বুনো শাক-পাতায় সুখ খুঁজে ফিরেন সুখি
এমএ বশার, বাউফল
প্রকাশিত : ০৭:৫১ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ শুক্রবার
সূর্যি জাগার আগেই কুয়াশা-শীত উপেক্ষা করে বুনো শাক-পাতা খুঁজে ফিরেন সুখি। আবার বর্ষায় কাকভেজা বৃষ্টিতে ভিজেও কখনো কখনো বেড়িয়ে পড়েন তিনি গ্রামের মেঠো পথের পাশে, বিল-ঝিল, বাগান-জঙ্গলে। ঢেঁকির শাক, জংলা কচুর লতি, কলমী, হাইচা এসব বুনো শাকসবজি বিক্রির টাকায় দু’-চার দিন সংসার চলবে ভাল; অসুস্থ্য স্বামীর অষুধ জুটবে, একই সঙ্গে তার অটোরিক্সা চালনার কাজের কিছুটা উপশম হবে কেবলই এই ভরসায়। বুনো শাকসবজি বিক্রির টাকায় তার হতদরিদ্র সংসারে একটু সুখের ছোঁয়ায় বেঁচে থাকার চেস্টা পটুয়াখালীর বাউফলের মেহেন্দিপুর গ্রামের সুখি বেগমের।
ঝোপ-জঙ্গলের ঢেঁকির শাক, জংলা কচুর লতি, কলার মোচা, পুকুর-ডোবার কলমি, হেলেঞ্চা, হাইঁচার মতো বুনো শাকসবজি বিক্রি করে চলে সংসার। রাস্তার পাশে ঝোপ-জঙ্গলে কিংবা পুকুর-ডোবায় এসব বুনো শাক-লতাপাতা অনেকের কাছে জঞ্জাল মনে হলেও জীবিকার অবলম্বন তা সুখি বেগমের। প্রতিদিন তাই সে গ্রামের ঝোপ-ঝাড়, বিল-ঝিল ও রাস্তার পাশে ছুটে বেড়ায়; কোথাও উকি দিচ্ছে কি না লতাপাতার ফাকে ঢেঁকির শাক কিংবা কোথাও কলমী-হাইচা শাকের তরতর ডগা বেড়ে উঠছে কিনা কেবল তারই খোঁজে। শহর বন্দরের লোকজনের মতো সার-বিষে ফলানো শাকসবজিতে মুখ ফিরিয়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো এসব বুনো শাক-সবজির চাহিদা বেড়েছে এখন গ্রামের মানুষের কাছেও।
গ্রামের ঝোপ-ঝাড় ঘুরে ঘুরে কলাপাতায় মুড়িয়ে ঢেঁকির শাক তুলে এনে শিকদারের বাজার সংলগ্ন খালের পাড়ে অন্যের জমিতে আশ্রয় নেয়া জুপরিমতো ঘরে ফিরে এসে সুখি বেগম জানান, সুখি তার ডাক নাম। কাগজে কলমে ভাল নাম হামিদা বেগম। তবে সুখি নামে সবাই চিনলেও সুখ যেন তার জীবনে সম্পূর্ণই অধরা। ঘরে অটোরিক্সা চালক অসুস্থ্য স্বামী তার। মধ্য বয়স পাড় হয়েছে নিজেরও।
নিয়মিত স্বামীর ওষুধপত্র কেনার টাকা-পয়সা জোটে না। খালের পাড়ে স্থানীয় কাওছার সিকদার নামে একজনের পরিত্যক্ত জায়গায় আশ্রিত হয়ে কোন মতে ভিটি করে মাথা গুজেছেন। জায়গা জমির ছিটেফোটও নেই। বিয়ে করে পৃথক হয়েছে বড় ছেলে জামাল। দ্বিতীয় ছেলে কামাল পেট চালাতে পাড়ি জমিয়েছে রাজধানী শহর ঢাকায়। এরপর মেয়ে মানছুরা স্থানীয় ২৫ নং মেহেন্দিপুর সরকারি প্রাইমারি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। হাটি-হাটি পা-পা করছে ছোট আরো একটি সন্তান মুন্না। সঙ্গে আছেন সত্তোরোর্ধ মা আঞ্জুমন।
তিনি আরো জানান, নিকট আত্মীয় স্বজনদের কুট কৌশল আর যাদুটোনায় শিশু বয়সেই বাবা মমিন উদ্দীন গাজী মারা গেলে রাহী ও শাহীসহ তাদের তিন বোনের অসহায় জীবনের শুরু।
জায়গাজমিও হাতছাড়া হয় ওই আত্মীয়-স্বজন আর স্থানীয় প্রভাবশালীদের কুটকৌশলে। বছর পাঁচেক মামলা চালিয়েও উদ্ধার করা যায়নি বাবার ওই সব জায়গা-জমি। এক পর্যায়ে সব হারিয়ে বাড়ি থেকে বেড় হয়ে পথে নামতে হয় মা আঞ্জুমনসহ তাদের তিন বোনের। ঢাকায় বাসাবাড়িতে ঝি-এর কাজ, গ্রামে স্থানীয়দের বাড়িঘরে ও হোটেল সেস্টুরেন্টে ধোয়ামোছা, পানি বহন থেকে ভিক্ষা ভিত্তিতেও শৈশব কেটেছে। এর পর জীবন-যৌবন ভালভাবে বুঝে না উঠতেই