ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৫ নভেম্বর ২০২৪,   কার্তিক ২১ ১৪৩১

করোনা এবং ‘প্রফেসর লকডাউন’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৪:২৬ পিএম, ৫ জানুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৪:২৯ পিএম, ৫ জানুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার

ইংল্যান্ডের ইম্পিরিয়াল কলেজের অধ্যাপক নীল ফার্গুসন ব্রিটিশ সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি একটা গাণিতিক মডেল করেছেন। সেই মডেল অনুসারেই ভবিষ্যদ্বাণী করেনগত জানুয়ারি মাসে (২০২০) প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে সতর্ক করে তিনি বলেছিলেন, “লকডাউন না করলে করোনায় পাঁচ লাখ ব্রিটিশ নাগরিক মারা যাবে! আর আমেরিকায় ২০ লাখ মানুষ মারা যাবে।

তার কথা অনুসারে ইংল্যান্ড-আমেরিকা সরকার লকডাউন ঘোষণা করে। তাদের অনুসরণ করে বাকি পৃথিবীতার নামেই হয়েছেপ্রফেসর লকডাউন কিন্তু প্রফেসর লকডাউনের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত করল সুইডেন! ফার্গুসন তখন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘সুইডেন লকডাউন আরোপ না করায় মে মাস নাগাদ সে দেশে ৪০ হাজার মানুষ করোনায় মারা যাবে। জুন মাসে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াবে এক লাখ ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত সুইডেনে মারা গেছেন হাজার ৮৯২ জন মাত্র। যেখানে জুন মাসের মধ্যেই এক লাখ লোক মারা যাবে বলে এইপ্রফেসর লকডাউন’ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন লকডাউনের প্রবক্তা এই অধ্যাপককে সহকর্মীরা নাম দিয়েছেন দ্য মাস্টার অব ডিজাস্টার। তাকে প্রফেসর অব ডিজাস্টার বলা উচিৎ কারণ, উনি এই ভবিষ্যদ্বাণী করেই বিখ্যাত হয়েছেন

২০০১ সালে ব্রিটেনে গবাদি পশুর কয়েকটি ফার্মে সংক্রামক রোগ ধরা পড়ে। তখন সরকারি উপদেষ্টা ছিলেন প্রফেসর ফার্গুসন তার ম্যাথমেডিকেল মডেল অনুসরণ করে ব্রিটেনে ৭৫ লাখ গরু, ভেড়া এবং শূকর মেরে ফেলা হলো। যে ফার্মে কোনো আক্রান্ত পশু পাওয়া গেছে সেই ফার্মের বাকি সব পশু তো বটেই আশপাশের যত ফার্ম ছিল সেগুলোরও সব পশু হত্যা করা হয় ১০ বছর পর বিজ্ঞানীরা জানানইট ওয়াজ রং এন্ড আননেসেসারি শুধু আক্রান্ত পশুগুলোকে মেরে ফেললেই হতো!

এই গেল পশুর ওপরে ২০০৩ সালে বার্ড ফ্লু দেখা দিল। প্রফেসর ফার্গুসন প্রেডিক্ট করলেন পৃথিবীতে ১৫ কোটি মানুষ মারা যাবে বার্ড ফ্লুতে ২০০৯ সালে গিয়ে দেখা গেল সারাবিশ্বে ছয় বছরে এই ফ্লুতে মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র ২৮২ জন!

২০০৯ সালে এলো সোয়াইন ফ্লু প্রফেসর ফার্গুসনের পরামর্শ অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার বিবৃতি দিল- সোয়াইন ফ্লুতে রিজনেবল ওর্স্ট কেস সিনারিও হলো ব্রিটেনে ৬৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হবে শেষ পর্যন্ত দেখা গেল মারা গেছে মাত্র ৪৫৭ জন!

