কলাগাছের ভেলা ও গেইট
আ নো য়া র কা জ ল
প্রকাশিত : ০১:৪৯ পিএম, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সোমবার | আপডেট: ০১:৫১ পিএম, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সোমবার
“একেলা চড়িয়া আমি কলাগাছের ভেলায়ে,
চলিতেছি ঐ দূর দেবালয়ে।
সর্পে আমায় করিয়াছে আঘাত,
পদে মম গাঁথিয়াছে বিষদাঁত।
কত ওঝা কত বিষক, পারিলনা বিষ নামাতে;
ব্যর্থ হইয়া সবে বসে রয় মাটিতে।”
হ্যাঁ, কলাগাছের ভেলা নিয়ে কবির ভাবনার কথাই বলছি। কলাগাছের ভেলা বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অভিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের শেকড় প্রোথিত গ্রামীণ জীবনে কৃষি, গৃহস্থালি, পারিবারিক, সামাজিক ও অন্যান্য কাজে কলাগাছ নানাভাবে নানা কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ জলপথের প্রধান বাহন। অনেকের জীবনেই এসবে চড়ার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু কলাগাছের ভেলা জলযান হিসেবে ব্যবহার এ প্রজন্মের মানুষের কাছে একেবারেই অভিনব মনে হতে পারে। আমরা যারা গ্রামে বড় হয়েছি জলের প্রাচীন বাহন কলাগাছের ভেলায় ভেসে বেড়ানো স্মৃতিতে কমবেশি গেঁথে আছে।
গ্রামের সহপাঠিসহ অন্য কিশোরদের সাথে বর্ষায় কলাগাছ কেটে ভেলা তৈরি করে সে ভেলা পানিতে ভাসিয়ে তাতে চড়ে দল বেঁধে হৈচৈ করে গোসল করা, মাছ ধরা, নদীর এপার-ওপারে, এখানে-ওখানে যাওয়া আসা করা ছিল রুটিন কাজ। এই কলাগাছের সাহায্য নিয়ে মাঝনদীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতরে বেড়ানো দুরন্ত শৈশবের স্মৃতিময় অতীত বার বার উদ্ভাসিত হয়। ছোটকালের অনেক কিছুই বড় হওয়ার পর ফানি মনে হয়। সেই সময় এই সামান্য কলাগাছের ভেলা বানিয়ে মনে করতাম যেন বিশাল কিছু করে ফেলেছি। কী মজা, ভাসতে পারছি! পানির ওপর দিয়ে যাচ্ছি অথচ ভিজতেছি না। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! এ ভেলার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ডুবে যাওয়ার কোনো আশংকা থাকে না। তাই ভয়ের তেমন কোনো কারণ নেই। সে সময়ে কলাগাছের ভেলা, বাইচ যা ছিল খুবই উপভোগ্য, উৎসবমুখর ও আনন্দঘন।
কলাগাছের ভেলার সাহায্যে এক সময় মানুষ নিকটবর্তী দূরত্বে নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড় পারাপার হতো। তখন নৌকার এতো প্রচলন ছিল না। বর্ষাকালে গবাদি পশুর খাবার সংগ্রহ করা হতো এই ভেলার মাধ্যমে। গ্রামের নারী, পুরুষ ও শিশুরা এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে বিশেষ করে বন্যার সময় যখন সব রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যায়; স্কুলে, কলেজ, মাদ্রাসা, হাট-বাজার ও আত্নীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়াসহ অন্যান্য কাজে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তখন কলা গাছের ভেলায় চড়ে স্বল্প দূরত্বে যাওয়া-আসার কাজে কলাগাছের ভেলা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতো।
