‘সে বজ্রকণ্ঠ এখনো লীন হয়ে যায়নি’
ড. এ কে আব্দুল মোমেন
প্রকাশিত : ০৯:৫৮ এএম, ৭ মার্চ ২০২১ রবিবার | আপডেট: ১০:০১ এএম, ৭ মার্চ ২০২১ রবিবার
আমার মনে পড়ে ৩ মার্চ তৎকালীন বাংলাদেশের সত্যিকার রাষ্ট্রনায়ক, যার আদেশে গাড়ি-ঘোড়া চলে, ব্যাংক চলে, অফিস-আদালত চলে, যার আদেশে লোকজন অফিসে যায়, সেই মহাপুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর রোডে যখন উপস্থিত হয়, তখন অনেকের হাতে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত (স্বাধীনতার পর তা পরিবর্তিত হয়) লাল-সবুজ পতাকা এবং অনেকেই তখন ‘স্বাধীন বাংলাদেশের’ স্লোগান দিচ্ছিলেন, তার সঙ্গে আমরাও শামিল হই। মেজর জিয়া ৩ তারিখ নয়, ২৬ তারিখ রাতে স্বাধীনতার সংগ্রামে শরিক হন। আমাদের অনেক পরে।
৭ মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে একটি সমাবেশ হয় এবং তাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। দুপুর থেকেই আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক রেসকোর্সের বক্তৃতা শোনার জন্য জমায়েত হই, তখন ওপরে বারবার সামরিক হেলিকপ্টার ও বিমান চলে এবং আমরা তখন নিশ্চিত যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেবেন। আমাদের আশা কিন্তু তিনি পূরণ করেন। তার অপূর্ব বলিষ্ঠ ভাষণের প্রতিটি শব্দ আমাদের হূদয় পুলকিত করে, রক্ত গরম করে, স্বাধীনতার দৃঢ় প্রত্যয়ে আমরা উজ্জীবিত হই।
তিনি অর্বাচীনের মতো বলেননি, ‘আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম।’ তার পরিবর্তে তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ শুধু তাই বলে ক্ষান্ত হননি। তিনি আরো বলেন, ‘...আপনারা জানেন ও বোঝেন...মনে রাখবা আমি যদি তোমাদের হুকুম দিতে নাও পারি, তোমাদের যা যা আছে তা-ই দিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করো। ...ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’ বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা আইনের মারপ্যাঁচে হুবহু না দিলেও ‘আখলবন্ধ’ স্বাধীনচেতা সংগ্রামী বাঙালিদের কীভাবে কী করতে হবে, তার নির্দেশনা দিয়ে যান।
‘আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি...’—বক্তব্যের মধ্যে তিনি জাতিকে সজাগ করে দেন যে তাকে যদি পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে বা কারারুদ্ধ করে তখন আমাদের কী করতে হবে। ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো...যার যা কিছু আছে তা-ই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে... এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...।’ আনুষ্ঠানিকভাবে এক ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ না বললেও তার ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য কী কী করা প্রয়োজন, তার সব ইঙ্গিত ও নির্দেশনা এতে রয়েছে।
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিলে আমি যখন আমাদের সিলেটের বাসার সামনে পাক-সেনানীর কড়া হুকুম ‘যার বাসার সামনে ব্যারিকেড তৈরি হবে সে বাড়িটি ধ্বংস করে দেয়া হবে’ উপেক্ষা করে ব্যারিকেড তৈরি করি, তখন জিয়া সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, না হান্নান সাহেব দিছেন, না যদু-মধু দিয়েছেন, তা আমাদের মোটেই ধর্তব্য ছিল না। কেউ না দিলেও আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যেতাম। কারণ ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু আমাদের স্পষ্টত নির্দেশনা দিয়ে গেছেন, ‘...যার যা কিছু আছে তা-ই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো।’
সিলেট শহরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় আমাদের বাড়ি থেকে ৪ এপ্রিলে, ওইদিন বিকালে বাড়ি থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর গুলি চালালে তারা আমাদের বাড়িটি মর্টার দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। তখন আমাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ইপিআর বাহিনীর ডজনখানেক বাঙালি বীর সন্তান। এর আগের দিনে তাদের যখন বলা হয়, তাদের হাতিয়ার জমা দিতে, তারা ইপিআরের ছাউনি থেকে পালিয়ে এসে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তাদের কেউই তখন জানে না স্বাধীনতার ঘোষণা কেউ দিয়েছে কিনা, তবে তারা জানে স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এর পেছনে যার নেতৃত্ব সর্বোচ্চ, তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
