‘অপরাজিতা’র ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
সাজেদুর আবেদীন শান্ত
প্রকাশিত : ১১:১৪ এএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২০ সোমবার
স্বামী-সন্তানের সঙ্গে জান্নাতুল ফিরদাউস।
বর্তমান যুগ উদ্যোক্তাদের যুগ। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের জয় জয়কার চারদিকে। বিভিন্ন ধরনের শিল্প এবং পণ্য নিয়ে কাজ করছেন আমাদের নারীরা। আজকে তেমনি একজন অপরাজিতা নারীর কথা বলব- ফেসবুকে যিনি অপরাজিতা জান্নাত নামেই বেশি পরিচিত। তার উদ্যোগের নাম ‘অপরাজিতা’। অনলাইনে দেশীয় পণ্যকে তুলে ধরার প্রয়াস তার।
অপরাজিতা এই নারীর পুরো নাম জান্নাতুল ফিরদাউস। বাবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবু জাহির, মা সুলতানা সুফিয়া। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ছোট্ট শহর সিলেটের হবিগঞ্জে। পারিবারিকভাবে ব্যবসায়িক ঐতিহ্য থাকায় ছোটবেলা থেকেই ব্যবসার সাথে পরিচিত তিনি।
পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় জান্নাতুল বলেন, আমার ভাই ছিল সবার ছোট। বড় ভাই না থাকায় বাবাকেই সবকিছু একা সামলাতে হতো। দুজন কর্মচারী থাকা সত্ত্বেও আমার বাবার ব্যবসার একজন বিশ্বস্ত লোকের প্রয়োজন ছিল। তখন আমার বয়স মাত্র ৮ বছর। একদিন একা একা বাবার দোকান দেখতে গিয়েছিলাম। বাবা আমাকে দেখে অনেক খুশি হন এবং ক্যাশ কাউন্টারে বসিয়ে দেন। তখন টুকটাক হিসেব জানতাম, আর বাবার কাছ থেকে কি করে পোশাক ভাঁজ করতে হয় এগুলো শিখতাম। এভাবেই আমার ব্যবসায় হাতে খড়ি। এভাবে প্রায় ৮ বছর আমি বাবার সঙ্গে কাজ করি।
জান্নাতুল ফিরদাউস আরও বলেন- এমনকি আমার বাবা যখন অসুস্থ ছিলেন তখনও আমি একাই পুরো দোকানটা সামলেছি। কিন্তু যখন আমি মাধ্যমিকের শেষ পর্যায়ে এসে পড়ি, তখন আমার পক্ষে আর কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ আমি যেহেতু একজন মেয়ে আর সামনে এসএসসি পরীক্ষা, তাই সবদিক চিন্তা করে আমি ব্যবসার কাজ থেকে সরে আসি। এর এক বছর পর আমার বাবা দোকানটা ছেড়ে দেন। দোকানের সম্পূর্ণ মালামাল বিক্রি করে ফেলেন।
দির্ঘশ্বাসের সঙ্গে আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি বলেন- দীর্ঘ ৩৫ বছর ব্যবসা করার পরও আমার বাবা মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে বলতেন, আমার এই মেয়েটা যদি আজ ছেলে হতো! তবে হয়ত আমার ব্যবসাটা আজ টিকে থাকত। বাবার সেই আক্ষেপ আর ব্যবসার প্রতি ভালোবাসা থেকেই মূলত আমি ব্যবসায় কিছু একটা করার চিন্তা ভাবনা করি।
জান্নাতুল বলেন- বাবার ইচ্ছে ছিলো আমি ঢাকায় পড়াশোনা করি। সেই লক্ষ্যে ২০১৬ সালে ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হই। ১ম বর্ষের ফরম ফিলাপের আগের দিন পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে হয়। আমার স্বামী এমদাদুল হক রুবেল পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। তারপর থেকে মূলত আমার উদ্যমী জীবন শুরু হয়। বিয়ের পর হোস্টেল ছেড়ে নতুন জীবন শুরু করি। ছোট একটা বাসা নিয়ে টোনাটুনির সংসার আমাদের। এরই মধ্যে ১ম বর্ষের ফলাফল প্রকাশ হয়, আমি ফাস্ট ক্লাস পাই।