এবারও প্রফেসর লকডাউনের এই মডেল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কারণ এই মডেল তৈরি করার জন্যে তিনি যে কোড ব্যবহার করেছেন তা ১৩ বছরের পুরনো এবং ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা যখন তার মডেল প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন, দেখা গেছে তাদের রেজাল্ট আর ফার্গুসনের রেজাল্টের মধ্যে বিশাল ব্যবধান থাকছে

শুরুতে আমাদেরকে বলা হয়েছিল বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে এবং এই যে লাখ লাখ, কোটি কোটি মানুষ মারা যাবে এই আতঙ্কের প্রচার সোনাভানের পুঁথি ছাড়া আর কিছু না সোনাভানের পুঁথিতে বলা হয় লাখে লাখে ফৌজ মরে কাতারে কাতার, শুমার করিয়া দেখি সাড়ে পাঁচ হাজার কিন্তু ঢাকা শহরে প্রায় আড়াই কোটি লোক বসবাস করেন এর মধ্যে মারা গেছে ছয় হাজার লোক, সারা দেশে সাড়ে সাত হাজার মানুষ

যদি ঢাকা শহরের আড়াই কোটি মানুষের মধ্যে সোয়া কোটি মানুষের করোনা সংক্রমণ হয়ে থাকে আর মৃতের সংখ্যা যদি ছয় হাজার হয় সেটা পরিমাণে খুব বেশি কী? ইনফ্লুয়েঞ্জাতেও তো শীতকালে এর চেয়ে বেশি লোক মারা যায় সারা পৃথিবীতে

মাইক ইডন ফাইজারের প্রাক্তন প্রধান বৈজ্ঞানিক গবেষণা কর্মকর্তাফাইজার হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ওষুধ কোম্পানি তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, হাসপাতালে ভর্তি মৃত্যুর পরিসংখ্যান যাচাই করে বলা যায়, ব্রিটেনে মহামারির পর্ব সমাপ্ত হয়েছে।

গত ৭ অক্টোবর আমেরিকান সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তাতে দেখা গেছে যে, লাখ ৯৬ হাজার ৬৯৯ জনের ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণকরোনালেখা হয়েছে কিন্তু মৃত্যুর একমাত্র কারণকরোনাডেথ সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে এমন রোগীর সংখ্যা এগার হাজারের কম। বাকি রোগীরা আগে থেকেই দুটো থেকে তিনটা জটিল রোগে ভুগছিলেন

বাকি যারা মৃত অর্থাৎ লাখ ৯৬ হাজার ৬৩৩ জনের মধ্যে ১১ হাজার বাদ দিলে লাখ ৮৬ হাজার ৬৩৯ জন- এদের প্রত্যেকের গড়ে দুটো থেকে তিনটা জটিল রোগ আগে থেকে ছিল অর্থাৎ হয় হাই ব্লাড প্রেসার, হার্টের প্রবলেম, কিডনির প্রবলেম, ডায়াবেটিস- এই চারটা রোগের যে কোনো দুটো বা তিনটে রোগে সে আগে থেকে ভুগছিল

এখন যদি বলি শুরুতে এই আতঙ্ক প্রচারের মূল উদ্দেশ্য ছিল সারা পৃথিবীর মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, একা করে দেওয়া, সে যাতে কানেক্টেড না থাকতে পারে। আপনজন যেন আপনজন থেকে দূরে সরে যায় তাহলে যারা বিলাসী পণ্যের ব্যাপারী, ভার্চুয়াল জগতের যারা ব্যাপারী তারা ভালো ব্যবসা করতে পারবে

লকডাউনের সময় আমেরিকাতে কি বেজোসের ফ্যাক্টরি বন্ধ ছিল, না তার ট্রান্সপোর্ট বন্ধ ছিল, না তার মাল সরবরাহ বন্ধ ছিল? আমাজন বন্ধ ছিল? বরং আমাজন ফুলেফেঁপে উঠেছে বলা হয়েছিল মানুষ নাকি মারা যাবে! আমাজন কর্মীদেরকে তো ছুটি দেয়া হয়নি।

