ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

স্বাধীনতার স্বদেশ আগমন

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

প্রকাশিত : ০১:১৮ পিএম, ১০ জানুয়ারি ২০২১ রবিবার

৪৯ বছর আগের এই শুভদিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতা হিসেবে বীরের বেশে বহুমূল্যে কেনা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলেন। অথচ তিনি যে ফিরবেনই তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, পরাজিত দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের লজ্জা শুরু। কিন্তু বিজয়ী জাতি বাঙালির মনে জন্ম নেয় চরম উৎকণ্ঠা। ন্যায়নীতি, সভ্য আচরণের কোনো মানদণ্ডেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর ওপর ভরসা করার উপায় ছিল না। তাই ৮ জানুয়ারি ১৯৭২, পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও লন্ডনের পথে উড্ডয়নের মুহূর্ত পর্যন্ত ২৩টি দিন যেন আমাদের জন্য অনন্তকালের প্রতীক্ষাসম হয়ে ওঠে।

এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য, কারামুক্তির কয়েকদিন আগে বাঙালির নয়নমণি, স্বাধীনতার স্থপতি, ইতিহাসের মহানায়ক, অকুতোভয় ও পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করতে একদেশদর্শী কৃতসংকল্পী শেখ মুজিবের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সঙ্গে ফেডারেল বা তদানুরূপ কোনো সম্পর্ক অনুরোধ করেছিলেন (পশ্চিম) পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো। এ বিষয়ে মীমাংসার ভার জনগণের হাতে থাকবে বলে জবাব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তবে তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, পাকিস্তানের বর্বর দখলদার বাহিনী বাঙালির ওপর যে জুলুম, নির্যাতন, হত্যা, অন্যায় আচরণ করেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই সম্পর্ক থাকা না-থাকা নির্ভর করবে। লক্ষণীয়, বাংলাদেশের যে প্রথম সরকার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করে, এর পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলির 'মীর জাফর' খন্দকার মোশতাক আহমেদও অনুরূপ একই দুরভিসন্ধিমূলক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দক্ষ প্রশাসনের সূক্ষ্ণ নজরদারিতে ইতোমধ্যে সন্দেহের তালিকায় থাকা খন্দকার মোশতাক ধরা পড়ে পদচ্যুত হন।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার মাস দুই আগে জল্লাদ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার গোপন সামরিক আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহের আসামি করে শেখ মুজিবের বিচারের নামে প্রহসন নাটক করা হয়। এতে একজন প্রায় উর্দুভাষী বাঙালিকে রাজসাক্ষী হিসেবে হাজির করা হয়। তবে তিনি উল্টো সাক্ষ্য দেন। 'দেশদ্রোহী' শেখ মুজিবের মৃত্যুদণ্ডের রায়ও দেওয়া হয়। কিন্তু সে রায় কার্যকর করার সময়, সুযোগ বা উপায় কোনোটাই ইয়াহিয়া খানের হয়নি। বিশ্বজনমত প্রচণ্ডভাবে বাংলাদেশের ন্যায়সংগত স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির পক্ষে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এমনকি পাকিস্তানের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশন শেষ করে জুলফিকার আলি ভুট্টো দেশে রওনা হন। লন্ডনে হিথরো বিমানবন্দরে তিনি শাহনাজ হোসেনকে (পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি মোজাফফর হোসেনের পত্নী ও ভুট্টো সাহেবের বন্ধু) জানান যে, খণ্ডিত পাকিস্তানের কর্ণধার হয়েই তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেবেন। ভুট্টো সাহেব সিন্ধু প্রদেশের লারকানা প্রদেশ থেকে উঠে আসা একজন জননেতা হিসেবে অন্য একজন অবিসংবাদিত রাজনীতিবিদের প্রতি শ্রদ্ধাভরেই মুক্তি দেওয়ার সম্মান জানাতে চেয়েছিলেন বোধ হয়। তাছাড়া আয়ুব খানের সঙ্গে সখ্য এবং পরে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ভীষণ বৈরী চতুর জুলফিকার আলি ভুট্টো হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে শেখ মুজিবের ফাঁসি হলে (পশ্চিম) পাকিস্তানও লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে এবং তার পক্ষে দেশ চালানো কঠিন হবে। বেঁচে থাকা বঙ্গবন্ধুকে সুপারিশ অনুরোধ করে তিনি কোন রাজনৈতিক সুবিধা পাবেন, সে হিসাব হয়তো জনাব ভুট্টোর মনে ছিল। বিশ্ব জনমতের চাপ যে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পক্ষে ছিল সে গূঢ়ার্থও তার জানা থাকারই কথা।

লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানকালে রাষ্ট্রাচারের বিধানের তোয়াক্কা না করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতাসহ অন্যান্য নেতা (তখনও শপথ না নেওয়া) রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এমনকি উভয় দেশের জন্য স্বার্থসংশ্নিষ্ট কিছু বিষয় বিশেষ করে দখলদার বাহিনী কর্তৃক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠনে ব্রিটিশ সরকারের সম্ভাব্য সহযোগিতার কথাও আলোচনায় উঠে আসে। লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধু ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন, কুশল বিনিময় করেন, দেশবাসীর কথা জিজ্ঞেস করেন। সাড়ে ছয় বছরের রাসেলের কথা বিশেষ করে জানতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ একটি রয়্যাল এয়ারফোর্স বিমানে তার নয়াদিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রপতিয় অভ্যর্থনা, সৌজন্য ও উষ্ণহৃদয় কুশল বিনিময়ের ফাঁকে ফাঁকে মহৎ ও বৃহৎ প্রতিবেশী পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে মতবিনিময় করেন বঙ্গবন্ধু। গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাঝেই সম্ভবত বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সম্মানজনক ফিরে যাওয়ার বিষয়টিও উত্থাপন করে রাখেন। নয়াদিল্লিতে জমায়েতের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বললেন, 'এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায় পরিপূর্ণ মহাযাত্রা। অবশেষে আমি ৯ মাস পর আমার স্বপ্নের সোনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি। এ ৯ মাসে আমার বাংলার মানুষ শতাব্দীর পথ পাড়ি দিয়েছে। আমাকে যখন আমার মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তখন তারা কেঁদেছিল। আমাকে যখন বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তখন তারা যুদ্ধ করেছিল, আর আজ যখন আমি তাদের কাছে ফিরে যাচ্ছি, তখন তারা বিজয়ী। আমি ফিরে যাচ্ছি তাদের নিযুত বিজয়ী হাসির রৌদ্রকরে। আমাদের বিজয়কে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করার যে বিরাট কাজ এখন আমাদের সামনে, তাতে যোগ দেওয়ার জন্য আমি ফিরে যাচ্ছি আমার মানুষের কাছে।' (দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া)

শত-সহস্র বাধা আর অনিশ্চয়তা দূর করে দেশে ফিরলেন বাংলার নয়নমণি। রেসকোর্সের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মহাজনসমুদ্রে 'ভায়েরা আমার'-এর উদ্দেশে বললেন, 'তোমরা আমার সালাম নাও। বাংলাদেশ আজ থেকে মুক্ত স্বাধীন। একজন বাঙালি বেঁচে থাকতেও এই স্বাধীনতা সূর্য নষ্ট হতে দেবো না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন দেশ হিসেবেই বেঁচে থাকবে। বাংলাকে দাবায়ে রাখতে পারে এমন কোনো শক্তি নাই। তোমরা আমার ভাইয়েরা, গেরিলা হয়েছিলে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য। তোমরা রক্ত দিয়েছ। তোমাদের রক্ত বৃথা যাবে না। তবে একজন মানুষও যদি না খেয়ে থাকে আর জনগণ যদি বাসস্থানে না থাকতে পারে, তাহলে বাংলার স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে।'