বঙ্গবন্ধুর প্রগাঢ় রাজনৈতিক ধীশক্তি ও প্রজ্ঞা থাকায় তিনি তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বক্তৃতায় এক অপূর্ব সম্মিলনী সৃষ্টি করেছেন। এই ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতাকামী সব বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ওপর নির্যাতন হলে বা তাকে বন্দি করলে সঙ্গে সঙ্গেই স্বাধীনতার যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। তবে সরকার যদি তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিত্রিত করে ফাঁসি দেয়ার পাঁয়তারা করে তাহলে এ বক্তৃতা তাদের হতাশ করবে। যেসব বাংলাদেশী পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন, তাদের কাছে এ বক্তৃতা ‘স্বাধীনতার ইঙ্গিত’ নয়, তারা তাদের তালে এর তফসির করে।
১৯৭১ সাল। ২২ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, মোল্লা জালাল উদ্দিন, নারায়ণগঞ্জের গোলাম সারওয়ার প্রমুখ ইমার্জেন্সিতে আসেন আহত কর্মীদের দেখতে। মেডিকেল হাসপাতালের বারান্দায় তার সঙ্গে দেখা, জিজ্ঞাসা করলাম কিসের জন্য এসেছেন। বললেন, ‘আহত কর্মীদের দেখতে এসেছেন।’ তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডির গোলটেবিল বৈঠকে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা কমানোর জন্য ‘গোলটেবিল’ বৈঠকের আয়োজন করেন এবং বঙ্গবন্ধু তাতে যোগদান করেন। ছাত্র-জনতার প্রবল দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। আমি তখন রাওয়ালপিন্ডিতে ইসলামাবাদ ইউনিভার্সিটির ছাত্র। আমরা তখন ওখানে মাত্র ছয়জন বাংলাদেশী ছাত্র। এদের মধ্যে সহপাঠী ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ (পরবর্তী সময়ে কেয়ারটেকার সরকারের উপদেষ্টা), আনিসুল ইসলাম মাহমুদ (এরশাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী), ড. মাহমুদুল ইসলাম (বিআইডিএস) ও এহতেশাম চৌধুরী (শিল্পপতি)। তাছাড়া ছিলেন অংক বিভাগে চাটগাঁর ড. মাসুম ও পদার্থবিদ্যা বিভাগে সিলেটের বদরুজ্জামান।
বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত সংবর্ধনা দেয়ার জন্য আমি একটা ব্যানার তৈরি করি এবং তাতে লিখি—‘স্বাগতম বঙ্গশার্দূল শেখ মুজিবুর রহমান’। পাকিস্তানে যাওয়ার পর পাকিস্তানিদের ব্যবহারে আমাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো এবং বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন আমাদের ‘একমাত্র শক্তি, একমাত্র সাহস’। বঙ্গবন্ধুর শত্রুর সংখ্যা তখন পাকিস্তানে অনেক। তাই তার নিরাপত্তার জন্য তাদের কার্গো দিয়ে বের করে নেয়া হয় এবং প্লেনের সদর দরজা দিয়ে মিজানুর রহমান চৌধুরী বের হন। হাজার হাজার অভ্যাগত তাকেই বঙ্গবন্ধু মনে করে স্বাগত জানায়। রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডির ‘ইস্ট পাকিস্তান হাউজে’ দেখা করি, তখন রাওয়ালপিন্ডিতে ঘটা করে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান করছিলাম এবং এতে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান অতিথি হতে অনুরোধ করলে তিনি তাত্ক্ষণিক রাজি হন। অনুষ্ঠান উপলক্ষে স্থানীয় টিভিতে একুশের অনুষ্ঠানের একটি অ্যাড দিতে বাধাপ্রাপ্ত হলে অনেকের কাছে গিয়ে ব্যর্থ হই।
খাজা শাহাবুদ্দিন তখন তথ্যমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুকে ঘটনাটি বললে তিনি তাত্ক্ষণিক খাজা শাহাবুদ্দিনকে ফোন লাগাতে বলেন। পরের দিন সকালে সৈয়দ নজরুল ইসলাম খাজা সাহেবের সঙ্গে আলাপ করলে আমাদের একুশের অ্যাডটি দেয়ার অনুমতি মিলে। রাওয়ালপিন্ডির গোলটেবিল চলাকালে বঙ্গবন্ধু ও তার দলের সার্বক্ষণিক সহকারী হিসেবে উপস্থিত থাকায় তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গেও পরিচয় ঘটে ঘনিষ্ঠভাবে। বঙ্গবন্ধুর উদারতা ও বাঙালি প্রেম আমাকে মুগ্ধ করে।
তাজউদ্দীন সাহেব জানালেন, ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনা খুব উত্তম নয়। তার কথার ভঙ্গিতে বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে অবস্থা খারাপ হতে পারে, তিনি বিশেষ করে শিশুদের ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে উপদেশ দিলেন। সুতরাং পরের দিন ২৩ মার্চ বড় বোনদের সন্তানদের নিয়ে সিলেটে পাড়ি দিই এই আশায় যে ঢাকায় যদি আন্দোলন চলে, সিলেটে হয়তো কম হবে। তাছাড়া আমার বস ছিলেন তখন এক উর্দুভাষী পাঞ্জাবি—১ মার্চের পর থেকেই কাজে ঠিকমতো যাচ্ছি না, তার জন্য তিনি অসন্তুষ্ট ও সন্দেহের চোখে দেখছেন। মূলত ১ মার্চের পর থেকে অফিস-আদালত বাদ দিয়ে আমি তখন সার্বক্ষণিক সভা-শোভাযাত্রা নিয়েই মহাব্যস্ত।
২৫ মার্চের বিভীষিকাময় ঢাকার হত্যাযজ্ঞ আমি দেখিনি। তবে পরের দিন সিলেট থমথমে ভাব, ঢাকার খবরাখবর নেয়ার জন্য আমরা হন্তদন্ত হয়ে অস্থিরতা করছি। ২৭ মার্চ খবর পেলাম যে বঙ্গবন্ধু পাকসেনার হাতে বন্দি হওয়ার আগে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।
স্বাধীনতার জনক একজনই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনতা একজনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপ দেয়। তিনি হচ্ছেন বাংলার গৌরব। বাংলার শ্রেষ্ঠ পুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ড. এ কে আব্দুল মোমেন: পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
এএইচ/