আমরা যদি দেখি, এক সময় যে মানুষ টিভি দেখতো না, যে মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করত না, এখন তাকেও স্মার্টফোন/টিভির আসক্ত বানিয়ে ফেলেছে

কারণ মানুষ তো বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। মানুষ সবসময় যোগাযোগ করতে চায় যদি সে বাস্তবে করতে না পারে কোনো না কোনোভাবে- যেমন একজন মানুষ সবচেয়ে খুশি হয় সামনাসামনি দেখা হচ্ছে এটাতে এইটা যখন হবে না তখন ফোনে কথা বলা যায় তারপর আজকাল তো নেটের মাধ্যমে চেহারাও দেখা যায়চেহারাও দেখা যাচ্ছে না, কথাও শোনা যাচ্ছে না- তখন সে কী করবে? তখন সে বিকল্প খুঁজবে, তখন সে নেটফ্লেক্স ছবি দেখবে।

অভিজ্ঞজনেরা বের করেছে যে ঢাকা শহরে ৫০ শতাংশ সংক্রমিত হয়ে গেছেঅর্থাৎ আক্রান্ত হয়ে সুস্থ্য হয়ে উঠেছেন। বছরে এক আধবার ফ্লু হবে না, একটু হাঁচি দেবেন না, একটু কাশি দেবেন না, একটু জ্বর আসবে না, আমার জ্বর আসছে একটু বলতে পারবেন না! দেশে ৫০% সংক্রমিত হয়েও মারা গেছে মাত্র হাজার ৫০০! তো ফ্লু নিয়ে তো আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নাইআমরা হচ্ছি দক্ষ জাতি আমেরিকানদের চেয়ে আমরা দক্ষ জাতি, ইংরেজদের চেয়ে আমরা দক্ষ জাতি।

বাস্তব সত্য হচ্ছে- করোনা ভাইরাসে যারা আক্রান্ত হন, তাদের ৮১ শতাংশ মাইল্ড অসুস্থ হন। যেটার জন্যে হাসপাতালে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন হয় না! ১৪ শতাংশ অসুস্থ হন, তাদেরকে হাসপাতালে নিতে হয়। বাকি শতাংশ ক্রিটিকেল বা জটিল। ইনটেনসিভ কেয়ারে নিতে হয়। তাদের অক্সিজেন সাপোর্ট লাগবে। এটা হচ্ছে নিউইয়র্ক টাইমসের গত ১৮ মার্চের রিপোর্ট। তাহলে যেই রোগের ৮১ শতাংশের জন্যে হাসপাতালেও নেয়ার প্রয়োজন হয় না; মাইল্ড, সেটাকে সর্দি-কাশি-জ্বর মানে ফ্লু ছাড়া আর কী বলা যায়!

রোগ যেমন কিছু কিছু বছর পর পাল্টায়, আতঙ্কটাও তেমনি কিছু কিছু বছর পর পর শুরু হয়। আর বাস্তব সত্য হচ্ছে যে, করোনা ভাইরাসের নামে যে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে, এটা ফ্লুরই একটি ভ্যারিয়েশন। যেটা কখনও সার্স নামে, কখনও সোয়াইন ফ্লু নামে, কখনও আরেক ফ্লু নামে- বিভিন্ন সময়ে নতুন নামকরণ নিয়ে আসে। কারণ প্রত্যেকটা রোগের ধরন কিছু কিছু বছর পরে পাল্টায় এবং আতঙ্কটাও এই কিছু কিছু বছর পরে শুরু হয়। যখন একটা নতুন নামকরণ করা যায় তখন।

মনে করা হচ্ছে, ভারতে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ হুমকি সবচেয়ে বেশি। ৩০ কোটি লোক আক্রান্ত হতে পারে! কিন্তু, ভারতে বাস্তবে কতজন আক্রান্ত হয়েছে?