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ অনুযায়ী ২৪ পৌষ ১৩৭৮ তারিখে বাস্তবতা কী ছিল? একটি সোনার বাংলাকে শ্মশান ও মেধাশূন্য যুদ্ধবিধ্বস্ত বিরান ভূমিময় করে ফেলার নজিরবিহীন ইতিহাস ধিকৃত পরাজিত পলায়নপর দস্যু পাকিস্তানি বাহিনীর অপকর্মের ফসল ছিল এটি। ঘরে রান্নাবান্নার চাল, তেল, নুন, পেঁয়াজ নেই। কুপিতে আলো জ্বালাতে কেরোসিন নেই। ৯ মাসের মরণপণ মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত কিষান-কিষানির মাঠে ফসল নেই। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, রেল, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, মিল-ফ্যাক্টরি, অফিস-আদালত গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অথবা ধ্বংস। বন্দরে মাইন পোঁতা। মানুষের হাতে নেই কোনো অর্থকড়ি। ট্রেজারি কপর্দকশূন্য। ব্যাংক-বীমা-শিল্পকারখানা লুণ্ঠনকারী পাকিস্তানিরা পালিয়ে গেছে বলে বন্ধ দুয়ার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বলতে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঢাকার ছোট অফিসে আঠারো মার্কিন ডলারের জমা। ৯০০ কোটি ডলারের একটি ক্ষুদ্র অর্থনীতি যেখানে ১৯৬৯-৭০ অর্থবছরের তুলনায় সামষ্টিক উৎপাদন তথা জাতীয় আয় কমে যায় ৬৫ শতাংশ। পৃথিবীজুড়ে অর্থনৈতিক মহামন্দায় সদ্য স্বাধীন বিপর্যস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির আরও খারাপভাবেই যাত্রা শুরু। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তখন ৮০ মার্কিন ডলার। অন্যান্য সূচকে মানুষের গড় আয়ু ৪৩ বছর (মতান্তরে ৪৭), শিক্ষার হার ২৭ শতাংশ। বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ১৮০। নারীর প্রজনন শক্তি ৫ দশমিক ২। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ শতকরা ০৩ শতাংশ। হেনরি কিসিঞ্জারের 'তলাবিহীন ঝুড়ি'র সঙ্গে যুক্ত হয় হিউস্ট ফ্যালান্ডদের 'ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিকভাবে বেঁচে থাকলেও অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ টিকে থাকলেও তা হবে টেস্ট কেইস'।

এদিকে পরাজিত পাকিস্তানের এদেশীয় অনুচরেরা গোলাম আযম, নিজামী, জুলমত আলী, জব্বার খদ্দর মায় এককালের প্রগতিবাদী মাহমুদ আলী বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে প্রচারণা শুরু করে দেন যে, জমহুরি ইসলামী পাকিস্তানকে ভেঙে শেখ মুজিব ভারতঘেষা একটি হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করছে। পাকিস্তান-চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা- বাংলাদেশ ভারতের একটি করদ রাজ্য বৈ আর কিছু নয়।

