প্লাস্টিক বর্জ্যই হতে পারে সম্পদ
আউয়াল চৌধুরী
প্রকাশিত : ০৫:১৩ পিএম, ১২ জানুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৬:০৫ পিএম, ১২ জানুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার
ছবি: সংগৃহীত
প্লাস্টিক আমাদের জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। খাবার থেকে শুরু করে ওষুধ, প্রসাধনী, প্রযুক্তি, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য, সবক্ষেত্রেই বিশ্বের প্রতিটি মানুষ ব্যবহার করছে প্লাস্টিক। মানুষের জীবনের সঙ্গে যেমন মিশে আছে প্লাস্টিক তেমনি এর অপব্যবহারে- সমুদ্র, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, প্রকৃতি দূষণের সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই পলিমার। বলা যায় এটি এখন প্রকৃতির ক্যান্সারে রুপ নিয়েছে। এসব প্লাস্টিক বর্জ্য পুড়িয়ে ফেললে আরও বিপদ। এতে হাইড্রোকার্বন হয়ে বাতাসে মিশে তা বাড়িয়ে দেয় দূষণের মাত্রা৷
প্লাস্টিকের এই দূষণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিক রিসাইকেল পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে উন্নত দেশগুলি পরিবেশ বিপর্যয় যেমন রক্ষা করতে পারছে অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশেও পরিত্যক্ত প্লাস্টিক, প্লাস্টিকের বোতল রিসাইকেল করে তৈরি হচ্ছে এখন নানা পণ্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে রিসাইকেল করা এসব সামগ্রী। সব ধরনের এসব প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেল করতে পারলে দেশে বছরে হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। গত অর্থ বছরে শুধু বোতলজাত পণ্য রিসাইকেল করে রপ্তানি আয় আসে প্রায় ২’শ কোটি টাকা।
প্লাস্টিক বোতল থেকে পণ্য তৈরি নিয়ে একুশে টেলিভিশনের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ পেট ফ্লেক্স ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্ট এসোসিয়েশন (বিপিএফএমইএ), এর পরিচালক মো. নূরুল আলম। তিনি বলেন, আমরা পরিত্যক্ত প্লাস্টিক রিসাইকেল করে দেশে, সুতা, কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছি আবার বিদেশেও রপ্তনি করছি। বর্তমানে মাসে ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিক টন প্রক্রিয়াজাত পণ্য বিদেশে রপ্তনি হচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার প্রতি মাসে আয় হচ্ছে। আমরা বোতলগুলিকে সংগ্রহ করে ফ্ল্যাক্স বা কুচি করে, প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে পাঠাচ্ছি।
ছবি: সংগৃহীত
তিনি আরও বলেন, আমার সারা দেশে যেখানেই বোতল পড়ে থাকুক না কেন সেগুলি সংগ্রহ করছি। এখন কোথাও খালি বোতল পড়ে থকে না। বোতল সংগ্রহে সারাদেশে প্রায় ৪ লক্ষ লোক কাজ করছে। সব মিলিয়ে এ পেশায় রয়েছে প্রায় ১২ লাখ মানুষ। বর্তমানে প্রায় ৯৮ শতাংশ বোতল রিসাইকেল এর আওতায় চলে এসেছে। এসব বোতল দিয়ে কাপড় তৈরি হচ্ছে, বালিশ হচ্ছে, ক্যাবল, কিছু টেক্সটাইল মিলে যাচ্ছে, কিছু বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। সব মিলিয়ে ভালভাবেই আমাদের কাজ চলছে। প্রকৃতি দূষণের ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই প্লাস্টিক। অন্যান্য প্লাস্টিকও যদি পুরোপুরি রিসাইকেল করা যায় তাহলে বায়ূ দূষনের আর কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। প্রকৃতিও রক্ষা পাবে অর্থনৈতিকভাবেও দেশ সমৃদ্ধ হবে।
সম্ভাবনাময় এ শিল্পে এখন অনেকেই এগিয়ে আসছে। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে প্রায় ২’শটির মতো ছোট বড় কারখানা গড়ে উঠেছে। এ সকল কারখানায় গড়ে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন করে লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে। নতুন করে আরও অনেক উদ্যোক্তা এ খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
প্লাস্টিক বোতল রিসাইকেল করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে তাহসিন গ্লোবাল ট্রেডিং লি.। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর গিয়াস উদ্দিন আরজু বলেন, আমরা যুক্তরাজ্য, ভিয়েতনাম, তুরস্ক ও ভারত এসব দেশে রিসাইকেল করা পেট ফ্ল্যাক্স বা বোতল কুচি পাঠাচ্ছি। আমাদের অফিস ঢাকায়, কারখানা ফেনীতে। সেখানে ৭০ জনের মতো লোক কাজ করছে। তারা বোতলগুলিকে মেশিনে ছোট ছোট চিপস তৈরি করে প্যাকেট করছে। পরে সেগুলি বিদেশে রপ্তানি করছি। দেশের বাহিরে এসব পণ্যের প্রচুর চাহিদা। কিন্তু আমরা সেই পরিমাণ দিতে পারছি না।
তিনি বলেন, প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেল একটি লাভ জনক ব্যবসা। এক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা আরও বাড়ালে ৩ থেকে ৪ শ কোটি টাকা প্রতিবছর এ খাত থেকে আয় করা সম্ভব। সরকার আমাদেরকে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দেয়। এটা যদি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ করা যায় তাহলে ব্যবসায়ীরা ভালোভাবে কাজ করতে পারবে। এছাড়া ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া সহজ করা দরকার। এসব সুযোগ করে দিলে এ ব্যবসা দাঁড়িয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো পরিবেশ বিপর্যয় থেকে দেশ রক্ষা পাবে। তবে একটা ভাল খবর হচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক এ খাতে অর্থায়ন করতে চাচ্ছে। যদি প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে আসে তাহলে আমি মনে করি প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলনা নয় সম্পদে পরিণত হবে। হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব হবে। দেশ পরিবেশ বিপর্যয় থেকেও রক্ষা পাবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক বলেন, প্লাস্টিক বর্জ্য আমাদের পরিবেশকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এ বর্জ্য পুরোপুরি রিসাইকেল করতে পারলে পরিবেশ দূষণ কমে আসবে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার ৬'শ বর্জ্য তৈরি হয়। বর্তমানে সব ধরনের প্লাস্টিক মিলে ৩৬ শতাংশ বর্জ্য রিসাইকেল হচ্ছে। বোতল রিসাইকেল হচ্ছে প্রায় ৭০ শতাংশ কিন্তু অন্যান্য প্লাস্টিক বর্জ্য একেবারেই কম হচ্ছে। ফলে এসব বর্জ্য যেখানে সেখানে ফেলে দেওয়ায় পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। সকল প্লাস্টিক বর্জ্য যদি রিসাইকেল করা যায় এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা যেমন আসবে দেশের পরিবেশও রক্ষা পাবে। আমরা এর থেকে উত্তরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এসি