স্বপ্ন নিয়ে হবিগঞ্জের এই তরুণী বলে চলেন- ক্যাম্পাস থেকে বাসা দূরে হওয়ায় রেগুলার ক্লাস করা সম্ভব হয়নি। তাই বাসায় বসে না থেকে আমি চিন্তা করি- চাকরি করব। স্বামীর মতামত নিয়ে একটা প্রাইভেট অফিসে জয়েন করি। কিন্তু পড়াশোনা, অফিস, সংসার সবকিছু সামলানো চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছিল। তখন ফ্রি টাইমে আমি বিভিন্ন নারী উদ্যোক্তাদের গল্প শুনতাম আর স্বপ্ন দেখতে শুরু করি ব্যবসা করার।
তখন জান্নাতুল তার স্বামীর উৎসাহে তার বাবা, স্বামী এবং নিজের কিছু জমানো টাকা নিয়ে তার বাসার কাছে একটা দোকান ভাড়া করেন। ডেকোরেশনের কাজ শেষে সেখানে তিনি মেয়েদের ড্রেসসহ অন্যান্য আইটেমের পোষাক ওঠান।
নতুন উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেহেতু এটা মেয়েদের দোকান ছিলো এবং সুন্দর সুন্দর কালেকশন ছিল তাই আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এলাকায় ভালো পরিচিতি পাই। এভাবে যখন একটু একটু করে আমার দোকানটা বড় হচ্ছিল, তখনই আমার বেবি কনসিভ হয়। যেহেতু এটা আমাদের প্রথম সন্তান, তাই তার প্রতি আমাদের অন্য রকম একটা ভালোলাগা কাজ করছিল। কিন্তু অন্যদিকে আমার স্বপ্ন কেবলমাত্র যাত্রা শুরু করেছে। সেই মূহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয়াটা আমার পক্ষে খুবই কষ্টকর ছিল। আমার স্বামীর কথা ভেবে সন্তানের কথা চিন্তা করে ব্যবসার পরিকল্পনা স্থগিত করি।
উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ায় ভেঙে পড়া জান্নাতুল বলেন, আসলে প্রতিটি মানুষের জীবনেই কিছু স্বপ্ন থাকে আর সেই স্বপ্ন যদি চোখের সামনে ভেঙে যায়, তখন সেই পরিস্থিতিটা যে কতটা কষ্টের সেটা আমি প্রথম বার উপলব্ধি করি। শপের ডেকোরেশন ও মালামাল মিলিয়ে আমার লস হয়েছিল তখন প্রায় লক্ষাধিক টাকা। তবে মানসিকভাবে যে ক্ষতিটা হয়েছিল, তা ছিল অনেক বেশি। নিজেকে তখন শুধু ব্যর্থ মনে হতো। অতঃপর ডিসেম্বরের ৬ তারিখে আমার ছেলের জন্ম হয়। আমার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা কথা মনে হতো- একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আমি ব্যর্থ হলেও একজন মা হিসেবে আমি সফল।
এরপর আবার নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ান জান্নাতুল। তিনি বলেন, ফ্রেব্রুয়ারিতে আমার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়। মার্চ মাসে যখন করোনার প্রকোপ বেড়ে যায়, তখন চারটি পরীক্ষা স্থগিত রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। আর অন্যদিকে আমার স্বামীর অফিস কার্যক্রমও বন্ধ ছিল। ওই সময়টাতে আমার স্বামী আমাকে বলতেন, তুমি ঘরে বসে কাজ করা যায় এমন কিছু একটা চিন্তা করো। কিন্তু সেই সময়টাতে আমার মন-মানসিকতা এতটাই দুর্বল ছিল যে, আমি কিছু ভাবতে পারছিলামনা। তখন আমার একজন শিক্ষকের কথা মনে পড়ে যায়- তিনি ইকবাল বাহার জাহিদ স্যার। যিনি সবসময় বলতেন, স্বপ্ন দেখুন, লেগে থাকুন ইনশাআল্লাহ সফল হবেন। স্যারের এই উক্তি আমার মনোবলকে জাগিয়ে তোলে।
