কোভিড ১৯: অর্থনীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট ও উত্তরণ
প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ
প্রকাশিত : ০৮:১৫ পিএম, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শুক্রবার | আপডেট: ০৮:২৩ পিএম, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শুক্রবার
বিশ্ব চিরাচরিত যে শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত ছিল এবং অর্থনৈতিকভাবে পৃথিবী বিগত দশকগুলিতে যে অগ্রগতির ধারায় এগুচ্ছিল, কোভিড-১৯ এর ফলে ব্যাপকভাবে তার নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘকালের ধারাবাহিকতায় শিক্ষা ব্যবস্থার ধরণ ও স্বরূপ বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং ক্রমশ তার আধুনিকায়ন ঘটেছে। কিন্তু কোভিড-১৯ এর কারণে যে পরিবর্তন ঘটেছে তাতে নতুন প্রজন্মের আগামীর স্বপ্নসৌধ নির্মাণের মূলকেন্দ্র শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিঘ্নিত হয়েছে।
গত বছরের জুলাই পর্যন্ত ১৬০টিরও বেশি দেশের স্কুল বন্ধ ছিল। এতে এক শ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনার কারণে দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় মোট শিক্ষার্থীর ৯৪ ভাগ কোনো-না-কোনোভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের ৯৯ ভাগই নিম্ন বা নিম্ন মধ্য আয়ের দেশের শিক্ষার্থী। বর্তমান পৃথিবী এমন এক বিপর্যয়ের শিকার, যার প্রভাব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পড়বে, মানবজাতির অন্তর্গত যে সম্ভাবনা রয়েছে তা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, বিগত দশকগুলোর উন্নতির যে ধারা তা বাধাগ্রস্ত হবে। শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় ব্যাঘাতের কারণে শিশুদের পুষ্টিহীনতা, বাল্যবিবাহ ও নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাবার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, করোনার ফলে প্রায় ১ কোটি বাচ্চা আর কখনো স্কুলে ফিরবে না। প্রায় ১২ কোটি বাচ্চার পরিবার দারিদ্রের শিকার হবে। বিশেষ করে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নাইজার, নাইজেরিয়া, সেনেগাল, আইভরি কোস্ট, ইয়েমেন, গিনি, মরিটেনিয়া, লাইবেরিয়া ও চাদ-এসব দেশের শিক্ষার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। গত এপ্রিলে ১৬০ কোটি তরুণ-তরুণী স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শতকরা হিসেবে যা ৯০ শতাংশ। এছাড়া নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর শিক্ষার অবস্থাও ভালো নয়। সেভ দ্য চিলড্রেনের রিপোর্টের তথ্য অনুসারে, এ ধরণের দেশগুলি শিক্ষাখাত থেকে সাত হাজার ৭ শত কোটি ডলার বরাদ্দ হ্রাস পাবে। মানুষের ইতিহাসে শিক্ষা ব্যবস্থায় এতো বড় আঘাত এটাই প্রথম।
বহু দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনো বন্ধ রয়েছে। ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বরে শুরু হওয়া করোনার আগে পৃথিবীতে আরো অনেক মহামারির শিকার হয়েছে। কিন্তু সে সব মহামারির প্রকোপ ছিল কোন দেশ বা অঞ্চলভিত্তিক। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ অব্দে প্লেস অব অ্যাথেন্স, ৫৪১ খ্রিস্টাব্দে জাস্টিনিয়ার প্লেগ,১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে দ্য ব্লাক ডেথ,কলেরা মহামারি, এশিয়ান ফ্লু, গুটি বসন্ত, এইচআইভি, সার্স, ইবোলা স্প্যানিশ ফ্লু-এরকম অসংখ্য রোগে পৃথিবী আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু তা পুরো পৃথিবীকে দখল করতে পারেনি। এসব মহামারি যে সব অঞ্চলে বা দেশে হয়েছিল, সেসব অঞ্চল বা দেশ শিক্ষা, অর্থনীতি সর্বক্ষেত্রে ধ্বংসে পরিণত হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু তারা দেখেছে। কিন্তু তখন পৃথিবীর অন্যসব দেশ বা অন্যসব অঞ্চল মহামারি আক্রান্ত সেসব দেশের বা উপমহাদেশের পাশে সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছে। যে কারণে তারা মহামারি কাটিয়ে দ্রুত স্বাভাবিকতায় ফিরতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু পুরো পৃথিবীর এমন ভয়াবহ মহামারির রূপ এই প্রথম। এত বড় আঘাত পৃথিবীতে আর কখনো ঘটেনি। ১৯০টিরও বেশি দেশের প্রায় ১.