ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীর হোয়াইট হাউজ বিজয়

ঈমাম হোসাইন

প্রকাশিত : ০৫:৪৯ পিএম, ২৩ জানুয়ারি ২০২১ শনিবার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গোটা বিশ্ব জুড়েই  চলছে স্বাধীনতা পাগল মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। এক এক করে খসে পড়ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দেওয়াল। উপনিবেশিক শাসন, শোষণ থেকে আফ্রিকার ১৭টি দেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল ওই সময়ে। সে সময়ে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে শেষ বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে পা দিয়েছিলেন কিউবান বিপ্লবী নায়ক ফিদেল কাস্ত্রো। সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নিকিতা ক্রুশ্চেভের সঙ্গে। কাস্ত্রো হাত মিলিয়ে ছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে।

কিউবার বিপ্লবকে সমর্থন জানিয়েছিলেন কঙ্গোর অবিসংবাদী নেতা প্যাট্রিস লুলুম্বা। সব মিলিয়ে স্রোত যেন মিশে গিয়েছিল মুক্তির নব মোহনায়। সেই স্রোতে আরও বেগবান হয়ে উঠেছিল আমেরিকান নাগরিক অধিকার আন্দোলন। সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন যাঁরা, তাঁদেরই ফেলে যাওয়া ব্যাট সাড়ে ছয় দশক পর নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন কমলা হ্যারিস, আমেরিকার প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভাইস প্রেসিডেন্ট। যার ধমনীতে মিশে আছে তিনটি মহাদেশ— আফ্রিকা, আমেরিকা এবং এশিয়া। করোনা মহামারির সময়েও বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশে নির্বাচনী ফলাফলে ঘটেছে এক নীরব বিপ্লব। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক কৃষাঙ্গ নারী বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করবেন ক্ষমতার সুপারহাউজ হোয়াইট হাউজে। এ এক দেয়াল ভেঙ্গে গজিয়ে উঠা পদ্মের গল্প, কমলা যার নাম।

কমলার বাবা ডোনাল্ড হ্যারিস জ্যামাইকান। মার্কসীয় ঘরানার অর্থনীতির অধ্যাপক। এক সময় স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। মা ক্যান্সার গবেষক শ্যামলা গোপালান, জন্ম ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের এক গ্রামে।ভারতীয় এক কূটনীতিকের মেয়ে।মাত্র উনিশ বছর বয়সে শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। পিএইচডির সূত্র ধরে স্হায়ী নিবাসী হন যুক্তরাষ্ট্রে। বার্কলেতে নাগরিক অধিকার আন্দোলনে অংশ নিতে এসে পরিচিত হন ডোনাল্ড হ্যারিসের সঙ্গে।এরপর প্রেম, বিয়ে, সংসার। হ্যারিস তার আত্মজীবনী ‘দ্য ট্রুথ্স উই হোল্ড: অ্যান আমেরিকান জার্নি’তে বাবা-মায়ের পরিচয়, ঘনিষ্ঠতার কথা জানাতে গিয়ে এমনটাই বলেছেন ।

জ্যামাইকার এক বনেদি পরিবারে বাবার দিকের এক দাদীর কাছে বেড়ে ওঠেন ডোনাল্ড হ্যারিস। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলেতে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন ১৯৬১ সালে। ।কমলা দেবী হ্যারিস- এ দম্পতির প্রথম সন্তান। তার জন্ম ওকল্যান্ডে, ১৯৬৪ সালের ২০ অক্টোবর। কমলার নামের শেষাংশ বাবার কাছ থেকে নেওয়া; প্রথমটুকু মায়ের দেওয়া।ওই সময় ডোনাল্ড হ্যারিস আর শ্যামলা নাগরিক অধিকার আন্দোলনে এতটাই নিবেদিত ছিলেন যে, এলাকার প্রায় সব প্রতিবাদ কর্মসূচিতেই তাদের দেখা মিলত। মাঝে মাঝে মেয়েকেও নিয়ে যেতেন তারা।

ভারতীয় পুরান আর শাস্ত্রে সৌভাগ্য, সৌন্দর্য,পবিত্রতা ও শক্তির দেবী লক্ষ্মীর প্রতীক আর সংস্কৃত শব্দ ‘কমল’ বা পদ্মফুলের নিকটবর্তী শব্দ কমলা।তাই ঐতিহ্যের সাথে মিলিয়ে মেয়ের নাম ‘কমলা’ রাখেন মা শ্যামলা ।আরেক মেয়ের নাম রাখেন মায়া লক্ষ্মী।তাও ভারতীয় ঐতিহ্য আর পুরানের সাথে সম্পর্কিত । হ্যারিস এবং শ্যামলার বিয়ে বেশিকাল টিকেনি। কমলার বয়স যখন ৭, তখন বিচ্ছেদ হয়ে যায় দু’জনের। কিন্তু প্রথম প্রেম ভেঙে যাওয়ার ক্ষত সারাজীবনেও সারিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। মধুর প্রেম বদলে গিয়েছিল তিক্ততায়। তবে লড়াই থামাননি। বিচ্ছেদের পরেও মেয়েদের নিয়ে পথে নেমেছেন, স্লোগান দিয়েছেন,দমে যাননি।