পার্সোনাল ব্রান্ডিং দিয়ে ফের শুরু করা জান্নাতুল বলেন, কিন্তু অনলাইনে কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। সেই মূহূর্তে আরও একজন শিক্ষকের দেখা পাই। রাজীব আহমেদ স্যার। যিনি বলেন, পার্সোনাল ব্রান্ডিং-এর দিকে গুরুত্ব দিতে। স্যারের কথা অনুযায়ী, আমার মনে হলো যে- আমার আগে নিজেকে ব্রান্ডিং করতে হবে। আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডরা সবাই যেহেতু আমার পরিচিত ছিলেন, সেক্ষেত্রে আমি নতুন করে আবার সবার সাথে পরিচিত হওয়া শুরু করলাম। আমার আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু- বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিলাম। তারপর একদিন আমার একজন ফেসবুক ফ্রেন্ড আমাকে নক করলেন কিছু ড্রেস কেনার জন্য। কারণ উনি জানতেন আমার নিজের একটা শপ আছে।
আমার কাছে যেহেতু ড্রেস কালেকশন ছিল না, তাই আমি আমার একজন ফ্রেন্ড-এর কিছু ড্রেস কালেকশন উনাকে দেখাই। তো উনি সেখান থেকে দুই হাজার টাকার ব্লক এবং স্ক্রীন প্রিন্ট ড্রেস অর্ডার করেন। তো অর্ডারটা আমার ফ্রেন্ড কে কনফার্ম করার পর সে ওগুলো পাঠিয়ে দেয়। ড্রেস হাতে পেয়ে আমার সেই কাস্টমার ফ্রেন্ড অনেক খুশি হন। আর সেই অর্ডার থেকে আমার লাভ ছিল মাত্র ৮০ টাকা। কিন্তু আনন্দ ছিল এতো বেশি যে, আমার মনে হয়েছিল- আমি কোটি টাকা হাতে পেয়েছি। কারণ উনি আমার প্রথম অনলাইন কাস্টমার ছিলেন। আর তখন যেহেতু আমি ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছিলাম।
অপরাজিত হয়ে ওঠা জান্নাতুল বলেন, তারপরের দিন আমি আমার একজন প্রিয় বান্ধবীর সাথে বিষয়টা শেয়ার করি। সে তখন আমার কথা শুনে কালেকশনগুলোর ছবি দেখার আগ্রহ প্রকাশ করে। আমি ওকে ছবিগুলো দিলে সে সেখান থেকে ৫ হাজার টাকার পণ্য অর্ডার করে। তো আমি প্রোডাক্ট কনফার্ম করে আমার সেই সেলার ফ্রেন্ডকে অর্ডার দিলে, সে সবগুলো প্রোডাক্ট তার কাছে থেকে নেয় বলে জানায়। আমার যেহেতু নতুন ব্যবসা আর ব্যবসায় প্রতিশ্রুতি রক্ষা যেহেতু বড় বিষয়, তাই আমি প্রথমবার অল্প কিছু টাকার প্রোডাক্ট স্টক করি এবং আমার সেই বান্ধবীর চাহিদা অনুযায়ী তার ড্রেসগুলো পাঠিয়ে দেই। আমার সেই বান্ধবী ড্রেসগুলো পেয়ে অনেক খুশি হয় এবং সে আমাকে পরামর্শ দেয় যে- অনলাইনে একটা গ্রুপ খোলার জন্য।
তখন তিনি তার বান্ধবীর পরামর্শ অনুযায়ী একটা পার্সোনাল গ্রুপ ক্রিয়েট করেন তার শপের নাম অনুযায়ী। গ্রুপের নাম দেন ‘অপরাজিতা’। একই নামে একটা পেইজও খোলেন তিনি। পেজ এবং গ্রুপ খোলার পর পরিচিতদের থেকে ভালো সাড়া পান জান্নাতুল। গ্রুপ খোলার পর দুই মাসে তার পোষাক বিক্রি হয় এক লক্ষ টাকা অথচ তখন গ্রুপের সদস্য ছিল মাত্র ২৫০-এর কাছাকাছি। এভাবে গত চারমাসে শুধুমাত্র গ্রুপ এবং পেজ থেকে জান্নাতুলের পণ্য বিক্রি হয় আড়াই লাখ টাকারও বেশি। এরমধ্যে ব্লক এবং স্ক্রীন প্রিন্ট এর ড্রেস বিক্রি হয়েছে দুই লাখ টাকা। তাই তিনি তার সিগনেচার প্রোডাক্ট হিসেবে ব্লক-এর শাড়ি তৈরি করেছেন।
এছাড়াও বর্তমানে তার এই উদ্যোগে সামিল হয়েছেন পাশের বাসার প্রতিবশী থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন এবং বিভিন্ন সময়ের বন্ধু-বান্ধবরা। তার এ সফলতার সবচেয়ে বড় অংশীদার তার স্বামী। বাবা-মায়ের দোয়া এবং ভালোবাসা সবসময় জান্নাতুলকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। এছাড়াও তিনি এমন দুজন শিক্ষকদের সান্নিধ্য পেয়েছেন যাদের প্রতিটি কথা এবং কাজ তার ব্যক্তিগত জীবন ও ব্যবসায়িক জীবনের চিন্তাভাবনাকে বদলে দিয়েছে।
এনএস/