ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

মাঘের শীতে ঠাণ্ডা পানিতে স্নান করা শিক্ষক

সোহরাব শান্ত

প্রকাশিত : ১০:৪৬ পিএম, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সোমবার | আপডেট: ১০:২৬ এএম, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার

শিক্ষক সুধীর চন্দ্র বর্ধন

শিক্ষক সুধীর চন্দ্র বর্ধন

মাঘের তীব্র শীতে কাঁপছে সবাই। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও পেশাগত ব্যস্ততার ফাঁকে শেষ বিকেলে ফোন করলাম ৮২ তে পা দেওয়া একজন শিক্ষাগুরুকে। বৈরি আবহওয়ায় এ বয়সের একজন মানুষ কিছুটা কষ্টে থাকবেন অনুমেয় ছিল। তবুও জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছেন স্যার?’ তিনি বললেন, ‘ভালো আছি, সোহরাব’। ‘তবে এখন তেমন হাঁটাচলা করতে পারিনা’- যোগ করলেন পরের বাক্যে। মনটা বিষাদে ভরে ওঠল।

পাঁচ মাস আগে তাঁর সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছে। সেদিনও বৈরি আবহাওয়া ছিল। করোনা মহামারীর কারণে দেশে তখন ‘লকডাউন’ চলছে। তার উপর মুষলধারে বৃষ্টি চলছে টানা দু’দিন। আমি গ্রামের বাড়িতে। হুট করেই জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনটা করতে হলো। গ্রামের পুরনো বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে ওঠার দিন দুই পরই সীমিত পরিসরের আয়োজন। তথাকথিত রং-রসহীন এই আয়োজনে আত্মীয়, বন্ধু, সুহৃদ, এলাকাবাসীর অতি ক্ষুদ্র একটি অংশকে নিমন্ত্রণ করা হলো। দু’দিনের বৃষ্টির কারণে গ্রামীণ রাস্তাঘাটে চলা মুশকিল। এমনকি আমাদের বাড়ির সামনের পাকা সড়কটিতে যান চলাচল একেবারে নেই বললেই চলে। বর্ষার পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতি, পাকা সড়কে উঠতে হাত দেড়েক বাকি। অতিথিদের কেউ কেউ আয়োজনে আসতেই পারলেন না। কিন্তু তিনি দূরের গ্রাম থেকে দুর্বল শরীর নিয়ে বাড়িতে এসে হাজির। আমি আবেগাপ্লুত। অনেকবার অনুরোধের পর সামান্য কিছু মুখে দিয়ে তিনি নবদম্পতিকে আর্শীবাদ করে গেলেন। কারণ আমি যে তাঁর প্রিয় ছাত্রদের একজন!

স্যারকে বললাম তিনি যেন একটু সাবধানে থাকেন। ঠাণ্ডা যেন না লাগে। কিন্তু তিনি শোনালেন সম্পূর্ণ বিপরীত কথা। তীব্র শীতেও তিনি পুকুরের ঠান্ডা পানিতে স্নান করছেন! আমি বিস্ময় প্রকাশ করতেই যতটা সম্ভব হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘ঠান্ডা জল দিয়ে স্নান করা ভালো তো। প্রতিদিন ভোরে উঠে স্নান করে ফেললে সারাদিন ভালো লাগে।’ আমি চুপ হয়ে শুনি। মনে পড়ে ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের কথা। সেবার তিনি ‘সাদা মনের মানুষ’ হিসেবে পুরস্কার পেলেন। ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে (তখনকার শেরাটন হোটেল) সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান। দু’দিন আগেই স্যার ঢাকা এলেন। স্যারের মনোনয়নদাতা হিসেবে সঙ্গী হলাম আমিও। আবাসনের ব্যবস্থা হলো বারিধারার একটি তিন তারা হোটেলে। বিশাল কক্ষে আলাদা বিছানা। স্যারের সঙ্গে শুয়েছে তাঁর এক ভাতিজা। আমি আলাদা বিছানায়। মধ্যরাতে অদ্ভূত দৃশ্যের অবতারণায় ভয় পেয়ে গেলাম। ডিম লাইটের আলোয় এক সময় বুঝতে পারলাম, স্যার যোগ ব্যায়াম করছেন। বিশেষ কিছু আসনে তাঁকে দেখে আমি একদিকে মুগ্ধ, অন্যদিকে ভিতও হলাম! তো এমন মানুষটির পক্ষে ৮১ বছর বয়সে দুর্বল শরীর নিয়ে ভোরবেলা পুকুরের ঠান্ডা পানিতে স্নান করা অসম্ভব নয়।