বঙ্গবন্ধু শক্ত হাতে, দৃঢ় উদ্ভাবনী, বহুমাত্রিক নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থ ও শিক্ষা-সংস্কৃতিকে চালু করলেন। হলেন রাষ্ট্রের দিশারি আর অর্থনীতির কাণ্ডারি। জন্ম নিল সরকারি খাতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবি, এক হাজার ৮০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ। বিপুল পরিমাণে চাল, গম, ভোজ্যতেল, কোরোসিনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করে গুদামে রাখল টিসিবি। বঙ্গবন্ধু সরকারি খাতে সৃষ্টি করলেন কনজ্যুমারস সাপ্লাইজ করপোরেশন-কসকর, গ্রাম-গঞ্জে যার বিস্তৃত শাখার মাধ্যমে অত্যন্ত সুলভ মূল্যে বিতরণ করা হলো টিসিবির গুদামজাত এবং বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের হিমালয়সম গুডউইলে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রাপ্ত পণ্যসম্ভার। মানুষকে এভাবে বাঁচানোর জন্য অসাধারণ উদারতা, দক্ষতা ও সময়োপযোগিতায় কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, অর্থ ও বিদ্যুৎ খাতে সময় ও সম্পদ বিনিয়োগ করে রাষ্ট্রীয় চাকাকে সচল করা হলো। সারাবিশ্বে অর্থনীতির মহামন্দা আর মূল্যস্ম্ফীতি। তেলের দাম বেড়ে গেছে তিন গুণ, গমের দাম আড়াই গুণ। প্রথমেই কৃষিতে মনোযোগ দিলেন। সব সার্টিফিকেট মামলা তুলে দিলেন, জমির মালিকানার সিলিং করে ভূমিহীনদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বণ্টনের সিদ্ধান্ত নিলেন। মাফ করা হলো জমির খাজনা। প্রায় বিনামূল্যে সব ধরনের কৃষি উপকরণ বিতরণ করা হলো। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা নবজীবন পেলো। চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনায় স্থাপিত হলো শিল্পকারখানা। ১৯৫৬ সালে যে ইপসিকের সৃষ্টি করেছিলেন, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) হিসেবে এর পুনর্জন্ম দিলেন- প্রতি জেলায় স্থাপিত হলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট। স্থাপিত হলো বিদ্যুৎকেন্দ্র আর সার কারখানা। পরীক্ষামূলকভাবে বারোটি থানায় শুরু হলো পরিকল্পিত পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি। রচনা করলেন একটি আধুনিক ও দৃষ্টান্তমূলক সংবিধান। স্বীকৃত হলো মৌলিক অধিকার, ঘোষিত হলো সকলের তরে সমান ও অংশীদারিত্বের বাংলাদেশ- থাকবে না শহরে-গ্রামে, ধনী-গরিব ও নারী-পুরুষে কোনো বৈষম্য। সংবিধানের ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে সম্পদের মালিকানায় রাষ্ট্রীয়, ব্যক্তিগত ও সমবায়ী ধরন রেখে ব্যক্তি খাতের বিকাশ ও সমবায়ের প্রচণ্ড শক্তিকে কাজে লাগানোর দরজা খোলা রাখলেন বঙ্গবন্ধু। প্রণীত হলো প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, যার প্রথম বাক্য হচ্ছে, ুঞড় ৎবফঁপব ঢ়ড়াবৎঃু. ঞযরং রং :যব ভড়ৎবসড়ংঃ ড়নলবপঃরাব ড়ভ :যব চষধহচ্. জাতির পিতার কল্যাণ হাতের পরশে ও অনুপ্রেরণার নেতৃত্বে বিপুলভাবে ঘুরে দাঁড়াল বাংলাদেশ। ১৯৭৪-৭৫ সালে সামষ্টিক আয়ে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হলো ৭ শতাংশ। সূচনা হলো পররাষ্ট্রনীতি- সবার সঙ্গে সখ্য, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়- সে কথা বিবৃত করে। সমান ও সম্মানজনক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠল- তাদের সৈন্য প্রত্যাহার এবং বিভিন্ন খাতে (যথা জলযান) মঞ্জুরি নয় বরং ঋণভিত্তিক সংগ্রহ করল বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদভুক্তিতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভেটো দেয় গণচীন। পরে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, ১৯৭৩ সালে লাহোর ও আইসিসি সম্মেলনে যোগদান এবং তারও আগে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার ফলে 'করদ রাজ্য' দুর্নাম ঘুচে গেল। ১৯৭৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হয়ে যায়। ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ তারিখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সগৌরবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মাথা উঁচু করে মায়ের ভাষা বাংলায় বক্তব্য রাখলেন।

অতঃপর হায়েনার দলের কাপুরুষের মতো পৈশাচিক, ঘৃণিত, ন্যক্কারজনক বিয়োগান্ত ঘটনা- ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে সপরিবারে শাহাদাত বরণ করলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর জাতির পিতার আদর্শকে হটিয়ে পুনরায় পাকিস্তানীকরণের ব্যর্থ প্রয়াস।

