অধ্যাপক আহমদ শরীফের জন্মশতবার্ষিকী আজ
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:৫৪ এএম, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শনিবার
কিংবদন্তিতুল্য মুক্তবুদ্ধিজন অধ্যাপক আহমদ শরীফের জন্মশতবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সুচক্রদণ্ডি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। বাংলা ও বাঙালির সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য, রাজনীতি, দর্শন ও ইতিহাসের মৌলিক গবেষণায় তিনি এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও উগ্র মৌলবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে এই গবেষক, শিক্ষক, পণ্ডিত ছিলেন আজীবন লড়াকু সৈনিক।
ড. শরীফের মা মিরাজ খাতুন, বাবা আব্দুল আজিজ। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম সরকারি কলেজিয়েট স্কুলে আব্দুল আজিজ করণিক হিসেবে কাজ করতেন। উনিশ শতকেই এ মুসলিম পরিবারে শিক্ষার আলো প্রবেশ করে। তার ষষ্ঠ পূর্বপুরুষ কাদের রজা সন্তানের জন্য কাজী দৌলতের ‘সতী ময়না লোরচন্দ্রানী’ পুথিটি নিজের হাতে নকল করেছিলেন। তার পিতামহ আইন উদ্দিন (১৮৪০-১৯৩৭) ছিলেন সরকারি জজকোর্টের নকলনবিশ। চট্টগ্রামের মুসলমানদের মধ্যে প্রথম এন্ট্রান্স পাস করা এবং বাংলা সাহিত্য গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ছিলেন তার কাকা ও পিতৃপ্রতিম।
পুথি সাহিত্যবিশারদ আব্দুল করিম ও তার স্ত্রীর কাছে আহমদ শরীফ পুত্রস্নেহে লালিত-পালিত হন। আবদুল করিমের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি যেমন জ্ঞানতৃষ্ণা পান, তেমনি নিরলস অধ্যবসায়ে অর্জন করেন এক বিস্ময়কর মনীষা। তার গবেষণায় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলিম লেখকদের অসামান্য অবদানের কথা উঠে এসেছে। তিনি তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় এই উপসংহার নির্মাণ করেন যে, যুক্তির ওপরে বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই। ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯৩ সালে তাকে সম্মানসূচক ডি. লিট ডিগ্রি দেয়।
আহমদ শরীফ তার চিন্তা, কর্ম ও যুক্তির ধারায় মৌলিকত্ব, যুক্তিবাদিতা ও আধুনিকতার স্ম্ফুরণ ঘটিয়েছিলেন। তিনি অদৃষ্টবাদ-ভাববাদ, স্বৈরাচার ও সামরিকতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ ও শ্রেণিবৈষম্যের বিরুদ্ধে আমৃত্যু যুক্তিবোধ ও মানবতাবোধের শানিত কলম চালিয়েছেন। নিজের জীবদ্দশায় সংগঠিত সব প্রতিক্রিয়াশীলবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রায় সবক'টিতেই তিনি ছিলেন সামনের সারিতে।
ঐহিক জীবনবাদী আহমদ শরীফ সব প্রথা, সংস্কার ও শৃঙ্খলা ছিন্ন করে ১৯৯৫ সালে লিপিবদ্ধ করা ‘অসিয়তনামা’র মাধ্যমে মানবকল্যাণে মরণোত্তর চক্ষু ও দেহ দান করেন। তার অসিয়তনামায় লেখা ছিল, ‘চক্ষু শ্রেষ্ঠ প্রত্যঙ্গ, আর রক্ত হচ্ছে প্রাণপ্রতীক। কাজেই গোটা অঙ্গ কবরে কীটের খাদ্য হওয়ার চেয়ে মানুষের কাজে লাগাই তো বাঞ্ছনীয়।’
আহমদ শরীফের লেখা প্রবন্ধ-গবেষণামূলক মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা ৭০টিরও বেশি। সম্পাদনা করেছেন মধ্যযুগীয় সাহিত্যবিষয়ক ৪৫টি গ্রন্থ। ১৯৫৭ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম প্রকাশনা গ্রন্থ দৌলত উজির বাহরাম খাঁর লেখা ‘লায়লী মজনু’ প্রকাশিত হয়েছিল আহমদ শরীফের সম্পাদনায়। ১৯৬৮ সালে লেখক-শিল্পীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠীর হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে আয়োজিত সভার অন্যতম সংগঠক ও বক্তা ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর লেখক-বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীনতার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতাপরবর্তী সময়েও বাংলাদেশে শাসক গোষ্ঠীর যেকোনো অগণতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারমূলক পরিস্থিতিতে আহমদ শরীফ বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষজনিত পরিস্থিতিতে তার নেতৃত্বে ‘মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সহায়তা কমিটি’ গঠন হয়। ১৯৭৬ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ‘প্রতিবাদ প্রতিরোধের একুশে উদযাপন কমিটি’রও নেতৃত্ব দেন তিনি।
১৯৪৪ সালে ২৫০ টাকার বেতনে দুর্নীতি দমন বিভাগে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে আহমদ শরীফ পেশাগত জীবন শুরু করেন। পরে তিনি ১৯৪৫ সালে লাকসামের পশ্চিমগাঁও নওয়াব ফয়জুন্নেসা কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৯ সালের জুন পর্যন্ত ফেনী ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতা করেন তিনি। এরপর ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগ দেন তিনি। চাকরির শর্ত ছিল, তিনি আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদের বিশাল পুথিসম্ভার বিনা অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে দেবেন এবং সেসব দেখাশোনার জন্যই তিনি নিয়োগ পাবেন।
১৯৫২ সালে আহমদ শরীফ বাংলা বিভাগের অস্থায়ী প্রভাষক এবং ১৯৫৭ সালে প্রভাষক হিসেবে স্থায়ী হন। ১৯৬২ সালে তিনি সাংবাদিকতা বিভাগের খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি বাংলা বিভাগের প্রধান হন। ১৯৮৩ সালের ৩১ অক্টোবর তিনি চাকরিজীবন থেকে অবসর নেন।
১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানিত ‘নজরুল অধ্যাপক পদে’ যোগ দেন এবং ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ওই পদে কাজ করেছেন। ১৯৯৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যু ঘটে।
তার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রবীণ রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমরকে আহ্বায়ক এবং অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হককে সম্পাদক করে ১৬৬ সদস্যের ড.আহমদ শরীফ জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটির উদ্যোগে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪টায় জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে জন্মশতবর্ষ উদযাপন করা হবে। এ সময় তার সৃষ্টিকর্ম ও সামাজিক-রাজনৈতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
এসএ/