ক্রিকেট উৎসব এবং বদলে যাওয়া সন্দ্বীপ-৪
কানাই চক্রবর্তী
প্রকাশিত : ১০:১৭ পিএম, ৩ মার্চ ২০২১ বুধবার | আপডেট: ১০:১৮ পিএম, ৩ মার্চ ২০২১ বুধবার
লেখকের সাংস্কৃতিক সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আড্ডা
সন্দ্বীপের মানুষ ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান এবং প্রবাসে বসবাস করেন। তারা যখন সন্দ্বীপ ভ্রমণ শেষে নিজ অবস্থানে ফিরে আসেন, অপরাপর সন্দ্বীপের মানুষের একটি প্রশ্নের সম্মুখীন তাদের হতেই হয়। তা হচ্ছে- বিনয় সাহার দোকানের মিষ্টি খেয়ে এসেছেন তো? উত্তর যদি না বোধক হয়, তাহলে এমন ধারণা দেয়া হবে, আপনি বিশাল কিছু মিস করে এসেছেন। আর সন্দ্বীপ যাওয়াটাই ছিল বৃথা। বিষয়টা এমন, আপনি কক্সবাজার যাবেন অথচ সাগরে বা বীচে যাবেন না, তা কিভাবে হয়?
সন্দ্বীপের সাংসদ মিতা ও লেখকের বন্ধুরা
বিনয় সাহার মিষ্টিমুখ নামে এই দোকান দক্ষিণ সন্দ্বীপের শিবেরহাটে অবস্থিত। বিনয় সাহা এখন অবশ্য জীবিত নেই। তবে তিনি জীবদ্দশায় তার সৃষ্টি সন্দ্বীপের ঐতিহ্যে রূপ নেয়া প্রত্যক্ষ করে গেছেন। বিনয় সাহার মিষ্টি এখন সন্দ্বীপের একটি নিজস্ব ব্র্যান্ড। সন্দ্বীপ বললেই বিনয় সাহার মিষ্টির কথা আসবে। তবে এটা কোন জাদুবলে হয়েছে, তা আমার জানা নেই। আমাদের সময়ে নদীতে সন্দ্বীপে টাউন বিলীন হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রিয়লালের (পরে জ্যোতি লাল) দোকানের মিষ্টি ছিল প্রসিদ্ধ। একই সময়ে পুলিন ভৌমিক, বকুল ভৌমিক এবং পরিক্ষীতের দোকানের মিষ্টিও ছিল উন্নতমানের।
বিনয় সাহার দোকান তখনও ছিল। কিন্তু তা সন্দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে হওয়ায় শুধু স্থানীয়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সন্দ্বীপ টাউন বা অন্য প্রান্ত থেকে কেউ মিষ্টি খাওয়ার জন্য শিবেরহাটে যেতেন না। কিন্তু সন্দ্বীপ টাউনে থানা পুলিশ কোর্ট কাচারি, ট্রেজারি এবং ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস থাকার কারণে সব প্রান্তের মানুষকেই এখানে আসতে হতো। বিশেষ করে এসএসসি পরীক্ষার সেন্টার টাউনে হওয়ার কারণেই ছাত্র-ছাত্রী এবং অভিভাবকদের আসার প্রয়োজন হতো। এ কারণে উল্লেখিত দোকানের তৈরী মিষ্টির স্বাদ অনেকেই নিতে পারতেন। এজন্য মনে হয়, তখন বিনয় সাহার মিষ্টির খবর তেমন চাউর হতো না।
সন্দ্বীপের বিখ্যাত বিনয় সাহার মিষ্টি
পরবর্তী সময়ে টাউনের দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিনয় সাহা প্রাদপ্রদীপে আসেন। বিনা প্রচারে, বিনা বিজ্ঞাপনে সন্দ্বীপের আনাচে-কানাচে ছাড়িয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
