ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

স্বপ্ন যাবে লাল টুকটুকে বাসে

ধীরা ঢালী

প্রকাশিত : ১১:১৩ পিএম, ১১ জানুয়ারি ২০২১ সোমবার

বিশ্ববিদ্যালয় মানেই হাজারো স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থীদের আত্মপ্রকাশের এক মুক্ত আকাশ। নিজেকে মেলে ধরার এক অনন্য বিস্তৃত বিচরণক্ষেত্র। বিশ্ববিদ্যালয় মানেই মুক্ত-স্বাধীন, আনন্দে আত্নহারা শিক্ষার্থীদের এক রঙিন স্বপ্নের আস্তানা। আর ক্যাম্পাস মাতোয়ারা এই শিক্ষার্থীদের অস্তিত্বের অনেকটাই সাক্ষী লাল-সবুজ- আকাশী বাসগুলো।

হাজারো শিক্ষার্থীদের অঙ্কুরিত স্বপ্নের ক্যানভাস জুড়ে থাকে এই রং-বেরঙের বাসগুলো। নিত্যদিনের আসা-যাওয়ার মধ্যদিয়ে প্রসারিত হতে থাকে তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলো। আর এখানে বসেই রঙিন স্বপ্নের বীজ বুনে ভবিষ্যতের অধ্যাপক, গবেষক, ডাক্তার, ম্যাজিস্ট্রেট, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, লেখক ও বিজ্ঞানীসহ জাতির উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলো। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসগুলো শুধু ধাতুতে মোড়ানো একটি জড়ো বস্তু নয় বরং এ যেন একই যানে পুরো পৃথিবীর চলাচল। তাই এই বাসগুলোকে একটি স্বশিক্ষিত জাতি গঠনের প্ল্যাটফর্ম বললেও হয়তো ভুল হবে না।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত বাসের ভূমিকা কতটুকু? এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মঞ্জুরুল ইসলাম মিঠু বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি চিন্তার মুক্তি আর স্মৃতি কুড়ানোর জায়গা হিসেবে মানি। জীবনে বেশ কয়েকবার শাটলে উঠার অভিজ্ঞতাও হয়েছে আমার। এই শাটল আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস জন্ম দিয়েছে কতো কবি, গায়কের। আমি দেখেছি সারাদিনের ক্লাস, আড্ডা, হৈ-হুল্লোড়ের পর সকল হতাশা- নিরাশা আর ক্লান্তি ভুলে বেসুরে গলায় গান গাইতে গাইতে নীড়ে ফিরছে আমার অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা, কর্মচারীদের জন্য যানবাহন থাকলেও শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো যানবাহনের বরাদ্দ নেই, তাই লাল বাসে বসে আড্ডা, তর্ক-বিতর্ক, গান বা অন্যান্য প্রতিভা বিকাশের সুযোগ গুলো আমাদের অধরাই রয়ে যাচ্ছে।'

আক্ষেপের রেশ না কাটতেই যানবাহন সংকটে থাকা শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির বিষয়গুলো তুলে মিঠু আরও বলেন, “আমরা মাঝে মধ্যেই শুনি আমার সিনিয়র, জুনিয়র কিংবা সহপাঠী নারী বন্ধুটি পাবলিক বাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের সময় হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়েছেন। তাই, আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একটি বাস শুধু আমাদের পরিবহন সুবিধা মেটায় না, এটি আমাদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করে।”

ভিন্ন ভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের একই ছায়াতলে আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ, মিলন-বিরহের সাক্ষী-ই হতে পারে এই লাল বাস। এখানেই তাদের মধ্যে গড়ে উঠতে পারে এক অবিচ্ছেদ্য আন্তঃসম্পর্ক।

এ বিষয়ের উপর আলোকপাত করে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষাও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক আফরোজা সিদ্দিকা'র কাছে প্রশ্ন করা হয়— আপনি কী মনে করেন একটি বাস হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আন্তঃসম্পর্ক গঠনের অন্যতম মাধ্যম?