৬ বিলিয়ন শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পৃথিবী নিজেই যখন মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, সেই পৃথিবীর ছোট্ট একটা দেশ বাংলাদেশও যে মৃত্যু আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শিকার হবে, শিক্ষা থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই ভয়ঙ্কর ক্ষতির শিকারে পরিণত হবে। তারপর মানুষ সবসময় সবধরণের প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে, মহামারিকে জয় করে জীবন জয়ের গান গেয়েছে। কিন্তু সেজন্য অনেক মূল্য দিতে হয়-কঠোর মনোবলে নতুন শক্তিতে নব উদ্দীপনায় দৃঢ়তায় দাঁড়াতে হয়। পুরো পৃথিবী এখন প্রচেষ্টাতেই নতুন আর এক পৃথিবী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। আমরা নিজেরাও সে প্রচেষ্টার সক্রিয় সাহসী সহযাত্রী। করোনাকে আমরা জয় করতে পারবো- শক্তিমত্তায় সেই সাহস, দৃঢ়তা ও মনোবল আছে। তারপরও এটা সত্য, করোনায় আমাদের যে ক্ষতি তা সহজে পূরণীয় হবে না। বহুকাল ধরে এর মূল্য দিতে হবে। করোনায় শিক্ষা ব্যবস্থার যে অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে, সেকথায় আসি।
একটা সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সশরীরী উপস্থিতি ও চিন্তা-চেতনা-ভাবনার প্রকাশের মূলকেন্দ্র ছিল শ্রেণিকক্ষ। কিন্তু বর্তমানে মহামারির এই ভয়াবহ সংকটে চিরন্তন সে স্বরূপ ও চিন্তনের পুরোটাই পরিবর্তন ঘটেছে। তথ্য-প্রযুক্তির কারণে পুরো পৃথিবী এখন বিশ্বায়নে (Gilobal Village) পরিণত হয়েছে। বিশ্বায়নের ফলে যে আন্তর্জাতিক অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে বিনিয়োগ, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও বিপণন আন্তঃদেশীয় পরিসরে পরিব্যাপ্তি লাভ করেছে। এর ফলে গোটা বিশ্ব একটি ব্যাপ্ত সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে, করোনা মহামারিতে গোটা বিশ্ব আক্রান্ত হওয়ায় এমন একটা সময়ে আমরা আছি, যখন শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক ক্ষতির মধ্য থেকেও তথ্য-প্রযুক্তির সুবিধার্থে অভূতপূর্ব কিছু ধারণা উদ্ঘাটিত হয়েছে, শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যকরি রাখতে নতুন নতুন কৌশল তৈরি হয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে একেবারে প্রান্তিক অঞ্চল পর্যন্ত ডিজিটাল শিক্ষা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষায় নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হচ্ছে, নতুন নতুন বিভিন্ন পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটছে এবং তা শিক্ষার্থীদের প্রদান করাও এখন সম্ভব হচ্ছে। গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থায় যে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে, তা এখন আর অস্বীকার করার উপায় নেই। বরং সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তিত তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর এসব শিক্ষা-পদ্ধতি সানন্দে গৃহীত হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জন্য বর্তমান বিশ্ব অবারিত ও অপার স্ম্ভাবনা তৈরি করেছে। শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তির সমন্বয় ও ব্যবহার গত এক দশক ছিল যুগান্তকারী একটা পদক্ষেপ। ভবিষ্যতে হয়তো আরো নতুন নতুন প্রযুক্তি আসবে যাতে করে শিক্ষার ব্যবস্থার প্রসার ও অগ্রগতি বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। সে সম্ভাবনার অপার আলো আমরা প্রতিনিয়ত উপলব্ধি ও লক্ষ করছি।
