ঢাকা, বুধবার   ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১৯ ১৪৩১

নারীরা কেন পিছিয়ে পড়ে?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:৫৩ পিএম, ৩১ জানুয়ারি ২০২১ রবিবার

‘একটা সফল পুরুষের পেছনে যেমন একজন নারীর হাত থাকে, তেমনি একজন ব্যর্থ নারীর পেছনেও একজন নারীরই ভূমিকা থাকে” —কথাটা বলেছিলেন আমার শাশুড়ি, যেদিন ঘর করতে এসেছিলাম তার ঠিক পরের দিন। বলেছিলেন তার শাশুড়ির কথা; যিনি ‘পাড়ার সেরা সুন্দরী’ ঘরে এনেছিলেন স্রেফ রান্নাবান্না আর গৃহস্থালীর কাজ সামলানোর জন্যে। তাই নিজের ছেলের বউকে সবটুকু স্বাধীনতা আর ‘পরিচয়’ দিয়ে আমার শাশুড়ি যেন নিজ জীবনের সেই ফাঁকটা পূরণ করতে চেয়েছিলেন। আমাকে জানিয়েছিলেন, তিনি চান “এই সংসারটা আমার” – এই কথাটা যেন আমি অন্তর থেকে বলতে পারি, কারণ অধিকাংশ ‘ছেলের বউ’ই তা পারে না!

সেদিন সকালের সেই কথোপকথনটা আজও মনে আছে। অবাক হয়েছিলাম একজন প্রাইমারি পাস নারী, যিনি সংসার-দাম্পত্য বোঝার আগেই বিয়ের বাঁধনে পড়েছিলেন, তার উপলব্ধি-শিক্ষা কীভাবে আমার মতো একটা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সেই আমলের ‘কর্পোরেট’ একজনের মাথা ঘুরিয়ে দেয়! তিনিই আমাকে বলেছিলেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা। আর বলেছিলেন, সম্মান সবসময় নিজের কাছে—সেটা স্বামীর সামনে হোক আর সন্তানের সামনে। যতক্ষণ আমি সুযোগ না দেব ততক্ষণ কেউ আমাকে “অবলা” বা “মেরুদন্ডহীন” বলে আঘাত করতে পারবে না।

নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা তো আগেও পেয়েছি। কিন্তু সেখানে ছিল কেবল সাধ-আহ্লাদ-আর-শৌখিনত্ব। স্বামীই আমাকে পালন করবে, আমি নিতান্তই অবসর সময়ে একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়াব, যার পেছনে নেই কোনো জবাবদিহিতা, লক্ষ্য আর কমিটমেন্ট। তাও এর মেয়াদ ১/২ বছরের বেশি না। জানি অনেকেই হায়-হায় করে উঠবেন। চাকরি করতে গেলে স্বামী নাখোশ হয়, শ্বশুর-শাশুড়ি নাক সিঁটকায়, আরও কত কী! কিন্তু একজন মেয়ে হিসেবে জানি- এই অভিযোগগুলোর কতটা সত্য আর কতটা নিজের অক্ষমতাকে ঢাকার চেষ্টা! যদি আরামসে ‘পরের’ উপার্জনে চলতে পারি, তাহলে কষ্ট করে কী দরকার প্রতি সকালে রিক্সা খোঁজার, ফাইল ঘাঁটার আর বসের ঝাড়ি খাবার?

