প্রশিক্ষণে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন উদ্যোক্তা
ফারুক আহমেদ চৌধুরী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৯:৫২ পিএম, ২৭ জানুয়ারি ২০২১ বুধবার
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) প্রশিক্ষণ নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৭৭ নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের পছন্দমতো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন তারা। বিডা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা ব্যবসা শুরু করেছেন কিংবা ব্যবসার পরিসর বড় করেছেন। অনেকে আবার প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যবসার কাঠামোগত পরিবর্তন এনেছেন। উদ্যোক্তার সঙ্গে ক্রেতাদের সংযোগ ঘটিয়ে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। এতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইতবাচক প্রভাব পড়েছে। বাড়ছে কর্মসংস্থান। আয় বাড়ার কারণে বাড়ছে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়। এর প্রভাবে চাঁইনবাবগঞ্জের সার্বিক অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে।
জানা গেছ, বিডার চাঁপাইনবাবগঞ্জর কার্যালয় থেকে এ জেলার উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী ৩০০ জন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এদের মধ্যে ব্যবসা করছেন ৭৭ উদ্যোক্তা। প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরিকল্পানা অনুযায়ী ব্যবসা শুরু করেছেন তারা। প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করা ৭৭ নতুন উদ্যোক্তার বিনিয়োগ প্রায় ২২ কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৫৫৮ জনের। নকশী কাঁথা ও বুটিকস, আইটি, মাছ চাষ, বেকারি ব্যবসা, ডেইরি ফার্ম ও কৃষি খাতে অধিকাংশ বিনিয়োগ হয়েছে।
বিডার উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও বিনিয়োগ সহায়তা কেন্দ্র চাঁপাইনবাবগঞ্জ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রশিক্ষণ গ্রহণের ফলে একজন উদ্যোক্তা ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হয়ে উঠছেন। যা আত্মকর্মসংস্থান, নতুন ব্যবসার উদ্যোগ সৃষ্টি ও বেকারত্ব নিরসনে ভূমিকা রাখছে। এক মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর একজন প্রশিক্ষণার্থী ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়া, আরজেএসসি নিবন্ধন, শুল্ক ও ভ্যাট, আমদানি-রফতানি, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, এলসি, ঋণ ও বীমা, বিনিয়োগ পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারছেন। এছাড়াও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সেবা, সুবিধা ও ওয়ানস্টপ সার্ভিস, পরিবেশ ছাড়পত্র, পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ, ওজন ও পরিমাণ নিশ্চিত, সাপ্লায়ার্স ও লিংকেজ, সংশ্লিষ্ট আইনসমূহ সম্পর্কে প্রশিক্ষণার্থীদের অবহিত করা হচ্ছে। প্রশিক্ষণের পরে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের বিষয়ে কাউন্সিলিংয়েরও ব্যবস্থা রেখেছে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ নেয়া জমশেদ আলী বেকারি ব্যবসা করছেন। আগে থেকেই ‘এফএনএফ বেকারি’ নামের এ প্রতিষ্ঠান ছিল। তবে প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন। তার প্রতিষ্ঠানে ৮৮ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। তার ফ্যাক্টেরিতে উৎপাদিত বেকারি পণ্য বাজারে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। বিভিন্ন দোকানে সরবরাহের পাশাপশি শহরের ক্লাব সুপার মার্কেট ও বিশ্বরোড মোড়, কলেজ মার্কেটে দুটি শো-রুম করেছেন। এ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। সফল উদ্যোক্তা জমশেদ আলী জানান, ব্যবসা পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় তার দক্ষতা ছিল না। বিডার প্রশিক্ষণে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে বিস্তর ধারণা পেয়েছেন। প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
প্রথম ব্যাচে বিডার প্রশিক্ষণ নিয়ে মাছ চাষ করছেন লাল চাঁন। তার ব্যবসায় কর্মসংস্থান হয়েছে ২৯ জনের। তরুণ উদ্যোক্তা লাল চাঁন মাছ ব্যবসায় দারুণ উন্নতি করেছেন।