আসলে আমরা যেটাকে জ্বর-সর্দি-কাশি বলি, ইউরোপ-আমেরিকাতে এটাকেই ফ্লু বলা হয়, ইনফ্লুয়েঞ্জা বলা হয়। অর্থাৎ এই জিনিসটা হচ্ছে নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, শীতকালের রোগ। শীত আসা এবং শীত যাওয়ার সময়। আমরা যদি দেখি, ২০১৬-১৭ সালে মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে দুই কোটি ৯০ লাখ মানুষ। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে পাঁচ লাখ জনকে, মারা গেছে ৩৮ হাজার।

আসলে সচেতনভাবে শুধু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত যে শুদ্ধাচার সেটা যদি আমরা অনুসরণ করি, মাস্ক ব্যবহার করি আর দেশে-শুনে জাঙ্কফুড না খেয়ে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করি। তাহলে সংকট আমাদেরকে কিছুই করতে পারবে না। আর যেটা ডক্টররা বলছেন, সরকার বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছেন যে- সচেতন হতে, সতর্ক থাকতে। তাহলে সমস্যা থাকে না।

বাঙালির যেটা সবচেয়ে বড় শক্তি সেটা হচ্ছে, আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। যে কোনো সংকট কাটিয়ে ওঠার যে ক্ষমতা, আমাদের যে ব্রেন পাওয়ার, সবসময় দুর্যোগের মধ্যে আমরা বসবাস করে আসছি, দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের কোনো জুড়ি নেই। কারণ আমরা বীরের জাতি, আমরা সাহসী জাতি এবং এই জাতির করোনাকে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। সুতরাং আমরা শুধু সতর্কতামূলক যে ব্যবস্থা, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

একটা গল্প দিয়ে লেখা শেষ করছি। আমাদের দেশের প্রখ্যাত বাঘ শিকারি পচাব্দী গাজীর গল্প। পচাব্দী গাজী ৬৫টি বাঘ মেরেছিলেন। তার বাবা বাঘ শিকারি ছিলেন। তার দাদাও বাঘ শিকারি ছিলেন। দাদাও বাঘের হাতে মারা যান। বাবাও মারা যান বাঘের হাতে। তার এক বন্ধু একদিন তাকে বলল, বাঘকে তোর ভয় করে না? তোর বাবাকে তো বাঘে খেয়েছে। তোর দাদাকেও তো বাঘে খেয়েছে। তারপরও তোর বাঘকে ভয় করে না? সে বলে, না।

এবার পচাব্দীর পালা। পচাব্দী তাকে জিজ্ঞেস করছে, আচ্ছা! তোর বাবা কীভাবে মারা গেছেন? বন্ধু বলল, বাবা রাতে বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল ভালো মানুষ। সকালবেলা দেখি মারা গেছে।

বলে যে, তোর দাদা কীভাবে মারা গিয়েছিল? যে, দাদাও রাতে বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল। সকালবেলা দেখি মারা গেছে। এবার পচাব্দী তাকে জিজ্ঞেস করলো, দেখ! তোর বাবাকে বিছানা খেয়েছে। তোর দাদাকেও বিছানা খেয়েছে। তুই কি এখনো রাতে বিছানায় ঘুমাস? তোর বিছানাকে ভয় করে না?

আসলে মৃত্যু যখন আসার তখন আসবে। আর মৃত্যু যখন আসবে বিছানায় শুয়ে থাকলেও মারা যাবে। ১৮ তলা এপার্টমেন্টের ভেতরে থেকেও মারা যাবেন, বেরোনোর সুযোগ পাবেন না। ওখান থেকেই আপনার লাশ নামিয়ে আনা হবে। আর মৃত্যু যদি না থাকে রাস্তায় বের হন! কিচ্ছু হবে না।

এএইচ/