‘প্রতি উপজেলা থেকে ১ হাজার জনকে বিদেশে পাঠানো হবে’
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৩:৫১ পিএম, ১৮ ডিসেম্বর ২০২০ শুক্রবার
প্রতি উপজেলা থেকে এক হাজার জনকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ।
মন্ত্রী আজ শুক্রবার প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস ২০২০ উপলক্ষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতি উপজেলা থেকে প্রতিবছর গড়ে ১ হাজার জন যুব/যুব মহিলাকে বিদেশে কর্মসংস্থানের অঙ্গীকার করেছে। গত অর্থবছরে গড়ে এই সংখ্যার চেয়েও বেশি কর্মী বিদেশে পাঠানো হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে প্রতি উপজেলা থেকে নূন্যতম ১ হাজার জন যুব/যুব মহিলার বিদেশে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রবাসফেরত কর্মীর সংখ্যা এখনো উদ্বেগজনক হয়ে উঠেনি।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আশংকা করা হয়েছিল অর্থনৈতিক মন্দা এবং করোনার প্রভাবে প্রধান কর্মী নিয়োগকারী দেশসমূহের শ্রমবাজার বিপর্যস্ত হওয়ার কারণে অনেক বিদেশী কর্মী বেকার হয়ে পড়বে। কিন্তু আশার কথা হলো, এখন পর্যন্ত ফেরত আসা কর্মীর সংখ্যা আশংকাজনক হয়ে উঠেনি। এক্ষেত্রে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিদেশস্থ মিশন ও দূতাবাস একযোগে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। প্রবাসী কর্মীদের একটি অংশ দেশে ফেরত এসেছে। গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৮ জন প্রবাসী কর্মী দেশে ফেরত এসেছে। তাদের অনেকে কাজের মেয়াদ শেষে বা কাজ না থাকায় দেশে ফেরত এসেছে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রেক্ষিতে বৈশ্বিক শ্রমবাজার আজ প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন এবং এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ একটি চ্যালেঞ্জ। তারপরেও আমরা আশাবাদী। অর্থনৈতিক মন্দার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কর্মী নিয়োগকারী দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডে অবশ্যই কর্মী প্রয়োজন হবে এবং শ্রমবাজার আবার স্বাভাবিক হবে। এই প্রত্যাশায় আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে দক্ষ কর্মী প্রেরণের লক্ষ্যে আমাদের কর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সার্টিফিকেশনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো রেমিটেন্স। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে রেমিটেন্সের পরিমাণ হলো ১৮.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিগত বছরের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থ বছরের প্রথম ৫ মাসে রেমিটেন্স এসেছে ১০.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত অর্থ বছরের প্রথম পাঁচ মাসের তুলনায় ৪১.৩৩ শতাংশ।
এই বিপুল অংকের রেমিটেন্সের জন্য তিনি দেশপ্রেমিক প্রবাসী কর্মীদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। মন্ত্রী এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রেমিটেন্সে ২ শতাংশ ইনসেনটিভ দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, তাঁর এই দূরদর্শী নির্দেশনা রেমিটেন্স প্রবাহের উর্দ্ধগতির অন্যতম কারণ।
ইমরান আহমদ বলেন, বর্তমান সরকার দায়িত্ব লাভের পর হতেই সম্মানজনকভাবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতারণমুক্ত পরিবেশে যৌক্তিক অভিবাসন ব্যয়ে অধিক হারে কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে নিরলসভাবে সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাপি অভিবাসী ও তার পরিবারের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ‘আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস’ যথাযথ গুরুত্বের সাথে উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ বছরের দিবসটির প্রতিপাদ্য “মুজিব বর্ষের আহবান, দক্ষ হয়ে বিদেশ যান”। এই বছরের আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসের মূল ও জাতীয় অনুষ্ঠান আগামী ৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি উপস্থিত থাকতে সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন বলে তিনি জানান।
করোনাকালীর গৃহীত বিভিন্ন কর্মকান্ডের কথা তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, ‘করোনা মহামারির পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয় দেশে বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের আর্থ সামাজিক রিইন্ট্রিগ্রেশনসহ সামগ্রিক সুরক্ষা, বর্তমান শ্রমবাজার ধরে রাখা, নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান, বন্ধ শ্রমবাজার উন্মুক্তকরণসহ করোনাত্তর পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কর্মী তৈরিকে প্রাধান্য দিয়েছে।’
তিনি জানান, করোনা মহামারীকালে মন্ত্রণালয় প্রবাসী বাংলাদেশীদের সমস্যা দ্রুত সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তর, সংস্থাকে নিয়ে ১৪টি আন্ত:মন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠান, বিদেশস্থ বাংলাদেশ মিশনের শ্রম কল্যাণ উইংয়ের মাধ্যমে দুস্থ ও কর্মহীন হয়ে পড়া প্রবাসী কর্মীদের মাঝে বিশেষ বরাদ্দ হিসেবে ৯ কোটি ৮৫ লাখ ২৫ হাজার টাকার ঔষধ, ত্রাণ ও জরুরি সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। করোনাকালে সৌদি আরবের ডিপোর্টেশন সেন্টারে অবস্থানরত মোট ২০৭ জন নারী কর্মীকে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তহবিল থেকে বিমান ভাড়া প্রদান করে দেশে ফেরত আনা হয়েছে। একইভাবে লেবানন থেকে ৯৫ জন কর্মী এবং ভিয়েতনামে আটকে পড়া ১০৫ জন কর্মীকে দেশে ফেরত আনা হয়েছে ।