তৃতীয় ব্যাচে প্রশিক্ষণ নেয়া কাইসার হামিদ ‘আস্থা কেমিকেল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তরুণ এ উদ্যোক্তা ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে উৎপাদন করছেন ডিটারজেন্ট পাউডার ও মশার কয়েল। তার উৎপাদিত আস্থা ব্র্যান্ডের দুটি পণ্য এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। টয়লেট ক্লি¬নার ও মুড়ি উৎপাদন প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। এ প্রতিষ্ঠানে ২৮ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। তরুণ উদ্যোক্তা কাইসার হামিদ জানান, বিডার প্রশিক্ষণ এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। ব্যবসা পরিচালনা ও সম্প্রসারণে সব ধরনের সহযোগিতা করছে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
বিডার প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে বদলে ফেলেছেন রেজিনা আনোয়ার নামে আরেক নারী উদ্যোক্তা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী সৌখিন পণ্য নকশীকাঁথা তৈরি করছেন। এছাড়াও হস্তশিল্পের নানান পণ্য উৎপাদন করছেন তিনি। তার প্রতিষ্ঠানে ২৩০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। তিনি শহরের পাঠানপাড়ার ফুড অফিস মোড়ে ‘আদিবা বুটিকস’ নামে একটি শোরুম করেছেন। যেখানে রং-বেরংয়ের নকশীকাঁথা ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের হস্তশিল্পের পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে বিভিন্ন পুরস্কারও পেয়েছেন রেজিনা আনোয়ার। রেজিনা আনোয়ার বলেন, বিডা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যবসার খুঁটিনাটি শিখেছি। ক্রেতা খুঁজে পেতেও সহায়তা করেছে তারা। সব মিলিয়ে আজকের অবস্থানে আসার পেছনে বড় অবদান বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও লিমা খাতুন, নাজনীন ফাতেমা জিনিয়া, ওরমিতা দাস, আমেনা রোজী, সুলতানা রাজিয়াসহ অনেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে নকশীকাঁথা ও বুটিকস ব্যবসা করছেন।
তৃতীয় ব্যাচে বিডার প্রশিক্ষণ নেয়া মেহেদী হাসান স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে কাজ শুরু করেছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের আরামবাগের একটি ভাড়া ভবনে তিনি ‘ফেয়ার ডায়াগনিস্টক সেন্টার’ নামে একটি স্বাস্থ্যসো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় লাইসেন্স সংগ্রহ ও মেশিনারিজ ক্রয় প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। অংশীদারি মালিকানায় প্রায় কোটি টাকা বিনিয়োগের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। তিনি বলেন, আগে থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আগ্রহ ছিল। তবে এটি শুরু করার জন্য যে দক্ষতা দরকার সেটি ছিল না। বিডার প্রশিক্ষণে সেই দক্ষতা অর্জন করেছি। প্রশিক্ষণ শেষে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করি। পরিকল্পনা অনুযায়ী এ প্রতিষ্ঠনটি গড়ে তুলতে কাজ শুরু করেছি। আশা করছি, আগামি মার্চ থেকেই এ প্রতিষ্ঠানটি পথচলা শুরু করবে।
বিডার প্রশিক্ষক এসএএ শাফি জানান, দেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলের বিনিয়োগে আগ্রহী সম্ভাবনাময় বেকার ও শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের বিনিয়োগ-সংক্রান্ত ধারণা দিতে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয় সরকার। দেশব্যাপী বেসরকারি উদ্যোক্তা তৈরিতে ৬৪ জন প্রশিক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। ‘তারুণ্যের শক্তি, বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের লক্ষ্য হচ্ছে, ‘চাকরি করবো না, চাকরি দেবো’। ২০৩০ সালের মধ্যে তিন কোটি বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যেই এই উদ্যোগ নেয়া হয়। ‘উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প’ প্রকল্পের আওতায় আগ্রহী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ইতিমধ্যে ৩০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তিনি জানান, আগ্রহী উদ্যোক্তাদের কারিগরি সহায়তার পাশাপাশি তাদের মানসিকভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে। বিনিয়োগে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরিতে সহায়তা করা হচ্ছে।
আরকে//