করোনাকালীন সময়ে অর্থনীতি, উৎপাদন-বিপণন, স্বাস্থ্য, গবেষণা-শিল্প-সাহিত্য-প্রকাশনা এসবের সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থাতেও ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। পৃথিবীজুড়েই সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে। তাই বলে গোটা পৃথিবীর শিক্ষা-কার্যক্রম বন্ধ বা স্থবির হয়ে আছে তা কিন্তু নয়। প্রযুক্তির অত্যাধুনিকতায় বিশ্বের সব দেশেই শিক্ষা কার্যক্রম সফল ও স্বাচ্ছন্দ্যভাবে পরিচালিত হচ্ছে। আমরা প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার কওে শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তা সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা এখন প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা কার্যক্রম আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করছে। অনলাইনে পদ্ধতিতে ক্লাস, পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, ওয়েবিনার আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় একেবারেই নতুন সংযোজন। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ ও সাহায্য-সহযোগিতা বিশেষভাবে প্রশংসনীয়। সরকারের সময়োপযোগী কার্যকরি এ উদ্যোগে শিক্ষার্থীরা নতুন এ বিষয়টাকে সহজে গ্রহণ করে নিজেকে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রসরমান নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারছে। অনেক আগেই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন রূপায়ণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। গত এক দশকে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ছিল অপ্রতুল। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে বিশ্বে করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর সেই ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের রূপরেখা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ায় বাস্তব রূপ লাভ করে চলেছে। করোনার প্রথম পর্যায়ে তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা কার্যক্রমশিক্ষার্থীদেও মধ্যে দ্বিধা বা ভীতি সঞ্চার করলেও, খুব দ্রুতই তা সহজ ও সাবলীলভাবে গ্রহণ করে নিজেদের নবধারার শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত করে সানন্দে গ্রহণ করতে পেরেছে। এটা এখন আর কোন জটিল বা ভয়ের ব্যাপার বা অনিশ্চয়তার ব্যাপার নেই। অভাবনীয় উজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের সম্ভাবনা তৈরি করেছে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর এ শিক্ষাব্যবস্থা। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তির উন্নত শিখরে। প্রযুক্তিকে গ্রহণ করেই মাতৃভাষার মমত্ব ধারণ করেইÑবাঙালিত্বের শক্তিমত্তায় নিজেকে বিশ^নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সময়ের দাবি।। আমরা সেদিকেই ভালোভাবেই এগিচ্ছি বলে মনে করি। প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীরাও প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নত গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে। আবার যেসব শিক্ষক তথ্য-প্রযুক্তিতে অতটা পারদর্শি ছিলেন না, তারাও সময়ের প্রয়োজনে মোবাইল ও কম্পিউটার ব্যবহাওে দক্ষ হয়ে উঠছেন। তবে তথ্যপ্রযুক্তি আরো উন্নতমানের ও সহজলভ্য করা গেলে কাক্সিক্ষত ডিজিটাল বাংলাদেশ শিগগিরই অর্জিত হবে-এটা বলতেই পারি।
