কুড়িগ্রামে বন্যার ক্ষতি কমাতে বিকল্প চাষাবাদ
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ০৪:২৪ পিএম, ২ জানুয়ারি ২০২১ শনিবার
পর পর পাঁচ দফা বন্যায় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে কুড়িগ্রামে কৃষির উপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো। ক্ষতি কমাতে পুরুষরা অন্য জেলায় বেড়িয়ে পরেছেন কাজের উদ্দেশ্যে। অপরদিকে নারীরা লেগে পরেছেন বিকল্প চাষাবাদে। অনটন আর সংসারের চাহিদা মেটাতে গৃহিনীরা এখন হয়েছেন কৃষানী।
সরেজমিনে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সুভারকুটি গ্রামে ঘুরে দেখা গেল নারী কৃষানীদের কর্মযজ্ঞ। ৫ দফা বন্যায় নষ্ট হয়ে যাওয়া ধানক্ষেতে কেউ লাগিয়েছে শশা, কেউ সিম, কেউ কুল বড়ই, পেঁপেসহ নানান সবজি।
সেপ্টেম্বরে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ২৫ শতক জমিতে শশা লাগিয়েছিলেন মেঘনা বেগম। তিন মাসে শশা বিক্রি যোগ্য হয়ে গেছে। আজ ২ হাজার ৮শ’ টাকার শশা বিক্রি করলেন তিনি। এই সবজি চাষে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। তিনি আশা করছেন ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকার শশা বিক্রি করতে পারবেন। তাহলে ৪০ হাজার টাকা আয় করতে পারবেন তিনি।
প্রতিবেশী আমিনা বেগম জানালেন, বন্যায় স্বামীর বাড়িভিটা ভেঙে যাওয়ায় বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। বিভিন্নভাবে ঋণ করে বাবার ৬০ শতক জমিতে আপেল কুল, পেঁপে, মরিচ ও বেগুন লাগিয়েছেন। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। স্বামীর ৩০ শতক জমিও বন্দক রাখতে হয়েছে তাদেরকে। এবার ধান চাষ করে অনেক টাকা লোকসান গুণতে হয়েছে তাকে। ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে এবার বিকল্প চাষবাস করে নিজের মাথা গোঁজার জন্য জমি কেনার স্বপ্ন দেখছে তিনি। এই সংকটময় সময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বেসরকারি সংস্থা আরডিআরএস বাংলাদেশ।
নারী কৃষানীদের সহযোগিতায় তারা ১৩ হাজার নারীকে প্রশিক্ষণসহ ২ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষি পুনর্বাসনের অর্থ সহযোগিতা দিয়েছে। এর সাথে অন্যান্য ঋণ করে ভাগ্য বদলাতে চাইছেন তারা।
হলোখানা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার গোলজার হোসেন জানান, ‘দিনকাল বদলে গেছে। বাড়ির বউ-ঝিরা এখন শুধু ঘরের কাজ নয়, স্বামীর সাথে কৃষি কাজেও হাত লাগাচ্ছে। আবাদ কিভাবে করতে হয় তা জেনেছে তারা। ফলে এখন পুরুষবা জমি তৈরি করে অন্য জেলায় চলে যান কাজের আশায়। আর বউ-ঝিরা কোমড় বেঁধে লেগে পরেন আবাদ-কিস্তিতে।’
এই গ্রামের ইতি বেগম জানান, ‘এই এলাকায় কখনো বন্যা হতো না। গত ২০১৭ সাল থেকে বন্যা হচ্ছে। এবার ৫ দফা বন্যায় তিনবার বীজতলা ও ধানক্ষেত বিনষ্ট হয়েছে। এতে লোকসান হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার টাকা। আরডিআরএস থেকে পুনর্বাসনের জন্য প্রায় ১২ হাজার টাকা পেয়েছেন। তার সাথে নিজের কিছু অর্থ দিয়ে ৩০ শতক জমিতে সিম লাগিয়েছেন। সিম বিক্রি করে লোকসান পূরণ করতে চাইছেন এই কৃষানী।’
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের শুধু সুভারকুটি গ্রাম নয়। বন্যা কবলিত পাঁচগাছী, যাত্রাপুর ও উলিপুর উপজেলার বজরা এবং বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের কৃষানীরা এখন বিকল্প চাষাবাদ করে ভাগ্য বদলানোর স্বপ্ন দেখছেন।
উলিপুরের বজরা ইউনিয়নের খামার বজরা মুন্সিপাড়া গ্রামের প্রতিবন্ধী হাসিনা বেগমের মুখে হাসি ফুটেছে একটি সেলাই মেশিন কিনে। বিভিন্নভাবে প্রকল্প থেকে প্রায় ২২ হাজার টাকা পেয়ে সেলাই মেশিন কিনেছে সে। সেটা দিয়েই ভাগ্য বদলাতে চেষ্টা করছে সে। তার এই কর্মকাণ্ডে খুশি এলাকার মানুষ।
পার্শ্ববর্তী কালপানি বজরা ব্যাপারী পাড়া গ্রামের শিউলী বেগম ২০১৮ সালে পুনর্বাসনের জন্য ১১ হাজার ৬শ’ টাকা পান। তার সাথে নিজের কিছু অর্থ যোগ করে একটি বাছুর কিনেছিল। এখন তার ঘরে ৩টি গরু ও একটি বাছুর রয়েছে। গাভীটি দুধ দিচ্ছে। তা বিক্রি করে পরিবারে সহযোগিতা করছে সে।
বাস্তবায়নকারী সংস্থা আরডিআরএস’র প্রকল্প সমন্বয়কারী তপন কুমার সাহা জানান, ‘আর্থিক অন্তর্ভূক্তি ও উন্নতিকরণের মাধ্যমে নারী ও যুবাদের ক্ষমতায়ন’ প্রকল্পের মাধ্যমে কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছী, যাত্রাপুর ও উলিপুর উপজেলার বজরা এবং বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে ১৩ হাজার নারী ও যুবাদের আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি ক্ষমতায়নে কাজ করা হচ্ছে। এতে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থ্যা ট্রিকেলাপ ও মেডলাইট ফাউন্ডেশন। এতে কারিগরি সহযোগিতা করছে কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড।’
হলোখানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উমর ফারুক জানান, ‘সমাজে বেকার বসে থাকা নারী ও যুবাদের এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার ফলে তারা নিজেদের উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক বিভিন্ন সচেতনতামূলক কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছে। কিছু নারী ও যুবা এই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য বদলে সফলতা দেখিয়েছে।’
এআই/