মন্ত্রী জানান, লকডাউন সময়কালে গত ২৯ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত বিদেশ প্রত্যাগত ৫ হাজার ৯৭৪ জন কর্মীকে জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা করে বিমান বন্দরে তাৎক্ষণিক মোট ২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিদেশ প্রত্যাগত কর্মীদের এবং প্রবাসে করোনায় মৃত কর্মীর পরিবারের উপযুক্ত সদস্যকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে সহজ শর্তে ২০০ কোটি টাকার “বিনিয়োগ ঋণ” প্রদান। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তহবিল থেকে গত ১৫ জুলাই থেকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে মাত্র ৪ শতাংশ সরল সুদে ও সহজ শর্তে এ ঋণ প্রদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর আওতায় ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪১১ জন ঋণগ্রহীতাকে ইতোমধ্যেই ৮ কোটি ৮ লাখ টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বিদেশ ফেরত কর্মীদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের অনুকূলে সরকার ৫০০ কোটি টাকার বরাদ্দ অনুমোদন করেছে। ইতোমধ্যে প্রাপ্ত ২৫০ কোটি টাকা থেকে পুরুষ কর্মীদের জন্য ৯ শতাংশ সুদে ও নারী কর্মীদের জন্য ৭ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ শুরু হয়েছে। ফেরত আসা কর্মীদের রিইন্টিগ্রেশনের জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড কর্তৃক একটি প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়েছে। বিদেশ প্রত্যাগত কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রবাসী কর্মীদের কল্যাণ সেবা শক্তিশালীকরণের এই প্রকল্পটি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দ্রুত বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করা যায়।
ইমরান আহমদ বলেন, করোনা মহামারী পরিস্থিতি বিবেচনায় করোনা ভাইরাসে মৃত্যুবরণকারী নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত নির্বিশেষে সকল প্রবাসী কর্মীর পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য ৩ লাখ টাকার আর্থিক অনুদান প্রদান করা হচ্ছে। রিক্রুটিং এজেন্টসমূহের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের মাসিক বেতন-ভাতা প্রদান, অফিস ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ বহন এবং রিক্রুটিং ব্যবসা পরিচালনা করার নিমিত্ত তাদের লাইসেন্সের জামানতের ৫০ শতাংশ অর্থ এবং মহিলা কর্মী প্রেরণ, জাপানে কর্মী প্রেরণ ও সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণের বিপরীতে জমাকৃত জামানতের ৫০ শতাংশ অর্থ ১ বছরে ফেরতযোগ্য হিসেবে প্রদান করা হয়েছে।
তিনি জানান, বাজার গবেষণা এবং বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সির উদ্যোগে বিভিন্ন নতুন গন্তব্যে কর্মী প্রেরণ শুরু হয়েছে। তন্মধ্যে কম্বোডিয়া, সেশেলস, উজবেকিস্তান, বসনিয়া ও হারজেগোভিনা, চীন অন্যতম। পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়ায় কর্মী প্রেরনের জন্য সম্ভাবনাময় ট্রেড যেমন, ইমরাত নির্মাণ, হসপিটালিটি/কেয়ারগিভার, কৃষি ইত্যাদি চিহ্নিত করা হয়েছে।
মন্ত্রী জানান, দক্ষ কর্মী তৈরির লক্ষ্যে সারাদেশে ৬৪টি টিটিসি, ৬টি আইএমটি চালু রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে ৪০টি টিটিসি নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। মুজিব বর্ষের বিশেষ উদ্যোগ মুজিব জন্মশতবর্ষের মহান মুক্তিযুদ্ধের বছরের স্মারক হিসেবে উপজেলা পর্যায়ে আরো ১০০টি টিটিসি নির্মানের প্রকল্প হাতে নিয়েছি। ইতোমধ্যে এর ডিপিপি প্রণয়নের কাজ সমাপ্ত হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, বিদেশে কর্মহীন হয়ে পড়া বাংলাদেশি কর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও তাদের লব্ধ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সনদ প্রদানের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে গ্রীসে মন্ত্রণালয়ের দক্ষতা উন্নয়ন তহবিলের অর্থায়নে একটি প্রশিক্ষণ কোর্স শুরু হয়েছে। বাহরাইন ও সৌদি আরবে অনুরূপ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
তিনি জানান, করোনাত্তর আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের পরিবর্তিত চাহিদা অনুযায়ী পুন:প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে ফেরত আসা কর্মীদের পুনরায় বিদেশ প্রেরণের উদ্যোগ নেয়া হবে। এছাড়া, প্রশিক্ষণের যথাযথ সনদায়ন ও পূর্ববর্তী শিক্ষার স্বীকৃতির বিষয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে সনদ প্রদানের জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এ সময় মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. শামসুল আলম, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান, বোয়েসেল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুল হাসান বাদল এবং মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. শহীদুল আলম ও খাদিজা বেগম উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র : বাসস
এসএ/