শিক্ষা এবং অর্থনীতি-একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পূর্ণভাবে যুক্ত। একটি ভিন্ন অন্যটি অর্জন এ সময়কালের বিবেচনায় কঠিন। করোনায় শিক্ষা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আবার সেই ক্ষতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটেছে, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি একই। দেশের শিল্প খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির ৮০ শতাংশই অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের। করোনা মহামারি এসএমই শিল্পে নতুন করে ভাবনাচিন্তার তাগিদ সামনে নিয়ে এসেছে। এর অনেক কারণও আছে। মানুষের আয় কমেছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমান কমেছে। মধ্যবিত্তের সঞ্চয় প্রবণতাও হ্রাস পেয়েছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসামঞ্জস্য ক্রমেই বাড়ছে। কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে। বেকারত্ব বেড়েছে। এর পরেও বাংলাদেশ বর্তমানে যে ধরণের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে এগুচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সালের মধ্যে দেশটি বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনোমিক্স এন্ড বিজনেস রিসার্চ তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এরকমটিই বলেছেন। এই গবেষণা-ভাষ্য অনুযায়ী, ২০৩৫ সালের মধ্যে ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বহু ধাপ এগিয়ে ২৫ নম্বরে উন্নীত হবে। ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বের ধনী-গরিব সব দেশই ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কটের শিকার। কর্মহীন হয়েছেন কোটি কোটি মানুষ। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০ ও ২০২১ এই দুই বছরে সারা বিশ্বের ১১ কোটি থেকে ১৫ কোটি লোক নতুন করে গরিব হয়ে যেতে পারেন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) বলেছে, কোভিড-১৯ এর কারণে দারিদ্র্য হার ১৯ থেকে বেড়ে ২৯ শতাংশ হয়েছে।
দরিদ্রতা বেড়ে যাওয়ার একদিকে যেমন অর্থনৈতিক সংকট বেড়েছে অন্যদিকে নতুন রূপে, ভিন্নভাবে ক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোক্তাগণ তৈরি হচ্ছে। অনলাইন ব্যবসা বা ই-কমার্স অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে এই সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। আলু-পটলও যে অনলাইনে কেনা যায়, তা এই করোনাকাল শিখিয়ে দিল দেশের মানুষকে। এখন অনেকেই অনলাইনে কাঁচাবাজার সারছেন। ওষুধ, ইলেকট্রনিকস পণ্য, পোশাক, গৃহস্থালির বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনার প্রবণতা চলছে প্রতিযোগিতা দিয়ে। এ সময়ে বাজারে নতুন তৈরি হওয়া চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে কিছু ক্ষুদ্র উদ্যোগ ভালো ব্যবসা করেছে। সবজি ও ফল, নাস্তা, সুরক্ষা সামগ্রী, পোশাক ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদার ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটেছে। এসব উদ্যোগের প্রায় শতভাগই অনলাইনভিত্তিক, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যবসা করছেন। সামাজিক মাধ্যমে এই মূহুর্তে প্রায় দুই হাজারের মত নতুন প্রতিষ্ঠান পণ্য বিক্রি করছে। আর এর সঙ্গে সহায়ক ভূমিকা পালন করে দেশের ২০০টির বেশি কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যস্ততাও বহুগুণ বেড়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে কোভিড-১৯ কে হুমকি হিসেবে দেখছি না, মহামারীর শিকার পৃথিবী এটাই মেনেই এও মনে করছি, নানাবিদ সম্ভাবনার দিকও উন্মুক্ত হচ্ছে আমাদের সামনে। সে আভাসও ইতোমধ্যেই পরিলক্ষিত হয়েছে। এডিবি মনে করে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে।পুরো পৃথিবী যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, আমরা সেখানে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।
