ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

ক্যান্সার প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

প্রকাশিত : ১০:৩৯ এএম, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বৃহস্পতিবার

 

ক্যান্সার যে কোনো বয়সেই হতে পারে। তবে আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন আর ক্যান্সার মানেই অবধারিত মৃত্যু নয়। একটু সচেতন হলেই ক্যান্সারকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। যদি ক্যান্সার হয়েও যায় তবুও শুরুতেই দ্রুত শনাক্ত করতে পারলে তার ভালো চিকিৎসা করা যায়, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভও সম্ভব। তাই ক্যান্সার নামক এই বিভীষিকার হাত থেকে বেঁচে থাকতে হলে আমাদের দরকার যথাযথ শিক্ষা ও সচেতনতা।

আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের চরম উন্নতির মধ্যেও ক্যান্সারের পুরোপুরি কারণ এখনো জানা নেই। কিছু কিছু পারিপার্শ্বিক, পেশা, এমনকি জীবনযাত্রার পদ্ধতি বা কুঅভ্যাস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। কুঅভ্যাসের মধ্যে রয়েছে —  

* প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপান।

* দীর্ঘদিন মদ্যপানের অভ্যাস।

* খাদ্যাভ্যাস (যেমন— খাদ্যে ফাইবারের অভাব, ভিটামিন বা অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের অভাব)।

* প্রিজারভেটিভ, কেমিক্যাল বা রংযুক্ত খাবার।

* আর্সেনিকযুক্ত পানি পান।

* পরিবেশ দূষণ এবং কেমিক্যালের সংস্পর্শে আসা।

* বিভিন্ন ধরনের বিকীরণ (যেমন সূর্যরশ্মি, অতি বেগুনি রশ্মি, এক্স-রে, কসমিক-রে ইত্যাদি)।

* কর্মস্থল বা পেশাগত কারণে অনেকের ক্যান্সার হতে পারে, যেমন রেডিয়েশন বা কেমিক্যাল নিয়ে কাজ করা, অনেকক্ষণ রোদে থেকে কাজ করা, জাহাজ ভাঙার শ্রমিক, রং ও রাবার কারখানার কর্মী ইত্যাদি।

* বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা অন্যান্য জীবাণুর দ্বারা ইনফেকশনের ফলে ক্যান্সার হতে পারে, যেমন হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস, এপস্টিন বার ভাইরাস, হ্যালিকোব্যাক্টর পাইলোরি, হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস, এইডস ভাইরাস ইত্যাদি। সিস্টেসোমা জাতীয় জীবাণু মধ্যপ্রাচ্য বা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মূত্রাশয় ক্যান্সারের কারণ হিসেবে বিবেচিত। 

* অতিরিক্ত শারীরিক ওজন বা স্থূলতা।

* কিছু কিছু ওষুধ বা চিকিত্সা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

* অনিয়ন্ত্রিত যৌন সম্পর্ক, একাধিক যৌনসঙ্গী, পেশাদার যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ইত্যাদি।

* ক্রোমোজম বা জিনের কারণেও ক্যান্সার হতে পারে। ক্যান্সার প্রতিরোধে এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

ক্যান্সারের লক্ষণ নির্ভর করে কোথায় কী ধরনের ক্যান্সার হয়েছে তার ওপরে। অনেক ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণই থাকে না। দেখা গেছে যে, ক্যান্সার ছড়িয়ে যাওয়ার পরেই তা ধরা পড়ে। তারপরও কিছু কিছু লক্ষণ বা উপসর্গ থাকলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।  যেমন—

* সুস্থ ছিলেন, হঠাত্ ওজন কমে যাওয়া।  

* অরুচি বা ক্ষুধামন্দা।

* অতিরিক্ত দুর্বলতা, রক্তাল্পতা, দাঁতের গোড়ায় বা নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ, চামড়ার নিচে জমাট রক্ত ইত্যাদি।

* শরীরে কোথাও চাকা বা গোটা দেখা দিলে বিশেষ করে গলায়, বগলে, কুঁচকিতে, পেটে বা মহিলাদের স্তনে।

* দীর্ঘদিন জ্বর থাকলে, বিশেষ করে যদি রাতের বেলা প্রচুর ঘাম দেয়।

* অনেক দিনের কাশি যা সাধারণ চিকিত্সায় ভালো হচ্ছে না, বিশেষ করে বয়স্কদের বেলায় এবং কাশির সঙ্গে রক্ত এলে।

* গলার স্বর ভেঙে গেলে বা কাশির সঙ্গে গলার স্বরের পরিবর্তন হলে।

* বয়স্কদের প্রস্রাব করতে সমস্যা হলে, ব্যথা হলে বা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত গেলে।

* পায়খানার অভ্যাস পরিবর্তন হলে বা পায়খানার সঙ্গে রক্ত গেলে।

* খাবার গিলতে অসুবিধা বা ব্যথা।

* বদহজম, দীর্ঘদিনের পেটে ব্যথা বা রক্তবমি।

* মহিলাদের ক্ষেত্রে মাসিকের পরিবর্তন হওয়া, যাদের মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে তাদের আবার রক্তক্ষরণ হওয়া।

* মাথাব্যথা, খিঁচুনি, জ্ঞান হারানো, হঠাত্ বমি করা ইত্যাদি।

* চামড়ায় নতুন করে রঙের পরিবর্তন, তিলের আকার বা গড়ন পরিবর্তন হওয়া ইত্যাদি।  তবে মনে রাখতে হবে যে, এসব লক্ষণ অন্য বিভিন্ন রোগের কারণেও হতে পারে।

তাই এগুলো হলেই ক্যান্সার হয়েছে ভেবে কেউ যেন অযথা আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে পড়েন।

অনেক ক্যান্সারই সময়মতো চিকিৎসায় নিরাময়যোগ্য। ক্যান্সারের প্রকারভেদে, কতটুকু ছড়িয়ে গেছে, কী কী সমস্যা করছে, রোগীর বয়স কত আর শারীরিক অবস্থা কেমন— এসবের ওপর ভিত্তি করে ক্যান্সারের নানারকমের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ জন্য চিকিৎসার আগেই বায়োপসি, টিস্যু পরীক্ষা, নানা রকমের স্ক্যান, রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদি করা হয়। আবার অনেক ক্যান্সার চিকিৎসা ভালো হয় না অথবা ছড়িয়ে গেলে চিকিৎসা করার আর উপায় থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা ক্যান্সারের আধুনিক চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয়বহুল এবং দরিদ্র রোগীদের নাগালের বাইরে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও অনেক বেশি। তাই চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করাই উত্তম।

প্রত্যেক সুস্থ ব্যক্তিরই উচিত নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো যাতে শরীরে কোনো ক্যান্সার দানা বাঁধতে শুরু করলে তা প্রাথমিক অবস্থাতেই দমন করা সম্ভব হয়। বিশেষ করে বয়স্কদের বৃহদান্ত্র বা কোলন, মহিলাদের জরায়ুমুখ ও স্তন, পুরুষদের প্রোস্টেট ইত্যাদি নিয়মিত পরীক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্বীকৃত।

লেখক : অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ, অধ্যাপক ও ডিন, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।