দুই মেয়েকে নিয়ে শ্যামলার সংগ্রামী জীবন শুরু হয় বার্কলের একটি হলুদ ডুপ্লেক্স ভবন থেকে। মেয়েরা যেন নিজেদের শেকড় ভুলে না যায়, সেদিকে ছিল ভারতীয় এ নারীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।মাঝে মাঝে বেড়াতে আসতেন চেন্নাইয়ের নানা বাড়িতে।মায়ের কারণেই শৈশবে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য বানানো ব্যাপটিস্ট চার্চ এবং হিন্দু মন্দির দুই জায়গাতেই তার দুই মেয়ের যাতায়াত ছিল নিয়মিত।বাল্যকালে ভারতে বেড়াতে যাওয়া হ্যারিসের ওপর যে তার স্বাধীনতা সংগ্রামী নানারও যথেষ্ট প্রভাব ছিল, ‘দ্য ট্রুথ্স উই হোল্ড: অ্যান আমেরিকান জার্নি’ থেকে তা জানা যায় ।শ্যামলা গোপালান কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি নিলে কমলা আর মায়াকে মায়ের সঙ্গে বেশ কিছু কাল মন্ট্রিয়লেও থাকতে হয়েছিল। কমলা আর মায়ার শৈশব কেটেছে এ স্নিগ্ধ শীতের দেশে।২০০৯ সালে দুই কন্যাকে রেখে ইহলোক ত্যাগ করেন মা শ্যামলা।

কমলার লড়াই, উত্থান, জীবনযাত্রা সব কিছুতেই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছেন তাঁর মা। প্রভাব ফেলেছিলেন তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামী দাদু পি ভি গোপালানও। নির্বাচনের সময়ে তামিলনাড়ুতে নানার গ্রামের মন্দিরে পূজো দিয়েছিল এলাকাবাসী।ছোটবেলা থেকে অ্যাফ্রো-আমেরিকান সংস্কৃতিতেই বেড়ে উঠেছেন কমলা। তার সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণ।তবে মা হিসেবে কমলার মধ্যে যে স্বপ্ন তিনি বুনে দিয়েছিলেন, তা আজ প্রকাশিত। বহুমুখী প্রতিভাধর, স্পষ্টবাদী কমলা প্রতিকূলতার মধ্যে লড়াই করার অদম্য সাহস তিনি পেয়েছেন মায়ের কাছ থেকেই। স্রোতের প্রতিকূলে, বাস্তবতার নিরিখে আজকের পর্যায়ে আসতে কমলাকে বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কমলার আগে মাত্র দুজন নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ২০০৮ সালে রিপাবলিকান পার্টি থেকে সারাহ পেলিন এবং ১৯৮৪ সালে ডেমোক্রেটিক দল থেকে জেরালডিন ফেরারো।

যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর হ্যারিস হেস্টিং কলেজ থেকে আইনেও ডিগ্রি নেন। তিনি ১৯৯০ সালে  ওকল্যান্ডে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল, ২০০৪ সালে সান ফ্রান্সিসকোর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি,২০১০ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হন।দ্বিতীয় মেয়াদে বারাক ওবামাকে প্রার্থী করা ডেমোক্রেটিক পার্টির ২০১২ সালের ন্যাশনাল কনভেনশনে অসাধারণ বক্তৃতা দিয়ে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের নজর কাড়েন।২০১৪ সালে আইনজীবী ডগলাস এমহফের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন কমলা দেবী হ্যারিস। এর দুই বছর পর সিনেট নির্বাচনে সহজে জয়লাভ করে তিনি পা রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চকক্ষ কংগ্রেসে ।প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত, আফ্রিকান-আমেরিকানদের মধ্যে দ্বিতীয় মার্কিন সিনেটর হওয়ার আগে নির্বাচনী প্রচারণায় হ্যারিস অভিবাসন ও বিচার প্রক্রিয়ার সংস্কার, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, নারীর প্রজনন অধিকার নিয়ে ছিলেন ব্যাপক সোচ্চার।২০১৭ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশনস এবং পরে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে ব্রেট কাভানহ’র শুনানিতে তার জিজ্ঞাসাবাদের ধরন দলের ভেতরে-বাইরে তুমুল প্রশংসা অর্জন করে।

