ধরে নিয়ে হত্যা করে। প্রতি রাতেই জেলার বিভিন্ন এলাকায় চোখ বেঁধে নিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হতো নিরীহ লোকদের। তারপর লাশ পুঁতে রাখতো মাটির নিচে। সেসব স্থানে মাটি খুঁড়লে আজও বেরিয়ে আসে মানুষের হাড়গোড়, খুলি। কুমিল্লায় বিভিন্ন স্থানে অনেক বধ্যভূমি ও গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছে। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের গণকবরে বহু কঙ্কাল পাওয়া গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কুল্লাপাথরে ১৪ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে গণকবর দেয়া হয়। বধ্যভূমির মধ্যে রয়েছে বেলতলী, ধনাঞ্জয়, দিশাবন্দ, ঘিলাতলা, রসুলপুর, হোমনার বধ্যভূমি ইত্যাদি।
বিবির বাজার যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য :
কুমিল্লার বিবির বাজার সীমান্তে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিশালী ঘাঁটিতে হামলা চালায় পাকবাহিনী। এতে মুক্তিবাহিনী সাময়িকভাবে পরাস্ত হলেও পরে শক্তি বৃদ্ধি করে তারা হানাদার বাহিনীর ৩৯তম বালুচ রেজিমেন্টে একদিন অতর্কিত আক্রমণ চালায়। দুই পক্ষের মধ্যে বেধে যায় প্রচন্ড যুদ্ধ। চার-পাঁচ ঘণ্টা স্থায়ী এ যুদ্ধে কমপক্ষে ১৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ১ জন বীর সেনা শহীদ হন ও ৮-১০ জন আহত হন।
যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস :
কুমিল্লার দক্ষিণে অবস্থানরত ‘কে’ ফোর্সের সেনাদল নিয়ে নির্ভয়পুরে একটি সাব- সেক্টর স্থাপন করা হয়। এ সাব-সেক্টরে ছিলেন কর্নেল (অব.) আকবর, লে. মাহবুব ও লে. কবির। এ সাব-সেক্টর থেকে একটি কোম্পানি সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারীর অধীনে লাকসামের পশ্চিম এলাকায় গোপন ঘাঁটি স্থাপন করে। এ ঘাঁটি থেকে নোয়াখালী, লাকসাম, কুমিল্লা, চাঁদপুরে পাকসেনাদের উপর অতর্কিত হামলা চালাতে থাকে মুক্তিবাহিনী। জুলাই মাসে সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের এ গেরিলা দলটি পাকবাহিনীর চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে চাঁদপুর থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত অনেক সড়ক ও রেলসেতু বোমা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়। এছাড়া তারা লাকসাম-চট্টগ্রাম রেলপথে অবস্থিত রেলসেতু ও সড়ক সেতু ধ্বংস করে দেয়। ফলে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।
বেতিয়ারায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি :
১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বেতিয়ারা গ্রামে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এতে ১১ জন গেরিলা নিহত হন। কোনরকম পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় গেরিলা দলটি পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেনি। পাকবাহিনীর হামলায় পরাস্ত মুক্তিযোদ্ধারা বেতিয়ারার মাঠে তাদের অস্ত্র এবং শহীদ ১১ জন সহযোদ্ধার লাশ ফেলে পিছু হটে আসে। ১৩ নভেম্বর স্থানীয় চেয়ারম্যান আগা আজিজুল হক চৌধুরী লাশগুলো একটি গর্তে মাটিচাপা দেন। দেশ স্বাধীন হবার পর লাশগুলোর হাড়গোড় গর্ত থেকে তুলে বেতিয়ারার বর্তমান শহীদ মিনারের পাশে কবরস্থ করা হয়। সেদিনের ১১ জন শহীদের মধ্যে ৯ জনের নাম জানা গেছে। এরা হলেন-নিজাম উদ্দিন আজাদ (দলনেতা), সিরাজুল মনির, জহিরুল হক, সফিউল্লাহ, আওলাদ হোসেন, কাইয়ুম, বশিরুল ইসলাম, মো. শহিদুল্লাহ ও কাদের মিয়া। এ বেদনাবিধুর স্মৃতিকে ঘিরে প্রতি বছর ১১ নভেম্বর বেতিয়ারায় পালিত হয় ‘বেতিয়ারা দিবস’।
যুদ্ধকালীন থানা কমান্ডার :
আবদুল মতিন (কোতোয়ালী), আবুল বাশার (লাকসাম), আবু তাহের (চৌদ্দগ্রাম), বেলায়েত হোসেন (বরুড়া), আলী আকবর (চান্দিনা), সিরাজুল ইসলাম (দেবিদ্বার), সরাফত আলী (বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া), কামরুল হাসান (মুরাদনগর), নজরুল ইসলাম ও পরে আবদুল মতিন (দাউদকান্দি), চৌধুরী আমীর আলী (হোমনা)।
মুক্ত হলো কুমিল্লা :
নভেম্বরের শেষদিকে পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে পালিয়ে যায়। ২৮ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথ দীঘি এলাকা দখল করে নেয়। এ এলাকাটিই কুমিল্লার প্রথম মুক্তাঞ্চল। ৩ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর যোদ্ধারা কুমিল্লার ময়নামতি আক্রমণ করে। যৌথ বাহিনীর ৩০১ মাউন্টেন ব্রিগেড এবং মুক্তিবাহিনীর ইস্টার্ন সেক্টর লালমাই পাহাড় ও লাকসামে পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেঙ্গে ফেলে এবং লাকসাম-কুমিল্লা সড়ক পথের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। লাকসামের মুদাফফরগঞ্জে হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে হানাদার বাহিনী পরাজিত হয় এবং ৬ ডিসেম্বর মুদাফফরগঞ্জ মুক্ত হয়। পরদিন মুক্তিবাহিনী ঢাকার সাথে ময়নামতির সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এদিকে লাকসামের ঘাঁটি রক্ষায় পাকবাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে। পাকবাহিনীর ২২ বেলুচ রেজিমেন্ট কুমিল্লা বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নেয়। ৭ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ২৬/২৭ জন যোদ্ধা শহীদ হন। তবে পরাস্ত হয় পাকবাহিনী। তারা পিছু হটে সেনানিবাসে অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনী মুক্ত কুমিল্লায় প্রবেশ করতে থাকে এবং ৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা ‘কুমিল্লা মুক্ত দিবস’ উদযাপন করে, যদিও তখনও পাকবাহিনী সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। ১৬ ডিসেম্বর তারা সদলবলে আত্মসমর্পণ করে। আনুষ্ঠানিকভাবে কুমিল্লায় প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় ৮ ডিসেম্বর।
সূত্র : বাসস
এসএ/