ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

সাতকানিয়ার ভূমি অফিসগুলোতে দালালের দৌরাত্ম

সাতকানিয়া প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ০৬:২১ পিএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ সোমবার

চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার বিভিন্ন ভূমি অফিসে বেড়েছে দালালদের দৌরাত্ম। খতিয়ান, খাজনা পরিশোধ, মিসকেস, খাস পুকুর ইজারা, হিয়ারিং ইত্যাদি দালালরা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বলে জানা গেছে। 

শুধু তাই নই সাতকানিয়া উপজেলা  ভূমি অফিস ও ইউনিয়ন অফিস গুলিতে দালাল না ধরে সরাসরি কোন সেবাপ্রার্থী  অফিসে গেলে সাধারণ মানুষকে পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি। এবং ব্যয় করতে হয় মূল্যবান সময়।

সাতকানিয়া উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বদলি হয়ে অন্যত্র গেলেও দালালরা রয়ে যায় বহাল তবিয়তে। তাদের বিরুদ্ধে ভূমি অফিসের কর্তা কর্তৃক কখনো কোন ব্যবস্থা হয়েছে এরকম কোন নজির সাতকানিয়ায় নেই বল্লেই চলে।
শুধু তাই নই!কোনো কোনো কর্মকর্তা দালালদের বিষয়ে প্রথম-প্রথম লোক দেখানো লম্ফঝম্ফ করলেও কিছুদিনের মধ্যেই অদৃশ্য কারণে সব থেমে যায়। 

এ কারণে কাজ উদ্ধারের স্বার্থে সাধারণ মানুষ দালালদের হাত ধরে ভূমি অফিসে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এরই মাধ্যমে উপজেলা ভূমি অফিসহ ইউনিয়ন ভূমি অফিস গুলোতে ধীরে-ধীরে ডালপালা বেড়েছে দালালদের। উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে দালালদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। আর হয়রানী থেকে রক্ষা পেতে ভূক্তভোগীরা দালাল ধরে সহজে কাজ করে নেন বলেও জানা গেছে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাতকানিয়া উপজেলা ভূমি অফিসকে ঘিরে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেট। জানাগেছে এই দালাল চক্রের নেপথ্যে রয়েছে সরকারদলীয় উপরের লেভেলের বেশকয়কজনের আশীর্বাদ।তাই সাধারণ মানুষ ভূমি অফিস গুলোতে সেবা নিতে গিয়ে অফিসার ও দালালদের আলাদা করতে না পেরে বিভিন্নমুখী  প্রতারণার শিকার হয়ে থাকেন বলে ও জানা যায়, অন্যদিকে ভূমি অফিসের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর কাছে সেবাপ্রত্যাশী মানুষ সহযোগিতা চাইলে তারা দালালদের কাছে পাঠিয়ে দেন বলেও জানা যায়। দালালদের সঙ্গে চুক্তি না করে ভূমি অফিসের সেবা পাওয়া দুষ্কর। ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা দালালদের ব্যবহার করে নিজেদের পকেট ভারী করছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভূক্তভোগীরা জানান।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে আরও জানা যায়, উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে একই ষ্টেশনে কর্মরত আছেন। দীর্ঘদিন একই এলাকায় অবস্থানের কারণে স্থানীয় দালালদের সঙ্গে তাদের একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ভূমি কর্মকর্তারা দালালদের ব্যবহার করছেন অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন দালালরা লাভবান হচ্ছে অন্যদিকে টাকার পাহাড় গড়ছেন ভূমি অফিসের কর্তারা। ভূমি অফিসের কর্তাদের আস্কারা পেয়ে দালালরা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে এবং কোনো প্রকার নিয়মনীতি তোয়াক্কা করছে না। জমি খারিজের জন্য ১ হাজার ১৭০ টাকা গ্রহণের নিয়ম থাকলেও এ কাজের জন্য ১৫-২০ হাজার টাকা গ্রহণ করা হয় বলে ভূক্তভোগীরা জানান। এছাড়া খাজনা পরিশোধ, মিসকেস, খাস পুকুর ইজারা, হিয়ারিং ইত্যাদি বিষয়ে দালালরা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বলে সূত্রে জানা গেছে।

উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ঘুষ-বাণিজ্যের বিষয়ে সবারই জানা তারপরও কোনো ব্যবস্থা  নেয়া হয় না। ভূমি অফিসে দালালি করে অনেকে কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। এলাকার কিছু টাউট বাটপার এই ভূমি অফিসকেই একমাত্র রুটি রোজগারের মাধ্যম হিসেবেই বেছে নেন।

আরো জানা গেছে, সাতকানিয়ার দেওদীঘি ইউনিয়ন ভূমিকর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়  নামজারী জমাভাগের প্রস্তাব দাখিলের বিষয়ে অনিয়ম  দূর্নীতি করার অভিযোগ ওঠলে ও উপজেলা ভূমি অফিস কখনো সেই অভিযোগ পুনরায় তদন্ত করেছেন বলে নজির নেই।