এরপরও করোনার সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকছেই। অদৃশ্য আতঙ্ক বিরাজ করছে সবার ভেতর-পৃথিবী নিজেই যখন ‘মৃত্যু অসুখে’ ক্লান্ত। তখন পৃথিবীর মানুষের এ আতঙ্ক অনিবার্য। আমরা তো এর বাইরের কোন ভিন্ন সত্ত্বা নই। যেকারণে অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিকে জয় করে অর্থনৈতিক নির্ভরতার দোরগোড়ায় পৌছাতে এখনো সময়ের প্রয়োজন। একটা বিষয় ভুলে গেলে চলবে না, মহামারীকালে শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক দৃঢ়তাও প্রবলভাবে দরকার। মানসিক প্রফুল্লতা না থাকলে অল্পতে অনেকে ভুল কাজটি করে ফেলেন। যা অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিগত শতাব্দীর মহামারীগুলো দিকে তাকালে দেখবো, ঐ সময় যারা বিপদ মোকাবিলায় ধৈর্য, দায়িত্বশীল আচরণ আর সাহস নিয়ে এগিয়ে গেছে তারাই নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছে। মানসিক দৃঢ় থাকার জন্য খুব বেশি কিছু প্রয়োজন নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, কোন সমস্যার সম্মুখিন হলে আস্থাভাজন ব্যক্তিদের পরামর্শ নিতে হবে, নিজের ওপর আস্থা রাখতে হবে, সব সময় করোনা ভাইরাস নিয়ে ভাবতে হবে না। সবধরণের নেতিবাচক চিন্তা বাদ দিন, শিশুদের সঠিক তথ্য দিন ও প্রস্তুত করুন। এসব মেনে চললে জীবন কোন কঠিন সমস্যার শিকার হবে না বলেই আমার বিশ্বাস।
অবশ্য ইতোমধ্যেই আমাদের স্বাস্থ্য বা রোগ সচেতনতা বেড়েছে। নিজের শরীরের যত্ন না নিলে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। করোনা আমাদের মাঝে এই সচেতনতা তৈরি করে দিয়েছে। করোনা আমাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বাড়িয়েছে দিয়েছে, আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে একে অপরকে ভালোভাবে বুঝার, চেনার। করোনা আমাদের আরো বেশি করে সামাজিক করে তুলেছে। পারিবারিক ও সামাজিক ভালোবাসায় বন্ধন দৃঢ় হয়েছে। বর্তমান টেকনোলজি আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে দূরে থেকেও কাছে থাকার। পরিবারের প্রতিও আমাদের দায়বদ্ধতা বেড়েছে।
পরিবেশেরও উন্নতি ঘটেছে। জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, গত বছর পরিবেশে দূষণ মাত্রা কমেছে, কার্বন নিঃসরণ কম হচ্ছে, বায়ু দূষণের সূচক ছিল সর্বোচ্চ নীচে। আমরা দেখেছি পশু পাখির কলতান, আর সমুদ্রে ডলফিনের নিশ্চিন্তে সাঁতার কাটা অবাধ বিচরণ। যা গত তিন দশকে দেখা যায়নি।
করোনাকালীন সময়ে আমাদের ধর্মীয় সচেতনতা বেড়েছে বহুগুণ। বাবা মা ও নিকট আত্মীয়-স্বজনদের বিদায়, করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল, চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টার পরও রোগীর সুস্থ না হওয়া, এসব কিছুই আমাদেরকে ধাবিত করেছে ধর্মীয় সচেতনতার দিকে। ধর্মীয় সচেতনতা আমাদেরকে শুধু আত্মার শান্তিই দেয় না, সাথে মানসিকভাবেও আমাদেরকে করে তুলে শক্তিশালী।
করোনাকালে অবর্ণনীয় নির্মম, অর্থনীতির ধ্বস, শিক্ষা ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা এসবই মহামারির অপরিহার্য পরিণতি হওয়া সত্ত্বেও মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে সুশৃঙ্খল ও পরিকল্পিত। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে সঠিক দিক-নির্দেশনামূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যদি অগ্রসর হতে পারি সেটাই হবে আমাদেও সবচেয়ে বড় সফলতা- জীবনজয়ের নতুন ইতিহাস।
(লেখক: প্রাবন্ধিক-গবেষক ও চেয়ারম্যান, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ট্রাস্ট।)
আরকে//