যেভাবে এলো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’র স্বীকৃতি (ভিডিও)
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১১:০৪ এএম, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সোমবার | আপডেট: ১১:১১ এএম, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সোমবার
‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’, বিশ্ব স্বীকৃত দিনটি এখন আর শুধু বাঙালীর একার নয়, বিশ্বের সব দেশ ও জাতির। কিন্তু এই অর্জনের পথ পরিক্রমা মোটেই সহজ ছিল না। একেবারেই ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোগের শুরু হলেও পরবর্তী ধাপগুলো পেরোতে কূটনৈতিক মুন্সিয়ানার স্বাক্ষর রেখেছে সরকার। বায়ান্নর ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের স্মরণ ও শ্রদ্ধায় জাতিসংঘের সদস্যভূক্ত ১৯৩টি স্বাধীন দেশ দিবসটি পালন করে। কিন্তু কিভাবে এলো সেই স্বীকৃতি, আসুন, জেনে নেয়া যাক সেসব কথা।
‘Let me make it very clear to you that the state language of Pakistan is going to be Urdu and no other language.’ ১৯৪৮ সালে ঢাকার রেসকোর্সে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এ অযৌক্তিক ঘোষণার প্রেক্ষিতে ১৯৫২ সালে ফুসে ওঠে ছাত্র আন্দোলন। যা নিবৃত্ত করতে পুলিশের গুলি চলে ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে। শাহাদৎ বরণ করেন সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বার।
মায়ের ভাষায় কথা বলবার অধিকার প্রতিষ্ঠায়- এত বড় উৎসর্গ বিশ্বের আর কোথাও কোনও জাতির নেই। বাঙালীর কাছে সম্মানের-শ্রদ্ধার ছিল, কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শহীদ দিবসটি গুরুত্ব বোঝানোর সুযোগ ছিল না বললেই চলে।
তবে সাহস দেখিয়ে এগিয়ে আসলেন দুই প্রবাসী বাঙালী। কানাডার ভ্যানকুভারে বসবাসকারী আব্দুস সালাম ও রফিকুল ইসলাম এ দাবি উল্লেখ করে চিঠি লিখেন তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে। সময়টা ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারী। জাতিসংঘের অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের কারও কাছ থেকে এ ধরণের প্রস্তাব পাঠানোর পরামর্শ আসল জাতিসংঘ কর্মকর্তা হাসান ফেরদৌসের কাছ থেকে।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ ৭টি ভাষার দশ জন সদস্যের ‘বহুভাষিক ও বহুজাতিক মাতৃভাষা প্রেমিক গোষ্ঠী’ নামে সংগঠন তৈরী হলো কানাডায়। সংগঠনটি এবার “আন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস” নামে একটি দিবস ঘোষণার প্রস্তাব পাঠায়।
এরপর এভাবেই কেঁটে যায় প্রায় একটি বছর। এবারে জানানো হলো- নিউইয়র্কে নয়, যোগাযোগ করতে হবে প্যারিসের জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন-ইউনেস্কোয়। যোগাযোগ হয়, সংস্থাটির ভাষা বিভাগের কর্মকর্তা আন্না মারিয়ার সাথে। ১৯৯৯ সালের ৩ মার্চ, একটি চিঠিতে আন্না স্পষ্ট করেন যে, ব্যক্তিগভাবে উত্থাপনের কোনও সুযোগ নেই; বিষয়টি কোনও সদস্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে আসতে হবে পরিচালনা পর্ষদের সভায়।
হাতে সময় একেবারেই কম; অল্প ক’দিনের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই সভা। সংগঠনটির পক্ষ থেকে বিস্তারিত জানানো হলো বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের। বিষয়টি রাষ্ট্রের জন্যে গর্বের বিবেচনায় এনে কালবিলম্ব না করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুমতি চেয়ে পাঠায় স্বার-সংক্ষেপের নোট। সময়ের স্বল্পতার বিষয়টি উপলব্ধি করেন প্রধানমন্ত্রী। তাই, আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের প্রক্রিয়া এড়িয়ে, নথির অনুমোদন দেন তিনি। বাকি ছিল একটিমাত্র স্বাক্ষর। ১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, তখন পার্লামেন্ট অধিবেশন চলছিল। সে অবস্থাতেই প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর নিয়ে প্রস্তাবের ফ্যাক্সবার্তা ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে পৌঁছে, অফিসের সময়সীমা শেষ হবার মাত্র এক ঘণ্টা আগে।
এ বিষয়ে কথা হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, এই যে দুইজন প্রবসী উদ্যোগ নিলেন, আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তড়িৎবেগে সিদ্ধান্ত নিলেন। যাতে মাত্র একদিনেই প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টি অনুমোদন দিয়ে ফ্রান্সে কর্মরত রাষ্ট্রদূত, যিনি ইউনোস্কোর সঙ্গে সংযুক্ত, তার মাধ্যমেই প্রস্তাবটা দেয়া হয়।
তবে এমন একটা দিবস পালন বড় খরচের বিষয় বিবেচনায় নেয় সংস্থাটির মহাসচিব। এতে প্রস্তাবটি বাতিলের শংকা ও কার্যত আটকে যাবার উপক্রম তৈরী হলে তৎপরতা বাড়ায় অধিবেশনে উপস্থিত প্রতিনিধিদলের নেতা তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এ এইচ কে সাদেক। তিনি বোঝাতে সক্ষম হন যে, এটা ছিল ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এ চ্যালেঞ্জ বিশ্বের সকল ভাষার জন্যেই সমানভাবে প্রযোজ্য। শুধু তাই নয়, জনমত গড়তে কূটনৈতিকদের সাথে চলতে থাকে ঘরোয়া বৈঠক। আর এতেই প্রস্তাবের-স্বপক্ষে সমর্থন চলে আসে ২৯টি দেশের।
এ প্রসঙ্গে ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, সৌদি আরব, পাকিস্তান, ইউক্রেন আর ওই যে ছেলেগুলো- যারা ওই দেশে কাজ করে, তারাও যে যেভাবে পারছে কাজ করেছে এবং তাদের সরকারকে জানিয়েছে। তারপরে এটা পাশ হয়।
১৯৯৯ সালের ১৬ নভেম্বর উত্থাপনের কথা থাকলেও সেদিন প্রস্তাবটি ইউনোস্কোর সভায় উঠলো না। পর দিন অর্থাৎ ১৭ নভেম্বরই ছিল ঐতিহাসিক দিন। প্যারিসে ইউনোস্কোর সভায় যথারীতি শুরুতেই উঠলো প্রস্তাবটি এবং সাথে সাথে ১৮৮টি দেশের সমর্থন নিয়ে, কোনও বিরোধিতা ছাড়াই একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গৃহীত হলো।
ভিডিওতে দেখুন-
এনএস/