ভেলা তৈরির উপাদান
ভেলা হলো চার-পাঁচটি বা তারও বেশি সংখ্যক কলাগাছ, বাঁশ বা অন্য কোনগাছের গুঁড়ি একত্রে বাঁধা পাটাতন। ভেলা তৈরির সহজ উপায় হল সাধারণত চার-পাঁচটি কলাগাছ একসঙ্গে বেঁধে কলাগাছগুলোতে আড়াআড়ি মোটা শক্ত কাঠি বা বাঁশ দিয়ে গেঁথে নেওয়া। যাতে গাছগুলো বিচ্ছিন্ন হতে না পারে। কলাগাছ ছাড়াও গাছের গুঁড়ি, বাঁশ দিয়েও ভেলা তৈরি করা হতো।
বেশ কয়েকটি কলাগাছ একসঙ্গে করে ভেলা বানানোর ফলে মানুষ, জিনিসপত্র, এমনকি ছাগল ও ছোট গরুর বাছুরও একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় পারাপার করা হতো। একসঙ্গে চার থেকে ছয়জন এতে চড়তে পারে। জল ছুঁই ছুঁই করে জলের ওপর দিয়ে পাড়ি দেবে কিন্তু ভিজবেনা, সহজে ডুববেন না, এটি গ্রামাঞ্চলে বেড়ানোর ক্ষেত্রে এক ধরনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
আধুনিক ভেলা
আধুনিককালে ভেলা তৈরিতে রাবারের বায়ু ভর্তি থলে, প্লাস্টিকের তৈরি বায়ুরোধী ড্রাম বা ব্যারেল প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। কিছু ভেলাতে দিক নিয়ন্ত্রণের জন্য হাল, হাল্কা ধাতব কাঠামো ইত্যাদি থাকতে পারে। অল্পখরচে সহজে এভাবে তৈরি করা হয় এক ধরনের অস্থায়ী জলযান বা ভেলা।
স্মৃতির মণিকোঠায় কলার গাছের ভেলা
নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে/ তিল ঠাঁই আর নাহিরে/ ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।
কবিগুরুর নিষেধ অমান্য করেই আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ জনপদের দুরন্ত কিশোররা ছুটতো বর্ষণমুখর মেঘ আঁধারে ছেয়ে যাওয়া সদ্য প্লাবিত অদূরের নদীনালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওর ও নিচু ফসলের জমিতে থৈ থৈ করা বানের পানিতে। যেখানে কিছুদিন আগেও ছিল ফসলের মাঠ। আষাঢ়ের অবিরাম বর্ষণে আজ তা হয়ে উঠেছে হাঁটু কি়ংবা গভীর থৈই থৈই জলরাশি। বর্ষার এমন দিনে প্রচণ্ড বর্ষণ উপেক্ষা করে কলাগাছের ভেলা বানানোর মহা আয়োজন। টেনে নিয়ে যায় দূর অতীতে মধুর স্মৃতি জাগানিয়া দূরন্তপনার দিনগুলোতে। যেন কালজয়ী টাইটানিক বিনির্মাণে ব্যস্ত সবাই। টাইটানিক তো ডুবে ছিল বরফের পাহাড়ের ধাক্কা খেয়ে; এ কলাগাছের টাইটানিক বানাতে পারলে পচে যাওয়ার আগে কখনও ডুববে না।
নতুন জলরাশির বুকে কলাগাছের ভেলায় চড়ে একটু ঘুরতে না পারলে বর্ষার সুখ কই? বর্ষার নতুন জলের সঙ্গে পুঁটি মাছের যে রকম চঞ্চল প্রেম, দুরন্ত শৈশবের সে দিনগুলো সে রকম ছিল। ভেলা তৈরির জন্য আমরা লেগে পড়তাম কলাগাছ চুরির কাজে। মোটা মোটা বড় কলাগাছ জোগাড় না হলে যে আমাদের টাইটানিক দীর্ঘজীবী হবে না। এমন হয়েছে, কলাগাছে কলার থোড় বড় হয়ে গেছে সেই থোড়সহ কেটে এনেছি কলাগাছ। তবু কলাগাছের ভেলা বানানো চাই। কখনও তিনটা কখনও পাঁচটা; বেশিরভাগ সময় পাঁচটা দিয়েই তৈরি হতো আমাদের প্রমোদতরী।