নিয়ম অনুযায়ী নামজারী জমাভাগ মামলায় উপজেলা ভূমি অফিস প্রস্তাব পাঠানোর জন্য আদেশ দিলে দেওদীঘি  ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর্তারা সেটা মাঠ পর্যায়ে তদন্ত না করেই রিপোর্ট দিয়ে দেয়,ফলে অনেক নিরীহ জনগনকে অসহায় হয়ে বসতে হয় পথে।

শুধু তাই নই! এদিকে সাতকানিয়া উপজেলা ভূমি অফিসের সামনে একটি টং এর চায়ের দোকানে সারাদিনই ভূমি অফিসের তালিকাভূক্ত দালাল কাজের আশায় চা খেয়ে খেয়ে বসে থাকেন। তাই অনেকেই এই টং এর চায়ের দোকানকে নাম দিয়েছেন ভূমি অফিসের নিজস্ব দালালদের চায়ের দোকান। তবে মাঝে মাঝে এই ঝুঁপড়ি চায়ের দোকানে সাতকানিয়া থানার কয়েকজন এসআই আর এএসআই থানার শালিশী বৈঠক ও করতে  দেখা যায়।

সবমিলিয়ে ভূমি অফিসের দালাল আর থানার নিজস্ব দালালদের জন্য এই ঝুঁপড়ি টং এর চায়ের দোকানটিই অনৈতিক অর্থ লেনদেনের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। 

আরো জানাগেছে, উপজেলা ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের ও যোগসাজেশে যদি কোন নামজারী খতিয়ান সৃজিত হয়, আর সেই খতিয়ানে অসন্তুষ্ঠি প্রকাশ করে কেউ মিসমামলা করলে সেই মিসমামলার নথিশুদ্ধ গায়েব হয়ে যায়! আর সেই গায়েবকৃত নথি সেবাপ্রার্থীদের দিতপ পেরেছেন বলে ও তার কোন ইতিহাস নেই। সবমিলিয়ে দালাল আর কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনৈতিক সম্পর্ক এই ভূমি অফিসে নিবিড়!

এই সাতকানিয়া ভূমি অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা  দিনশেষে  সরকারি নিয়মে অফিস বন্ধ করে বাসায় ফিরেনা ,তারা দালালদের জন্য স্পেশালী ভূমি অফিস খোলা রাখে  রাত ১০টা পর্যন্ত,এখানে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলেই বাড়তে থাকে দালালদের ভীড়!

দালালদের হাত না ধরলে সাতকানিয়া ভূমি অফিসের কোন নথি ও দেখা যায় না,  এমন কী নথি অদৃশ্যকারনে গায়েবও হয়ে যায়, কথা হয় তুলাতলীর তেমন একটি মিসমামলা ৫১৯/২০১৯ নং এর বাদীর সাথে তিনি বলেন, এই নথিটা দীর্ঘ দেড় বছরে ও দেখাতে পারেনি সাতকানিয়া ভূমি অফিস! সরেজমিনে গিয়ে সেই কথার সত্যতা ও পাওয়া যায়।

দালাল না ধরার কারনে ভূমি অফিস থেকে নিজের নথি দেখতে সময় লাগে ৩মাস এমন একটি বিষয় ও তদন্তে ওঠে এসেছে, ১৫৮/২০১৯ একটি নামজারী জমাভাগের নথি দেখার জন্য ভুক্তভোগীরা সাতকানিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে আসছে আর যাচ্ছে, রেকর্ডকীপার আশরাফ নবী বলেন, আজ ও দেখছি কিন্তু পাচ্ছিনা। তবে কেন কি কারনে নথি কই গেলো এসবের উত্তর দিতে পারছেননা সাতকানিয়া উপজেলা ভূমি অফিস। তবে ভুক্তভোগীরা বলেন,দালাল না ধরার কারনেই এরকম এরকম ইচ্ছা করেই কষ্ট দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

এদিকে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুস সালাম চৌধুরী বলেন,আমি খুব শীঘ্রই দালালদের তালিকা করে এদেরকে ভূমি অফিস থেকে বিতাড়িত করে,  প্রকৃত সেবাপ্রার্থীদের জন্য নিরাপদ ভূমি অফিস গড়ে তোলব। এবং দালালদের কাছে যাতে সেবাপ্রার্থীরা না যায় সেই বিষয় ও খেয়াল রাখতে হবে।

এদিকে সাতকানিয়া সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সৈয়দ আক্কাস উদদীন বলেন,সাতকানিয়াবাসীর আগামীর ভবিস্যৎ নির্মানে দালালদের বিতাড়িত করার কোন বিকল্প নেই।

আর না হয় জায়গাজমিতে অনেক ঝামেলা লেগেই থাকবে। সুতরাং আমি ইউএনও আব্দুস সালাম চৌঃ এর  দালালদের তালিকা তৈরীর যে উদ্যোগ আমি সেই   উদ্যোগকেই স্বাগত জানাই।

আরকে//