ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

সেলিম জাহানের কলাম

‘উশ্রী’ - একটি নদী ও একটি বাড়ীর নাম

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ০৩:০৪ পিএম, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ রবিবার | আপডেট: ০৩:১৭ পিএম, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ রবিবার

২০০৭ সালের দিকে একবার দিল্লী গিয়েছিলাম কার্যোপলক্ষে। তারপর ঝাড়খান্দে মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণক্রমে। উপলক্ষ্য 'ঝাড়খান্দ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের' উদ্বোধন। দিল্লী থেকে সঙ্গে গিয়েছিলেন ভারতে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীর সহকর্মীরা। 

ভারতে প্রদেশ পর্যায়ে তো বটেই, এমন কি জেলাপর্যায়েও এমন প্রতিবেদন তৈরী হচ্ছে। নীতিপ্রণেতারা দেখতে চাইছেন গড় পেরিয়ে সমাজের বিভাজিত চিত্র। এক সময়ের বিহারের অংশ ঝাড়খান্দের জন্য এ জাতীয় প্রতিবেদন খুব জরুরী দারিদ্র্যের আপাতন, মানব উন্নয়নের স্তর, সামাজিক অসমতা বোঝার জন্য।

উদ্বোধন অনুষ্ঠান, সরকারী কার্যক্রম অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা মিটে যাওয়ার পর দেখা গেল একদিন সময় আছে হাতে। সহকর্মীরা জানতে চাইলেন কি করতে চাই - এক লহমায় বলে দিলাম গিরিডিতে যেতে চাই। অন্য কোন কারণে নয়, শুধু এই কারণে যে এত পড়েছি গিরিডির কথা - বিমল কর, বুদ্ধদেব গুহ, দিব্যেন্দু পালিতের লেখায়।

পরের দিন রওনা দেয়া গেল গিরিডির পথে। অদ্ভুত সুন্দর পথের দু'পাশের নিসর্গশোভা। হঠাৎ রাস্তার একটা বাঁকে এসে শোনা গেল জলের কুলু কুলু ধ্বনি। তাকিয়ে দেখি অনেক ওপর থেকে চঞ্চলা ঝর্ণা নেমেছে পাহাড় থেকে, তারপর তা নদী হয়ে এগিয়ে গেছে। জলপ্রপাত দেখেছি অনেক - বিশ্বের প্রায় সেরা সবগুলো - কিন্ত কোন নদীর উৎস আগে কখনও দেখিনি।

থামা গেল এবং দলবলে নামা গেল। কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম 'নাম কি নদীর'? ‘উশ্রী', জানালেন একজন। ধাঁ করে মনে পড়ে গেল ৪৫ বছর আগের কথা। 'দেশ' পত্রিকায় তখন বুদ্ধদেব বসুর 'আমার যৌবন' ধারাবাহিক ভাবে বেরুচ্ছে। সেখানে তিনি 'উশ্রীর' কথা উল্লেখ করেছেন - নদীর নয়, তিরিশের দশকের ঢাকার একটি বাড়ীর।

দিল্লী থেকে ঢাকায় যাওয়ার কথা। গিয়েছিলাম এবং অনতিবিলম্বেই সংগৃহীত হল 'আমার যৌবন' বইটি। দেখলাম বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন এভাবে, "আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি-বারান্দায়, ঠিক  তখুনি সাইকেল থেকে নামেন 'উশ্রী' নামক বাড়িটির বাসিন্দা আমাদের ইংরেজী বিভাগের সত্যেন্দ্রনাথ রায়, সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁর তুল্য লাজুক অধ্যাপক আর নেই - আমাকে দেখে ঈষৎ লাল হন তিনি, মৃদু কেশে নরম আওয়াজে বলেন, ‘এই যে বুদ্ধু, ভালো আছো'?"

রাতের খাবার টেবিলে গল্পটা উঠল ইংরেজী বিভাগের আরেক কিংবদন্তী ছাত্র পিতৃপ্রতিম অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর উপস্থিতিতে। 'উশ্রী?', বলে ওঠেন তিনি, 'ও বাড়ীতে কত গেছি আমি। তোপখানা রোডে ছিল বাড়ীটি। অধ্যাপক এস.এন. রায়ের'। গল্পের বেড়াল থলে থেকে বেরিয়ে এল।


চিত্র: গিরিডিতে ‘উশ্রী’ ঝর্না ও নদী

"একটু ভিন্ন স্বভাবের মানুষ ছিলেন ড: এস.এন. রায় - লাজুক, কোমল কন্ঠস্বর, স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব। পড়াশোনাকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসতেন। ছাদ অবধি বইয়ের তাক উঠে যাওয়া বড় একটা লাইব্রেরী ছিল তার বাড়ীতে।

প্রায়ই যেতাম উশ্রীতে। সেখানে লাইব্রেরীতে বসে বই-পত্র নাড়া-চাড়া করেছি, নোট নিয়েছি। কখনো কখনো খাতায় লিখে রেখে কয়েকদিনের জন্য ধারও নিয়েছি দু'চারটা বই। একটা ছোট মই ছিল লাইব্রেরীতে। ওটাতে উঠেই ওপরের তাকের বই নামাতে হত।

ড: রায়ের স্ত্রী সুজাতা রায় ছিলেন ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ - উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। ওদের একটা ছোট কালো রঙের মোটর গাড়ী ছিল। সে যুগে ঢাকায় মিসেস রায় গাড়ী চালাতেন - প্রায়শই গাড়ী চালিয়ে স্বামীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নামিয়ে দিয়ে নিজের কর্মস্থলে যেতেন। অন্যদিন উশ্রী থেকে ড: রায় নিজেই সাইকেল চালিয়ে আসতেন"।

গল্প শেষ করেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। 'দেখা যায় সে বাড়ী এখন?', প্রশ্ন আমার। 'নাহ্', জবাব দেন তিনি, 'বড্ড দেরী করে পৃথিবীতে এসেছো'। তার ঠাট্টায় সশব্দ হাসির রোল ওঠে টেবিল ঘিরে।

প্রায় ১৫ বছর কেটে গেছে ঐ দিনের পর - এটা ২০২১। ‘উশ্রী' বাড়ীটি দেখিনি, কিন্তু নদীটি দেখেছি - সেও তো একটা ‘পাওয়া’। সব না হলেও, কিছু কিছু প্রাপ্তিতো থাকেই জীবনে।