এবার সন্দ্বীপ যাওয়ার আগে পরিকল্পনা ছিল, যদি সময় পাই এবং শিবেরহাটে যাই তাহলে বিনয় সাহার দোকানের মিষ্টির স্বাদ নেব। আর সেই সুযোগটি যে সন্দ্বীপ ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন (২২ জানুয়ারি) মিলে যাবে তা ভাবনাতেও ছিলনা। সন্দ্বীপের সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতার হঠাৎ ইচ্ছেয় এদিন প্রায় গভীর রাতে বিনয় সাহার মিষ্টিমুখে আমাদের সরব উপস্থিতি যেন ছোটখাট একটা উৎসবে রূপ নেয়। তুমুল শীতের রাতে সন্দ্বীপের সব মানুষ যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন দক্ষিণ প্রান্তে এই মিষ্টি খাওয়ার উৎসব নানা কারণেই বিশিষ্ট হয়ে থাকবে।
এর আগে এদিন রাতে সন্দ্বীপে ক্রিকেট উৎসবের আয়োজনকারী এবং ঢাকা থেকে যাওয়া আরও কয়েকজনের সৌজন্যে সাংসদের নিজের বাড়িতে রাতের খাওয়ার আয়োজন করা হয়। খাওয়া শেষেই তিনটি গাড়িতে করে প্রথমে গুপ্তছড়াঘাটে রাতের আলোতে (লাইটিংসহ) মুস্তাফিজুর রহমান জেটি পরিদর্শন। সেখানেই হঠাৎ করে প্রস্তাব, এ রাতেই মিষ্টিমুখে গিয়ে মিষ্টি খাওয়ার।’ এতো তীব্র শীতও এ প্রস্তাবের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। উপায় নেই গোলাম হোসেন, সাংসদের ইচ্ছে বলে তো কথা, সুতরাং যেতে তো হবেই।
সাংসদের আর একটি ইচ্ছায় মিষ্টি মুখের কাছাকাছি থাকা সিরাজ (সিরাজুল মাওলা, মুস্তাফিজুর রহমান কলেজের বাঙলার শিক্ষক এবং সন্দ্বীপে আমার নাটক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সহযোদ্ধা) এবং তার স্ত্রী সুরাইয়াকেও (সাউথ সন্দ্বীপ কলেজের অধ্যক্ষ) এই গভীর রাতে মিষ্টিমুখে আসার ফরমান (আমন্ত্রণ) জারি করা হয়। তারা আসার পর যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা বোধ হয় তারা কল্পনাও করতে পারেনি।
এর আগে পরিকল্পনা হয়, সাধারণত কোনও উৎসব কোনও উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করেই হয়। সুতরাং মিষ্টি খাওয়ার উৎসবের আগে আমাদেরও একটি উপলক্ষ্য বানাতে হবে। যেই কথা সেই কাজ, উপলক্ষ্যও তৈরি হয়ে যায়। তা হচ্ছে সিরাজ-সুরাইয়ার বিবাহবার্ষিকী। পরিকল্পনানুযায়ী সিরাজ দম্পতি আসার সাথে সাথে সবাই সমস্বরে দাঁড়িয়ে শুভ বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানাতে থাকে।
সবার এরকম আচরণ দেখে তো সিরাজদের চোখ ছানাবড়া। বার বার তারা বুঝাতে থাকে, আজকের দিনে তারা বিয়ে করেননি। আজ তাদের বিবাহবার্ষিকী নয়। কে শোনে কার কথা। সমস্বরে সবার একই আওয়াজ, না আাজ আপনাদের বিয়ে বার্ষিকী। কথা আছে না, জোর যার মুল্লুক তার। সবাই যেখানে একজোট হয়ে বলছেন, সিরাজদের তা তো মেনে নিতে হবেই। তারপরেও সিরাজ মিনমিনে গলায় বলে, আজ তাদের ছেলের বিয়ে বার্ষিকী।
আর যায় কোথায়? সিরাজদের না হলেও ছেলের তো। উপলক্ষ্য পাকা হয়ে গেলো। অনেকটা নেকড়ে আর ভেড়ার জল ঘোলা করা গল্পের মতো। ‘তুই জলঘোলা করিসনি, তোর পিতা-মাতা বা পূর্ব পুরুষরা তো করেছে।’
এ উৎসব যখন শেষ হয়, তখন রাত বোধ হয় মধ্য দুপুর। আরও পরে শীতের মনোরম একটি সকাল। কিন্তু মধ্যরাতের এ কাণ্ডকারখানা সবার কাছেই একটি সতেজ ভোরের মতোই উজ্জ্বল্য ছড়াবে অনেক দিন নিঃসন্দেহে।
লেখক পরিচিতি: কানাই চক্রবর্তী, উপ-প্রধান প্রতিবেদক, বাসস।
কেআই/এনএস/