আমার বোনকে তো দেখছিই: একটা সময় দুজন যখন ঢাকা ভার্সিটি যেতাম! আমার বাবাকে লোকে বলতো, “আপনার দুই ‘ছেলে’ যাচ্ছে”! আমার বোনটাও ছিল বাবার ‘ছোট ছেলে’! ‘ছিল’ বলছি কারণ একসময়কার ভীষণ স্বাধীনচেতা, প্রফেশনাল আর ‘বিপ্লবী’ বোনটা আজ কেবলই ‘দুই বাচ্চার মা’! ‘গৃহিণীর আরাম’ আর স্বামীর প্রশ্রয় পেয়ে আজ তার এমন অবস্থা যে তার মেয়ে কিনা আমার কাছে আসে ‘ক্যারিয়ার সাজেশন’ নিতে! যেহেতু মাকে দেখেছে সারাক্ষণ বাসায় থাকতে, প্রতিদিন খাবার বেড়ে দিতে আর কাজের লোককে বকতে–তাই তাদের ধারণা হয়েছে বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে তাদের মা অজ্ঞ! আরে, তার মা'র রেজাল্টের মিষ্টি খেতে-খেতে যে এলাকার বহু পিচ্চি বড় হলো, তার স্কলারশিপ আর চাকরির অফার যে একটা সময় আত্মীয়মহলে উদাহরণ ছিল–ছেলেমেয়ের কাছে তার কোনো মূল্য আছে?

আর বোনটার কী অবস্থা? এতগুলো বছর পর তার আফসোস হয় নিজের কোনো জগত নেই বলে। ছেলেমেয়েরা নিজ-নিজ জীবন নিয়ে ব্যস্ত, স্বামীর চাকরি আজ অনেক বড় হয়েছে সেই অনুপাতে বাসায় থাকাও কমেছে। মাঝে মাঝে তাই দেখি বোন এসে আমার ফাইলপত্র ঘাটে, অফিসের কথা শুনতে চায়। আমি ভাবি, চল্লিশের ঘরে এসে এই পরিণতি—এই আফসোস কী অনেকের মধ্যেই হয় না?

আশ্চর্য হলো, কেবল চাকরি করলে বা নিজের একটা পেশা থাকলেই যে জীবন নিয়ে খুব তৃপ্তি পাবো–তাও তো না। আমার সাথে একই ব্যাচে জয়েন করা কয়েকজনের কথা বলি: সেই সময়টায় গ্রাজুয়েশন করা বা করছে–এমন মেয়ের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। মনে আছে, ক্লাসে ৪২ টা ছেলের সাথে বসতাম আমরা তিনটি মাত্র মেয়ে। তাই মুখে-মুখে সবার জানা ছিল অমুক সাহেবের মেয়ের রেজাল্ট কী বা কোন বিভাগের ছাত্রী। তো এমন ‘বিখ্যাত’ ছাত্রীরা যখন চাকরিতে ঢুকল, ১/ ২ বছরের মাথায় তাদের আর কোনো খবর নেই! কারণ বিকেলে তারা আগে চলে যাবে ‘নিরাপত্তা’র জন্যে। আবার সকালেও তারা আগে আসতে পারবে না, কারণ স্বামী-বাচ্চা স্কুলে যাবে, নাস্তা তৈরি করে দিয়ে আসতে হবে। এর বাইরে নিত্যদিন ঝুটঝামেলায় অফিস ছুটি তো আছেই।

মনে আছে, এক সহকর্মী দেরি করতেন কারণ কাজের লোক নেই; এরপর দেরি করতেন কাজের লোককে সব বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হয় বলে! আর পরে যখন মাস শেষে পুরুষ সহকর্মী প্রমোশন পেত- সমস্বরে সবার সে কী চিৎকার- “মেয়ে বলে কপালে পদোন্নতি জুটে নি”! এখন কী বলবেন? ক্যারিয়ার আগায় নি তা কোম্পানির দোষ, না নিজের কর্তব্যে অবহেলা?