ভেলা তো হলো, এবার ভেলা চালাতে যে লগি দরকার তার কী ব্যবস্থা হবে? লগি আনতে ভুলেও বাড়ির দিকে যাওয়া যাবে না। সারাদিন বৃষ্টিতে ভেজার লঘুদণ্ডের সঙ্গে থোড়সহ কলাগাছ কাটার গুরুদণ্ড। কার ঠেকা পড়েছে হাতেনাতে ধরা দিয়ে নিশ্চিত সাজা ভোগ করবে। সাজার কথা বলছি কারণ, ততক্ষণে থোড়সহ কলাগাছ চুরির ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেছে। কেউ একজন হয়তো মাছ ধরতে এসেছিল, দেখে গেছে আমাদের টাইটানিক বানানোর নির্মাণসামগ্রীতে গর্ভবতী কলার থোড়। অঝোর ধারায় বৃষ্টি না হতে থাকলে এতক্ষণে হয়তো বা মুরব্বী টাইপের কেউ একজন এসে হয় বড় ভাই নয় পিতা কান মলে মলে বাড়ি নিয়ে যেত।
কলা গাছের গেইটি
আবহমান বাংলার লোকায়েত হারানো ঐতিহ্যসমুহের অন্যতম হলো কলাগাছের গেইট। গ্রামের বিয়ে বাড়ীতে পরম যত্নে কলাগাছ, বাঁশ ও রঙ্গীন কাগজ দিয়ে চমৎকার গেইট সাজানোর দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। অসাধারণ আগ্রহ ও কৌশলে রঙ্গীন কাগজ কেটে চমৎকার ঝালট ও বিভিন্ন প্রকার ফুল তৈরি করা হতো। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বিশাল এক বাঁশের মাথার সাথে দড়ি বাঁধা হতো। দড়ির সাথে থাকতো রঙ্গীন কাগজের নিশান। স্কুলের গেটে স্কুলের সামনের রাস্তায় শোভা পেত রঙ-বেরঙের কাগজে সাজানো হতো আ কলাগাছ দিয়ে তৈরি হতো দৃষ্টিনন্দন গেইট। লম্বা বাঁশের মাথায় কিংবা রেন্ট্রি কড়ই গাছে মাইক টাঙ্গিয়ে; মাইক বাজিয়ে স্কুল-কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা কিংবা বিয়ে অনুষ্ঠান, গ্রামের বিভিন্ন সামাজিক ও অন্যান্য আচার অনুষ্ঠান হতো; তাতে সাজানো-গোছানোর কাজে কলাগাছের নানাবিদ ব্যবহার হতো।
স্মৃতির পাতায় আজও ভাসে বর্ষাকালে কলাগাছের ভেলা নিয়ে আনন্দ করা বা ঘুরে বেড়ানোর কথা। বর্ষাকাল এলে পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যেত নদ-নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাওর, পুকুর, নিচু ফসলের মাঠে সেই নতুন পানিতে কলাগাছের ভেলা তৈরি করে ভাসতে ভাসতে নিজেকে মনে হতো আমি যেন কোনো এক রূপকথার গল্পের নাবিক। বর্ষাকালে এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না কলাগাছের ভেলায় চড়ে মানুষের পারাপার। গ্রামাঞ্চলের কোথাও কোথাও এখনো কলাগাছের ভেলার প্রচলন আছে। কম খরচে তৈরি করা যায় বলে একে গরিবের জাহাজও বলা হয়।
এমন সময় আসবে আধুনিক প্রযুক্তি-যন্ত্রপাতির ভীড়ে প্রাচীনতম এ জলযান হয়তো হারিয়ে যাবে স্মৃতির অতল গহ্বরে।
এএইচ/ এসএ/এসইদি