ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

‘রুমির কবিতা’ মুছে দেয় ধর্ম–বর্ণের সকল সংঘাত

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:২০ পিএম, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০২:১১ পিএম, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার

‘তুমি চলে গেলে আমার চোখ দিয়ে রক্ত বাহিত হলো। আমি কেঁদে কেঁদে রক্তের নদী বহালাম। দুঃখগুলো শাখা-প্রশাখা বেড়ে বড় হলো, দুঃখের জন্ম হলো। তুমি চলে গেলে, এখন আমি কীভাবে কাঁদবো? শুধু তুমি চলে গেছো তা-ই নয়, তোমার সাথে সাথে তো আমার চোখও চলে গেছে। চোখ ছাড়া এখন আমি কীভাবে কাঁদবো প্রিয়!’

এ এমনই এক কবির কবিতা যিনি প্রাচ্যের এক অখ্যাত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ৮১৩ বছর আগে অর্থাৎ ১২০৭ সালে জন্ম নেওয়া এ কবির শায়েরি এখনও সারা দুনিয়াজুড়ে বিক্রি হচ্ছে সমানতালে। তিনি ফারসি সুফি কবি জালাল উদ্দিন রুমি। আজ তার তিরোধান দিবস। 

রুমির কবিতার সতেজ ভাষা এবং ছন্দ সহজেই মানুষের মনে জায়গা করে নিতো। তার প্রতিটি শব্দ শুনে মনে হতো এগুলো সাধারণ ভাষা নয়, মানুষের হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনের অনুবাদ, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের ভাষা। তিনি তার কবিতাগুলো বা গজলগুলো লেখার অনুপ্রেরণা পেতেন তার পারিপার্শ্বিকতা থেকেই। কখনো বা রাখালের বাজানো বাঁশির সুর শুনে, কখনো ঢাকের আওয়াজ শুনে, আবার কখনো স্বর্ণকারের হাতুড়ির আওয়াজ শুনে। তিনি বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টিকর্তার খোঁজ কোনো মসজিদ বা গির্জার পাওয়া সম্ভব নয়, সৃষ্টিকর্তার খোঁজ করতে হয় নিজের হৃদয়ে। 

তাই তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজছিলাম। তাই আমি মন্দিরে গেলাম, সেখানে তাকে খুঁজে পেলাম না। আমি গির্জায় গেলাম, সেখানেও তাকে পেলাম না। এরপর আমি মসজিদে গেলাম সেখানেও তাকে পেলাম না। এরপর আমি নিজের হৃদয়ে তাকে খুঁজলাম, সেখানে তাকে খুঁজে পেলাম।’

তিনি আরো বিশ্বাস করতেন ভালোবাসাই সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পাওয়ার সর্বোত্তম পন্থা। এজন্য তিনি বলেছিলেন, ‘স্রষ্টার কাছে পৌঁছানোর অজস্র পথ আছে। তার মাঝে আমি প্রেমকে বেছে নিলাম।’

মরমি কবি জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি (৩০ সেপ্টেম্বর ১২০৭—১৭ ডিসেম্বর ১২৭৩) ছিলেন ত্রয়োদশ শতকের একজন ফারসি কবি, সুফিতাত্ত্বিক ও আইনজ্ঞ। জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ বালখী নামেও তিনি পরিচিত। খ্যাত হয়েছেন মাওলানা রুমি নামেও। বর্তমানে ইউরোপ–আমেরিকা ছাড়া প্রাচ্যের দেশগুলোতেও রুমির কবিতা খুবই পাঠকপ্রিয়। কারণ, তাঁর কাব্যের প্রতিটি চরণে রয়েছে অধরা এক উপলব্ধির পৃথিবী। 

প্রেম ভালোবাসা নিয়ে তার বানীতে তিনি বলেছেন–
‘প্রেমই মুক্তি, প্রেমই শক্তি, প্রেমই পরিবর্তনের গুপ্তশক্তি, প্রেমই দিব্য সৌন্দর্যের দর্পন স্বরুপ!’