কনজারভেটিভ রিপাবলিকানরা কমলার জন্মস্থান, জাতভেদ সামনে এনে ফায়দা নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কমলা তার বক্তব্যে স্পষ্ট করেই তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।তিনি বরাবরই নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গ পরিচয় দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। ‘আমেরিকান’ বলে সব সময় বর্ণনা দেন। তবে নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান পরিচয় দিলেও তার যেখানে শেকড়, সেখান থেকে সরে আসেননি। বরং মায়ের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত। ফলে আমেরিকানদের কাছে বংশোদ্ভূতের ইস্যুটা পাত্তা পায়নি। 

৫৫ বছর বয়সী ভারতীয় বংশোদ্ভূত ডেমোক্রেটিক পার্টির অন্যতম জনপ্রিয় মুখ কমলা। তিনি এমন সময়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে যাচ্ছেন, যখন করোনার জেরে আমেরিকার অর্থনীতি বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রায় দেড় লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন। বাড়ছে বেকার সংখ্যা। এসব চ্যালেঞ্জ নিয়েই শপথ নিবেন কমলা।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে আত্মজীবনীমূলক বই ‘দ্য ট্রুথস উই হোল্ড: অ্যান আমেরিকান জার্নি’ প্রকাশিত হওয়ার পরই হ্যারিস ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।মনোনয়ন লড়াইয়ের শুরুর দিকে হ্যারিসকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভারমন্টের সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এবং ম্যাসাচুসেটসের সেনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেনের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হয়েছিল। সে সময় জনমত জরিপগুলোতে হ্যারিসের অবস্থান একটু একটু করে শক্তিশালী হতে দেখা গেলেও ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে তার জনপ্রিয়তায় ভাটা দেখা দেয়, তার প্রচারণা শিবিরেও দেখা দেয় নানান জটিলতা।মে মাসে মিনিয়াপোলিসে পুলিশ হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর থেকে ডেমোক্র্যাট ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে কমলার নাম সামনের দিকে চলে আসে।পরবর্তীতে ১১ আগস্ট কমলা হ্যারিসকে নির্বাচনী জুটি হিসাবে বেছে নেন জো বাইডেন৷

মার্কিন সমাজে সংস্কারপন্থী প্রগতিশীল মানুষ কমলা হ্যারিস। অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন, গর্ভপাত,  সমকামীদের অধিকার, শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়ানো, আবাসন, কর ব্যবস্থাপনা সংস্কারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে হ্যারিস ডেমোক্রেট মধ্যপন্থি ও প্রগতিশীলদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনীর যুদ্ধের বিরোধী ছিলেন তিনি। ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে ট্রাম্পের বেরিয়ে আসারও তিনি কঠোর সমালোচক। মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে থাকার পাশাপাশি হ্যারিস বিভিন্ন সময়ে পুলিশ নীতিতে বদল আনারও দাবি তুলেছেন।ভারতীয় বংশোদ্ভূত এ নারী তার বাগ্মিতা, অভিবাসী শেকড়, কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতি এবং অ্যাটর্নি ও সিনেটর হিসেবে অভিজ্ঞতা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিভাজনের রাজনীতির ইতি টানার স্বপ্ন দেখেন।

এ প্রথম কোনো আফ্রো-এশীয়দের মধ্যে থেকে একজন কৃষাঙ্গ নারী শপথ নিবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে, পরখ করবেন বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর দেশের ক্ষমতার আসন।তামিলনাড়ুর কোনো এক স্হানে পড়ে থাকা পদ্মলতা  দেয়াল ভেঙ্গে জেগে উঠেছে মার্কিন মুল্লুকে।

বাইডেনের বয়স এখন সাতাত্তর। সঙ্গত কারণে এক মেয়াদের বেশি তার প্রেসিডেন্ট পদে থাকা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। ৫৫ বছর বয়সী হ্যারিসকে তরুণ বলা না গেলেও অন্তত বাইডেনের তুলনায় তিনি কম বয়সী তো বটেই।ফলে চার বছর পরের নির্বাচনে ডেমোক্রেট দল থেকে কমলার প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থিতা অসম্ভব কিছু নয়।তখন পদ্মলতা উঠে যাবে আরও ওপরে। আর তামিলনাড়ুর নানা বাড়ি থেকে সারা ভারতবর্ষে বয়ে যাবে আনন্দ জোয়ার। গর্বিনী হবেন ভারতমাতা।ভারতাসী এটুকু প্রত্যাশা করতেই পারে। 

আরকে//