ঢাকায় একজনের সঙ্গে বিয়ে হলেও সুখের দেখা মেলেনি। ছাড়াছাড়ির পর পূনরায় গ্রামে এলে দু’মুঠো খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকা আর মানসিক সুখের আশায় দ্বিতীয় বারে ঘর বাধেন স্থানীয় অটোরিক্সা চালক লিটু গাজীর সঙ্গে। কিন্তু সুখ যেন অধরাই থেকে যায় তার জীবনে। পঞ্চাশের কোটা ছুই-ছুই এই বয়সে এসে দুর্বিসহ হলেও কাকডাকা ভোর থেকেই ছুটতে হয় কলার মোচা, কচুর লতি, হেলেঞ্চা, হাইঁচা, কলমি, শাপলা কিংবা ঢেঁকির শাকেরমতো বুনোসব শাকসবজি তুলতে। সংসার চালাতে এসব শাকসবজি তুলতে পাড়ি দিতে হয় তাকে গ্রামের পর গ্রাম।
গ্রামের হাজে-বাজারে এক আটি কচুর লতি (এক কেজি) বিক্রি হয় ১৫-২০ টাকা ও কলমি শাক তিন-চার আটি বিক্রি হয় ১০-১২ টাকায়। দাম একটু বেশি থাকলেও বনজঙ্গল কিংবা ঝোপ-ঝাড় কমে যাওয়ায় আগের মতো মেলে না ঢেঁকির শাক। মেলে না কলার মোচাও। ডোবা-নালায় হেলেঞ্চা কিংবা কলমি শাকও গেছে কমে। এসব শাক-সবজি তুলে এনে স্থানীয় সিকদারের বাজার, মমিনপুর, কালামিয়ার বাজার, রাবাইয়ের বাজার, কেশবপুর চৌরাস্তার বাজারে বিক্রি করেন তিনি। তিনি জানান, করোনা কালেও সরকারি ভাতা কিংবা কোন ধরণের সাহায্য জোটেনি তার। সরকারি সাহায্য পেতে নাম অন্তর্ভূক্তিতে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা লাগে। এত টাকা নেই তার। শরীর না চাইলেও শাকপাতার সন্ধানে বের হতে হয় ঝোপ-ঝাড়ে। কিছু টাকা পয়সা হাতে থাকলে অন্যের ক্ষেতের সবাজি কিনে বিক্রির কাজও করেন মাঝে-মধ্যে। তবে করোনা কালে তাও বাজারে বিক্রি করতে দেয়া হয় নি। ওঠ-ওঠ বলে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
এক সময় সিকদারের বাজারে পরিচ্ছন্নতার কাজ পেলেও স্থানীয় কয়েকজনের কারসাজিতে সে কাজটিও কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার। লজ্জাকাতর নতুন বৌয়ের ঘোমটা পড়ার মতো ঝোপ-ঝাড়ে মাথা নীচু করা বৌ ঢেঁকির শাক ফুটতে দেখলে ভাল লাগে তার। মনে আনন্দের সঞ্চার হয় বিলের পাশের তরতর বেড়ে ওঠা হাইচা-হেলেঞ্চা ডগা কিংবা পানিতে শাপলা ফুটতে দেখলে। তবে এখন এসব বুনো শাকপাতা কমে যাওয়ায় ঘরসংসার চালাতেই অসহনীয় কস্ট হচ্ছে। করতে হচ্ছে কৃষিভিত্তিক নানা কাজও। সহোযোগিতা পেলে কম পরিশ্রমের কোন ব্যাবসা কিংবা কাজে জড়িয়ে থাকার ইচ্ছাও আছে।
সুখি বেগম বলেন, ‘প্যাড তো চালান লাগবে। ছোট মাইয়া-পোলা দুইডা আর ঘরে বুড়া মানুষটা আছে না? স্বামী হার্ডের রুগি। দু’মুঠ খাইয়া বাচোন আর একটু সুখের লইগ্যাই হাকপাতা টোহাই।’
স্থানীয় পূর্ব-চাঁদকাঠী ডিএস দাখিল মাদ্রাসার সুপার মো. জাকির হোসাইন বলেন, ‘ঘর-সংসার চালাতে সুখি বেগম বনজঙ্গলের শাকসবজি কুঁড়িয়ে বেড়ায়। আবার তা বেচতে ছুটে আসেন গ্রামের হাটে। আত্ম-সন্মান বোধের কারণে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়াচ্ছেন না। সমাজে তার মতো অসহায় নারীর প্রতি সহোযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।’
স্থানীয় ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বর মো. স্বজল সুখি বেগমের অসহায়ত্তের স্বীকার করে বলেন, ‘রুজিনা নামে তার এক ছেলের বৌ সরকারি সাহায্য ভোগি। পরবর্তিতে কোন ধরণের সুযোগ এলে সরকারি সাহায্য তালিকায় তার নাম অন্তর্র্ভূক্ত করা হবে।’
আরকে//