ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

দৃষ্টি কেড়েছিল প্রথম দিনেই

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ০৭:৫৪ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০৭:৫৮ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ শনিবার

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সতীর্থ বন্ধুদের সঙ্গে প্রয়াত অভিনেতা আব্দুল কাদের (বাঁ-দিক থেকে দ্বিতীয়)। 

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সতীর্থ বন্ধুদের সঙ্গে প্রয়াত অভিনেতা আব্দুল কাদের (বাঁ-দিক থেকে দ্বিতীয়)। 

সুবেশ সুবিন্যস্ত চুলের মানুষটি দৃষ্টি কেড়েছিল দেখার প্রথম দিনেই। ১৯৬৯ সালের শীতের এক সকাল। আমাদের প্রথম ক্লাস বিশ্ববিদ্যালয়ে। আঙ্কিক অর্থনীতির ক্লাস- পড়াবেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ২০২৮ নম্বর কক্ষে। সেদিনই প্রথম দেখা ও পরিচয়। প্রথম দেখাতেই ওর যে দু’টো জিনিস আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল, তা হচ্ছে- একরাশ সুবিন্যস্ত চুল এবং একটি ভুবন-ভোলানো হাসি। আজ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে আমার সতীর্থ বন্ধু আবদুল কাদেরের চলে যাওয়ার সংবাদে সব ছাপিয়ে ঐ দু’টো বিষয়ই বারবার উঠে আসছিল আমার স্মৃতিতে।

আসলে যত হালকাভাবেই বলি না কেন, এক অর্থে ও দুটো জিনিসই কাদেরের ব্যক্তিত্ব বুঝতে সাহায্য করে। ওর সুবিন্যস্ত চুল (অভিনয় ব্যতীত ওর চুল কেউ বোধহয় অবিন্যস্ত দেখেনি) বোধহয় ওর গোছালো ব্যক্তিত্বের প্রতীক ছিল। গুছিয়ে কথা বলত- শান্ত স্বরে এবং বড় মায়াময় ভঙ্গীতে। ছাত্রজীবনেও ওর পোশাক-আশাক দেখে ওকে ‘এক সুবেশ ভদ্রলোক’ বলে মনে হতো আমার।

আর ওর সেই শুভ্র দন্তরাজির হাসি? সেই ভুবনমোহিনী হাসির কাদেরের হৃদয়ের স্বচ্ছতা, অন্যের প্রতি মমতা আর মনের বিশালতাই উদ্ভাসিত করতো। এবং সে হাসি ছিল সংক্রামক। কাদেরের হাসি আমাদেরও হাসিয়েছে এবং সেই সঙ্গে আমাদের মন ভালো করে দিয়েছে। সে সব হাসাহাসির মধ্যে বড় অংশ জুড়ে থাকতো নানান হাস্যরসিকতা। সে সব গল্প-আড্ডার জায়গা ছিল কলাভবনের তৃতীয় তলা, মহসীন হলের প্রবেশদ্বার আর লাইব্রেরীর চত্বর।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরেও কাদেরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। অনেকের হয়তো মনে আছে- এলিফেন্ট রোডের ‘বাটা’র দোকানে কাদের কর্মাধ্যক্ষ ছিল কিছুদিন। ঐ যে চৌরাস্তার মোড়ের বড় বাটা- ভোজ্য তেলের গলির উল্টোদিকে। আমার শিশুকন্যাদের নিয়ে জুতো কিনতে গেলে কি যে যত্ন-আত্তি কাদেরের। আমার কন্যারা ওকে দেখলে মিটিমিটি হাসতো- টেলিভিশনে কাদেরের কোনও কৌতুককর অভিনয়ের কথা মনে করে। বেনু ওদের সামাল দিতে চেষ্টা করতো। বেনুকে কাদের ওর পোশাকী নাম ‘রাশেদা’ বলে ডাকতো।

আসলে কাদের যে কত বড় এক শক্তিমান অভিনেতা হবে- বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি কিন্তু তা বুঝতে পারি নি। সেটা বুঝেছি আশির দশকে উচ্চশিক্ষা সমাপান্তে বিদেশ থেকে ফিরে এসে। কাদের তখন মঞ্চ ও টেলিভিশন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। শক্তিমান এক চরিত্রাভিনেতা -খল চরিত্র থেকে কৌতুকাভিনেতার চরিত্র সে সমান দাপটের সঙ্গেই করতো। নায়কও হয়েছে হয়তো বেশ ক’টি নাটকে। ফেরদৌসী ফুপু (ফেরদৌসী মজুমদার) থেকে মামুন ভাই (প্রয়াত আবদুল্লাহ আল মামুন), জাকারিয়া ভাই (প্রয়াত মোহাম্মদ জাকারিয়া) থেকে ডলি জহুরের সঙ্গে সে সমানতালে অভিনয় করে গেছে। আমরা গর্বিতভাবে পরিচয় দিতাম যে অভিনেতা আবদুল কাদের আমাদের বন্ধু।

আশির দশকে আমাদের ঘণিষ্ঠতা বেড়েছিল। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই এবং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। নাটক পাড়ায় নাটক দেখতে গেলে দেখা হতো, ফেরদৌসী ফুপু ও রামেন্দু কাকার (রামেন্দু মজুমদার) বাড়ীতে কথা হতো, রামপুরার টেলিভিশন ভবনেও সাক্ষাৎ মিলেছে বেশ ক’বার। হয়তো কোনও প্রযোজকের ঘরে- হয়তে সে নাটক শেষে বেরিয়ে আসছে, হয়তো আমি আমার অনুষ্ঠান করতে স্টুডিও তে ঢুকছি। দ’দণ্ড দাঁড়িয়েছি, কুশল বিনিময় করেছি, কথা বলেছি। পেছনে তাড়া দিয়েছেন আমার অনুষ্ঠানের প্রযোজক হামিদ ভাই (ম. হামিদ), বা বেলাল (আল-মনসুর) কিংবা আলী-ইমাম।

কাদেরের চলে যাওয়ার সংবাদটি শুনে সকাল থেকেই মনে হচ্ছিল- ‘এতো অকালে ক্যানো?’ মনে হচ্ছিল সতীর্থ ৬৯-এর আর একজনের ছুটি হয়ে গেলো। মনের মধ্যে ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’ কথা কইছে জীবনানন্দের ক’টি পংক্তি:

‘কোথায় গিয়েছে তারা?
ঐ দূর আকাশের
লাল নীল তারার ভিতরে
অথবা
মাটির ভেতরে মাটি হয়ে আছে শুধু -
ঘাস হয়ে আছে শুধু ঘাসে?
শুধালাম - উত্তর দিল না কেউ
উদাসীন অসীম আকাশে।’

এনএস/