যার কথা বলছি, তিনি আমার হাই-স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক সুধীর চন্দ্র বর্ধন। তাঁর গল্প করার বিশেষ কারণ আছে বৈকি। ভদ্রলোক ছিলেন ওয়াপদার হিসাবরক্ষক। কিন্তু একটি পিছিয়ে পরা এলাকায় শিক্ষা বিস্তার করার মানসে লোভনীয় চাকরি ছেড়ে ভাঙাচুরা এক নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিয়ে বসলেন। তাঁর শ্রমে-ঘামে-পরিকল্পনায় স্কুলটি মাধ্যমিক হলো। গুণে-মানে সেরা হলো। শুধু তাই নয় তিনি আশেপাশের আরও কয়েকটি স্কুল গড়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেন। এসব করতে গিয়ে মানুষটি বিয়ে পর্যন্ত করলেন না। হলোনা সংসার-সন্তান। পুরোপুরি ত্যাগের এক জীবন।                                                           

মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আগে স্যারকে ৮২তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালাম(বাস্তবে আরো বেশি হতে পারে বয়স। গ্রামাঞ্চলে আগেকার দিনে জন্মদিন লিখে রাখার প্রচলন ছিলনা। একাডেমীক কাজে তাই আনুমানিক একটা জন্ম সাল ব্যবহার করা হতো)। তিনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন-‘আমার মতো সাধারণ মানুষের জন্মদিন পালনের কি আছে। আমিতো সমাজের জন্য বলার মতো কিছুই করতে পারিনি। তারপরও তোমাকে ধন্যবাদ।’ স্যার, আপনি বিনয় দেখিয়ে আরো উঁচুতে ওঠলেন। সমাজ আপনার মূল্যায়ন করতে না পারলেও, আপনার কাজ আপনাকে অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখবে। ১ ফেব্রুয়ারি বারবার মনে করিয়ে দেবে ‘একুশে পদক’ পাওয়ার যোগ্য মানুষটি ‘মফস্বলের একজন শিক্ষক’ হিসেবে বেঁচে থাকলেও তাঁর স্থান হাজারো শিক্ষার্থীর অন্তরে। এসব শিক্ষার্থী আপনার সন্তানতুল্য। 

প্রসঙ্গত, সুধীর চন্দ্র বর্ধন। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দ  ইউনিলিভার বাংলাদেশের উদ্যোগে সারাদেশ থেকে নির্বাচিত ১০ জন সাদা মনের মানুষের একজন। জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার বেরুইন গ্রামে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি। ওয়াপদার (বিদ্যুৎ বিভাগ) চাকরিতে যোগ দেন ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ। বছর চারেক চাকরি করেন এখানে। প্রথমে কুমিল্লা এবং শেষদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এ সময়ই তিনি জানতে পারেন ভলাকুট স্কুলের কথা। ভঙ্গুর যোগাযোগ ব্যবস্থা আর শিক্ষার আলোবঞ্চিত এলাকা হওয়ায় সেই স্কুলে কোনো ভালো শিক্ষকই থাকতে চাইতেন না। 

কুমিল্লার জনৈক শিক্ষক চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসে কৌতুক করে সেই এলাকাকে বলেছিলেন, ‘ভূতের এলাকা’। এ কথা শুনে ক্ষোভ আর অপমানে ‘শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে ভূতের এলাকার’ দুর্নাম ঘোচানোর কঠিন সংকল্প করেন সুধীর চন্দ্র বর্ধন। চাকরি ছেড়ে প্রত্যন্ত এলাকার সেই স্কুলটির দায়িত্ব তুলে নেন হাতে। নিজ গ্রাম থেকে তিন মাইলের বেশি দূরে স্কুলটির অবস্থান। স্কুলটিকে নিয়ে শুরু হয় তার নতুন সংগ্রাম। স্কুলের দায়িত্ব নিয়েই মনোযোগ দেন ছাত্রছাত্রী বাড়ানো এবং অবকাঠামো উন্নয়নে। মাত্র ২১ জন ছাত্র ছিল যখন দায়িত্ব নেন। আর দায়িত্ব ছাড়ার সময় ছাত্র সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০। মাঝের সময়টুকু কেবলই সংগ্রামের। ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি করতে ছুটে গেছেন গ্রামের মানুষের ঘরে ঘরে। ধীরে ধীরে ভাঙাচোরা স্কুলটাকে গড়ে তুলেছেন মানুষের সহায়তায়। নিম্নমাধ্যমিক থেকে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ ভলাকুট কে. বি. উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয় প্রতিষ্ঠানটি।

২০০১ খ্রিস্টাব্দ স্বেচ্ছায় অবসরে গিয়েছিলেন সুধীর চন্দ্র বর্ধন। কিন্তু এলাকার মানুষ আর ছাত্রছাত্রীদের অনুরোধে আবারও দায়িত্ব হাতে তুলে নেন। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দ ফের অবসর। তারপর স্বীয় প্রচেষ্টা ও অধ্যয়নের মাধ্যমে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার যতটুকু আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন, তাই দিয়ে দিনের পর দিন প্রায় বিনামূল্যেই মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে গেছেন। বর্তমানে লেখালেখি আর সামাজিক কাজ করেই কাটিয়ে দিচ্ছেন জীবনের পড়ন্ত বেলা।

     সোহরাব শান্ত

লেখক : সাংবাদিক ও গল্পকার।

কেআই//