আজকের এই দিনে বাঙালি একটি গর্বিত জাতি। জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ সন্তান জনবন্ধু শেখ হাসিনার বিশ্বনন্দিত স্টেটসম্যানসুলভ উদ্ভাবনী, দক্ষ, সাহসী, জ্ঞানালোকে সমৃদ্ধ নেতৃত্বে ১২ বছর ধরে কেবল বর্ধনশীল একমুখী গতির প্রতিবছর বার্ষিক সামষ্টিক আয়ের প্রবৃদ্ধির কারণে জাতীয় সামষ্টিক আয় চৌত্রিশ হাজার কোটি ডলারে বৃদ্ধি পেল। আর ২২০৯ ডলারের মাথাপিছু আয়ের অর্থনীতি এখন বাংলাদেশ। কভিড-১৯ জর্জরিত বিশ্বে ২০২০ সালে বাংলাদেশসহ মাত্র ১৯টি দেশে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে- তার মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যায় (দ্য ইকোনমিস্ট) আর ২০২০ সালে বাংলাদেশ ভারতের জিডিপি ছাড়িয়ে যায় (১৯৮৭ ডলার বনাম ১৯৭৬ ডলার; আইএমএফ) তবে বাজার অর্থনীতিতে দ্রুত উচ্চ প্রবৃদ্ধির অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে আয়, সম্পদ ও সুযোগ বৈষম্য যেভাবে বাড়ছে তাতে লাগাম টানতে হলে শিল্পায়ন তথা কর্মসংস্থানমূলক উন্নয়ন মডেল (বিশেষ করে কুটির, ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র শিল্প প্রসারে বিশেষ মনোযোগ এমনকি ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ব্যবস্থা) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে করজাল বিস্তার, মুদ্রা ও মূলধন পাচার বন্ধ, দক্ষ-সুষ্ঠু স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এবং মাধ্যমিকে বৃত্তিমূলক শিক্ষায় অগ্রগতিসহ শিক্ষা খাতে আমূল সংস্কার করা জরুরি। তবে আর্থিক ও স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারপ্রধান রাষ্ট্রনায়ক পৃথিবীনন্দিত শেখ হাসিনার হাতকে মজবুত করা খুবই জরুরি। আর তা করলেই মুজিববর্ষে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মশতবার্ষিকীতে ১০ জানুয়ারির ইস্পাতকঠিন সংকল্প :সোনার বাংলার ঘরে ঘরে মানুষের মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব হবে।

এদেশে এখন মানুষের গড় আয়ু ৭৪ বছর, শিক্ষার হার শতকরা ৭২ দশমিক ৩ ভাগ। শতকরা ৭৬ দশমিক ৮ ভাগ লোক উন্নত পন্থায় পয়ঃনিস্কাশন করেন। বিদ্যুৎ যাচ্ছে শতকরা ৮৫ ভাগ লোকের ঘরে। শিশুমৃত্যুর হার নেমেছে এক হাজারে ২৪ জনে। নারীর প্রজনন প্রবণতা নেমে এখন ২ দশমিক ০৫। বিগত ১২ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে সোয়া দুই গুণ আর খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ। জেন্ডার প্যারিটিতে বাংলাদেশ এশিয়ায় দ্বিতীয় আর সামাজিক অগ্রগতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রেষ্ঠ। অর্থনীতির অনেক বোদ্ধার হিসাব-নিকাশ বলছে, আর ১৫ বছর পর বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি হবে। একটি এলগারিদমিক মডেল অনুসারে ২০৩৯ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দশ হাজার মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে- অর্থাৎ ক্ষুধামুক্ত, বঞ্চনাবিহীন, অসাম্প্রদায়িক, দাঙ্গা-হাঙ্গামা-মৌলবাদ বিতাড়িত করে একটি উন্নত সমৃদ্ধ প্রযুক্তিনির্ভর সোনার বাংলায় প্রবেশ করবে ২০৪০ দশকে।
লেখক : অর্থনীতি ও শিক্ষা বিষয়ে চর্চা করেন এমন একজন সমাজকর্মী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিবের অভিজ্ঞতার আলোকে
এসএ/