ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

সেলিম জাহানের কলাম-এই সময়ে

ও পারতো কেবল একজনাই

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৭:২০ পিএম, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বুধবার

‘এ পৃথিবী একবার পায় তাকে, পায় না কো আর’। 
বছর চারেক আগের এক ৩রা ফেব্রুয়ারীর কথা। রুজভেল্ট দ্বীপের বাড়ীতে আমি থাকি তখন। সেবার ক'দিন ধরেই কবি জয় গোস্বামীর কবিতার একটি চরণ মনের মধ্যে অবিরত ঘুরপাক খাচ্ছিল, 'রাত্রি জাগার রীতি কেবল জানত সে বাড়ীটি, সাতাশ নং বকুল বাগান রোডের'। 

ও চরনটি অকারণে মনে পড়ে নি, মনে পড়েছিল আমার খুব প্রিয় লেখক নোবেল বিজয়ী জে. এম. কুদসিয়ার The Master of Petersburg বইটি খুঁজতে গিয়ে। হন্যে হয়ে খুঁজছিলাম, কিন্তু পাচ্ছিলাম না। আমাদের রুজভেল্ট দ্বীপের বইঘরের তিন হাজার বইয়ের  পুস্তকারণ্যের ভেতর ( দুই হাজার ইংরেজী আর এক হাজার বাংলা) থেকে একটি বই বার করা সহজ নয় বটেই। ভাষার বিভাজনের মতো স্বত্ত্বের বিভাজনও তো ছিল - সব বাংলা বই আমার, সব ইংরেজী বই ওর।

সুতরাং কাঙ্খিত কোন একটি ইংরেজী বই আমি খুঁজেই পেতাম না। একদিন অনুযোগ করলে আমাকে বইয়ের তাকগুলো দেখিয়ে বলা হল যে বইগুলো লেখকের নামের আদ্যাক্ষর অনুসারে সাজানো আছে। বড় স্বস্তি বোধ করেছিলাম।

তবে এ স্বস্তি দীর্ঘস্হায়ী হল না যখন ক'দিন পরেই একটা বই বার করতে গিয়ে তাকের সামনে দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করেছিলাম যে আদ্যাক্ষর রীতি সেখানে বিলুপ্ত। প্রশ্ন করলে জবাব পেতাম যে সেখানে পুস্তকমালা উচ্চতা অনুসারে সাজানো আছে - লম্বা বই প্রথমে, তারপর বেঁটে বই। জেনেছিলাম এবং শিখেছিলাম। 

নিয়মটা ভালই চলছিল। কয়েকদিন পর আবার হোঁচট খেতে হল তাকগুলো ধরে আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতেই। লম্বা-বেঁটের নির্ণায়ক অন্তর্হিত। শুনলাম, ওখান থেকে প্রথমে শক্ত মলাটের বই, তার বাদে নরম মলাটের। ততদিনে আমার প্রাথমিক বোধোদয় হয়েছিল যে বই সাজানোর এই অতি বিজ্ঞানসম্মত নিয়ম বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে।

তবু যা হোক নিয়মটা মোটামুটি চলছিল। হঠাৎ একদিন বইঘরের এক কোনার তাকের সামনে গিয়ে আবিষ্কার করেছি যে লেখকের নামের আদ্যাক্ষর, বইয়ের উচ্চতা, মলাটের ধরন কোন নিয়মই সেখানে খাটছে না। জানলাম ওটা হচ্ছে ওর প্রিয় বইয়ের জায়গা। 

ততদিনে আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি। বুঝে গেছি যে এই অতি সৃষ্টিশীল নিয়মের অনাসৃষ্টি থেকে কোন বই খুঁজে বার করা আমার কম্মো নয়। আমার নিয়ম আমিই বার করে নিলাম - ভাবলাম ঐ তিন সহস্রাধিক বইয়ের সামনে দাঁডিয়ে আমি চোখ বুলোতে থাকব যতক্ষণ না ইপ্সিত পুস্তকটি পাই। তাতে দু’ঘণ্টা লাগে তো লাগুক - কি আর করা!

এটা করতে গিয়ে আমার লাভই হল। আমাকে বইঘরে দেখলেই ও দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসত। 'কি বই খুঁজছ, বল। এক্ষুণি বার করে দিচ্ছি'। বইয়ের নাম বললেই এক লহমা ভেবে হাত বাড়িয়ে ঐ ৩ হাজার বইয়ের কোন এক কোনা থেকে কাঙ্খিত বইটি টেনে নিয়ে আসত। একবার নয়, দু'বার নয়, এটা বারবার হয়েছে, প্রতিবার হয়েছে। কেমন করে পারত, আজও জানি না।

ভুলো মন ছিল জগতের নানান বিষয়ে, খেয়াল করত না বহু কিছুই, আপন ভোলাই ছিল জীবনের বহু ক্ষেত্রে। ব্যতিক্রম ছিলাম আমরা তিনজন - আমাদের কন্যাদ্বয় ও আমি - এবং আমাদের বাড়ীর পুস্তকারণ্য। কোন বইয়ের কথা উঠলেই তার প্রচ্ছদের রং, বাঁধাইয়ের ধরন, পুস্তকের আকৃতি সব বলে দিতে পারত কোন ভাবনা-চিন্তা বাদেই। আমি এটাকে সর্বদাই ঠাট্টা করে ‘বিধিপ্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতাই’ বলতাম। 

আমি জানি, আমি প্রায়শ:ই বই খুঁজে পাবো না। সে কথা আমাদের কন্যাদের বললে, ওরা খুব মমতার সঙ্গে নরম গলায় বলবে, 'চিন্তা কোর না, আমরা এসে খুঁজে দেব'। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে ওরা নিশ্চয়ই পাবে, খুঁজতে খুঁজতে আমিও হয়তো একদিন বইটি পেয়ে যাবো।

কিন্তু এক লহমা ভেবে হাত বাড়িয়েই এই পুস্তকারণ্যের কোন এক কোনা থেকে যে কোনো বই এক নিমিষে বার করে নিয়ে আনতে আমরা কেউই পারব না - না আমাদের কন্যারা না আমি নিজে। ও কেবল একজনই পারত - যেমন 'রাত্রি জাগার রীতি কেবল জানত সে বাড়ীটি ২৭ নং বকুল বাগান রোডের'।

আজ ৩রা ফেব্রুয়ারী - বেনুর চলে যাওয়ার ষষ্ঠতম বার্ষিকী। কেন যেন মনের মধ্যে ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা কয়’ ক’টি লাইন,

‘উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায়, 
মানুষের আয়ু শেষ হয়, 
পৃথিবীর পুরানো সে পথ 
মুছে ফেলে রেখা তার -
কিন্তু এই স্বপ্নের জগৎ
চিরদিন রয়।’