উত্তরে, তিনি বলেন, 'একটি বাস শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরিবহণ করে না বরং এটি স্বপ্নও ফেরী করে। ঢাকা, সাভার ও এর আশেপাশের এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাস যখন দাঁপিয়ে বেড়াবে তখন হাজার হাজার কিশোর-কিশোরীর মনে স্বপ্ন জাগাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রেরণা দিবে। আমাদের লাল বাসের বিশেষত্ব এখানেই যে লাল রং দেখার পর তা অনেকক্ষণ মানসপটে ভেসে থাকে।'

নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা উল্লেখ করে স্মৃতিকাতরতার সুরে তিনি আরও বলেন, 'বাসে খুব ভালো আসন বা কারো জন্য নির্ধারিত আসন না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ছাত্রছাত্রীদের জন্য নিরাপদ। এই বাসকে ঘিরেই হয়তো বসবে শিক্ষার্থীদের হাসি-কান্নার গল্পের মেলা। ঘণ্টা খানেকেরবাস যাত্রা হয়তো জন্ম দিবে অনেক গায়ক আর কবির। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে উঠবে এক আন্তঃসম্পর্কের বন্ধন।এটাই হবে লাল বাসের তাৎপর্য।'

ক্লাস শেষের ক্লান্তিটা তখনই মুছে যায় যদি'না আড্ডা, গল্প আর হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের বাড়ি ফেরার সুযোগ হয়। প্রকৃতপক্ষে লোকালবাসে চলতে গিয়ে আমাদের এই অনুভূতি গুলো হয়ে পড়ে নিস্তেজ। দিন শেষের ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফেরার সঙ্গীই যদি হয় একটি লাল বাসতাহলে কেমন হতো!

এমন প্রশ্নের প্রতিত্তোরে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মাহমুদা আক্তার বলেন, 'যখন অন্য ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসের নিজস্ব বাসে বাড়ি ফিরতে দেখি তখন মনে হয় আমাদেরও যদি একটা লাল টুকটুকে বাস থাকতো! তাহলে আমাদের আর ক্লাস শেষের ক্লান্তি নিয়ে লোকাল বাসে ঝুলে ঝুলে বাড়ি ফিরতে হতো না।

আর শুধু এখানেই তো শেষ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার বাসার দূরত্ব ২০ কিলোমিটারের অধিক নয়। তবে আমাকে তিনবার গাড়ি পাল্টাতে হয়। পাঁচ-ছয়টা ক্লাস শেষ করে ক্ষুধার্ত শরীরে বাসে ঝুলে ঝুলে যাওয়া কতটা কষ্টের তা হয়তো বলে বোঝাতে পারবো না। তবে আশা- রাখি, একদিন আমাদেরও একটা লাল টুকটুকে বাস থাকবে। আর আমরা ক্লাস শেষে আনন্দে বিহ্বল হয়ে বাড়ি ফিরবো, নিজস্ব গতিতে, নিজস্ব স্বপ্নের পরিবহনে।”

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন শুধু যাতায়াতের প্রয়োজনেই ব্যবহার করা হয় না। এর সঙ্গে মিশে থাকে ঐ ক্যাম্পাসের সংস্কৃতি ও সভ্যতাও। আর তখনই এটি নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিবাচক সাড়া ফেলতে শুরু করে। তারা স্বপ্ন বুনতে থাকে তাদের ভবিষ্যৎ বিদ্যাপীঠ নিয়ে। এমন সব বিষয় উল্লেখ করে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও প্রশাসন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক রাহমান চৌধুরী স্যার বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহনব্যবস্থা প্রধানত সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে। আর সমাজ সভ্যতার মূল কাজ মানুষের নিত্য নতুন প্রয়োজন মেটানো। হতে পারে তা মানসিক বা শারীরিক। কখনো তা বৈশ্বয়িক। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন ব্যবস্থা যাতায়াতের প্রয়োজন মেটানো ছাড়াও আর একটা কাজ করে থাকে, সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বহনকারী একটি পরিবহন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচার বাড়িয়ে দেয়, সাধারণ মানুষ পরিবহনটি দেখতে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটি জানতে পারে। নামটি বারবার দেখা বা জানার পর বা দিন দিন তার কাছে নামটি পরিচিত হবার পর, বিশ্ববিদ্যালয়টি তার অবচেতন মনের কাছে কৌতূহলের বিষয় হয়ে থাকে। সচেতন ভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটি একটি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক এভাবেই তা মানুষের মধ্যে প্রচারের কাজ করে।দীর্ঘদিন বা বছরের পর বছর এমনটি চললে তা সংস্কৃতি ও সভ্যতার অংশ হয়ে উঠতেই পারে। কারণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে তার আবেদন সৃষ্টি হয়।”

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থীদের প্রতীক্ষা এখন স্বপ্নের লাল বাসকে ঘিরে। তবে এই প্রতীক্ষাটি-ই বা কতো সময়ের! বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ পেরিয়ে গেলেও কী এই আকুতিপূর্ণ প্রতীক্ষার কোনো শেষ নেই! আর কতদিন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে লোকাল।

এসি