তাহলে কী সংসার ছাড়তে হবে? জীবনে কি পরিবারের আগে ক্যারিয়ার? না, কক্ষণও না। একটা কথা প্রত্যেকটা দিন মনে করি, এই পুরুষশাসিত সমাজে সফল হতে গেলে একটা মেয়েকে দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়। তাই আমার সহকর্মীরা যখন নাস্তা বানানোর দোহাই দিয়ে দেরি করত, আমি সকালে একঘন্টা আগে উঠে রান্নাঘরে যেতাম। কারণ আমি কম ঘুমিয়ে নিজের আরাম বাদ দিয়েছি, চাকরির প্রতি নিষ্ঠা বা পরিবারের দায়িত্বে ফাঁকি দেই নি। তবুও অনেক কিছুই পারি নি। স্বামী একদিন অফিস থেকে আগে ফিরলেন। যেহেতু তখনও আমি অফিস থেকে ফিরি নি, তাই সেদিন তার এক-কাপ চা জোটে নি। রাতে সেই মেজাজ ঝেড়েছিলেন আমার উপর। মনে হতো ফিরে দুটো কথা বলি, আমিও একটু চেঁচাই। কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে সামলেছি। বরং পরদিন সকালে বাড়তি একটা পদ রান্না করেছিলাম যাতে স্বামী নাস্তার টেবিলে পায়েস পেয়ে খুশি হয়, বুঝে যে আমি দুঃখিত। ছেলের ক্রিকেট ম্যাচ বা মেয়ের পরীক্ষা মিস করেছি কারণ অফিসে ব্যস্ততা। সেজন্যে তাদের খুশি করতে ছুটির দিনে ছেলের সাথে ধুম-ধারাক্কা রক-গান বা একশন মুভি দেখেছি, কিছু না বুঝেও ভীষণ মাথাব্যথা নিয়েও। ক্লান্ত-অবসন্ন শরীর নিয়েও হাসিমুখে মেয়ের মাথায় তেল দিয়েছি। যাতে তারাও বুঝে, না, অফিস- অফিস, বাসা- বাসাই, কোনোটার মূল্য কম না। বলতে লজ্জা নেই, ভুল না করেও সরি বলেছি ব-হু-বার। আর তাই, শুধুমাত্র তাই, যেদিন আমি চিৎকার করেছি সেদিন আমার ছেলেমেয়ে বা ঘরের কর্তা দ্বিতীয় কথা বলেন নি। তারা জেনেছেন, বুঝেছেন, না-পারতে আমি ধৈর্য হারাই না।

কয়জন করে এই বাড়তি কষ্ট? বেশিরভাগ মেয়েই এই পরিশ্রমবিমুখতার জন্যে পিছিয়ে পড়েন। হয় তারা কিছুই করেন না, অথবা একটু কিছু করেই এত খুশি থাকেন যে আরও সামনে এগোনোর কথা ভুলে যান। তবে ভুলেও ভাববেন না আমি ঘর সামলানোর বিপক্ষে। আমার মা যদি ‘গৃহিণী’ না হতেন, আমার পক্ষে সম্ভব হতো না এতদূর আসার। কিন্তু গৃহিণী হয়েও আমার মা কিন্তু ‘অবলা’ ছিলেন না। বাসার কল নষ্ট হয়ে গেলে বা উঠানে-রাস্তায় ময়লা জমলে মা কখনও বাবার জন্যে বসে থাকেন নি। নিজে লোক ডেকে কাজ করিয়েছেন। বাবা তো মেহমান আসবে বলেই খালাস, মা কিন্তু ঠিকই কাউকে পাঠিয়ে আনাজপাতি আনিয়েছেন, দিনশেষে বাবাকে খরচের হিসেবও বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমি রাগলে বলতেন, চাওয়ার আগে হিসেব দেই বলেই উনি কোনোদিন সন্দেহ করতে পারেন নি। আর এখন? সময় যেন উল্টো পথে ঘুরছে! আজকের ‘উচ্চশিক্ষিত’ গৃহিণীরা দেখি কাঁচামরিচ শেষ হয়ে গেলে মরিচ ছাড়াই রান্না বসান কারণ স্বামীর বাজার করতে মনে থাকে না! এই যে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র কাজে স্বামীর উপর নির্ভরতা–এ কি মেরুদন্ডহীনতা না? খালি হাফ-হাতা জামা পরলেই আধুনিক? একটা ডিভোর্স দিলে, গভীর রাত পর্যন্ত পার্টি করলে বা শ’য়ে শ’য়ে ছেলেবন্ধু থাকলেই আধুনিক? বাইরের কাজের বেলায় আরেকজনের আশায় বসে থাকা–সেটা কী আধুনিকতার খেলাপ না?

এসি