তিনি লিখেছেন-
‘আমার প্রথম প্রেমের গল্প শোনামাত্র তোমাকে খুঁজতে থাকি! কিন্তু জানি না ওটা কতটা অন্ধ ছিল। প্রেম আসলে কোথাও মিলিত হয় না। সারাজীবন এটা সবকিছুতে বিরাজ করে।’

‘আমি আমার জন্য মরে গেছি এবং বেঁচে আছি তোমার কারণে।’

তিনি আরও লেখেন-
‘যদি তুমি কারো হৃদয়কে জয় করতে চাও,তাহলে প্রথমে অন্তরে ভালবাসার বীজ রোপণ করো।আর যদি তুমি জান্নাত পেতে চাও তাহলে অন্যের পথে কাঁটা বিছানো ছেড়ে দাও।’

প্রায়ই তিনি কবিতা বা গান রচনা করার সময় অন্যমনস্ক হয়ে যেতেন। কখনো কখনো তিনি তার গজলগুলোর সাথে এতটাই একাত্ম সাথে হয়ে যেতেন যে  গভীর মগ্নভাবে ঘুরে ঘুরে নাচতে শুরু করতেন। তার নাচ দেখে মনে হতো, নাচের মাঝেই অন্য কোনো জগতে চলে গিয়েছেন, বাস্তব জগতের সাথে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি নাচতেন, যখন তিনি সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসার সাথে একাত্মতা অনুভব করতেন। তার নাচ তার কাছে একধরনের ইবাদত ছিল।

তিনি বলেছিলেন, -

‘আমরা শূন্য থেকে ঘুরতে ঘুরতে এসেছি
যেমনটা তারারা আকাশে ছড়িয়ে থাকে।
তারারা মিলে একটি বৃত্তের সৃষ্টি করে,
এবং তার মাঝে আমরা নাচতে থাকি।’

রুমির বিভিন্ন কবিতা এবং গানের পাশাপাশি ‘ফিহি মা ফিহি’ নামে তার বিভিন্ন উক্তির সংগ্রহ পাওয়া যায়, যা তার অনুসারীরা এবং বন্ধুরা বিভিন্ন সময় লিখে রেখেছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে লেখা তার বেশ কিছু চিঠিও পাওয়া গিয়েছে। রুমির চিন্তা বা ধারণাগুলোকে আসলে কোনো নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলা সম্ভব নয়। অনেক সময় এদের নিজেদের মাঝেই বিভিন্ন পার্থক্য ও বৈচিত্র্য দেখা যায়। তার বিভিন্ন রূপকের ব্যবহার এবং ধারণার পরিবর্তনশীলতা অনেকসময় পাঠকদের ধাঁধায় ফেলে দেয়। তার কবিতা বা লেখাগুলো আসলে বিভিন্ন রহস্যময় ও বিচিত্র অভিজ্ঞতায় মানুষের অভিব্যক্তিরই প্রতিফলন যেখানে মানুষ তার প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন অনুভূতিকে খুঁজে পায়। 

তাই তো জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমিকে কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠী দিয়ে বেঁধে ফেলা সম্ভব নয়, কারণ তিনি সারা বিশ্বের মানুষের হৃদয়ের কথা বলেন, আর তিনি সবকিছু হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন। আর এ কারণেই তিনি সকলের হৃদয়ের সাথে মিশে যান। 

১২৭৩ সালে রুমির জানাজায় অংশ নিতে প্রায় সব ধর্মের মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, রুমির কবিতা তাঁদের নিজ নিজ ধর্মের প্রতি আরও গভীরভাবে বিশ্বাসী করে তুলেছে। রুমির কবিতার শক্তি এ জায়গাতেই। বিশ্বব্যাপী ধর্ম–বর্ণের যে বিরোধ আর সংঘাত, রুমির কবিতা তা মুছে দেয়।

তাইতো তিনি লিখেছিলেন-

‘ভুলে যাও বিশ্বের সব জাতি, ধর্ম, বর্ণের সকল ভেদা ভেদ। কেবল নিজের লক্ষ্য ও গন্তব্য ঠিক করে নাও। মনে রেখ তুমি হলে একটি আত্মা আর তোমার কর্ম হল শুধুই ভালবেসে যাওয়া।’
এসএ/