ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

ভাষাই জাতীয়তাবাদের প্রধান ভিত্তি

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশিত : ০৪:০৯ পিএম, ১০ মার্চ ২০২১ বুধবার

সমাজের অধিকাংশ মানুষ বিশেষত তরুণ জনগোষ্ঠী আজ এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত। একাকিত্ব আর বিচ্ছিন্নতা কিন্তু এক নয়; এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। বিচ্ছিন্নতা একটি রোগ। একজন মানুষ সবার মধ্যে থেকেও একা থাকতে পারেন, তাতে কোনো বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় না, ওটা তৈরি হয় মূলত তখনই যখন তিনি নিজেকে কারো সাথে যুক্ত করতে পারছেন না। 

নির্জনতা বা একাকিত্ব কখনো কখনো প্রয়োজনীয় হলেও নিঃসঙ্গতা বা বিচ্ছিন্নতা একেবারেই অবাঞ্ছিত, যা বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে বাড়ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে এই নিঃসঙ্গতা ও পরস্পর-বিচ্ছিন্নতার অন্যতম প্রধান কারণ আত্মস্বার্থ-সচেতনতা। এটা আসছে ভোগবাদিতা থেকে। 

রবিনসন ক্রুসো টানা ২৩ বছর একটি নির্জন দ্বীপে একাকী কাটিয়েছেন। কিন্তু তিনি কি বিচ্ছিন্ন ছিলেন? তার সাথে ধর্মগ্রন্থ বাইবেল ছিল, ওটা তিনি পড়তেন। এর মাধ্যমে তিনি ধর্মের সাথে যুক্ত হলেন। একটা কাকাতুয়া ছিল, যেটির সাথে তিনি কথা বলতেন। একসময় একজন লোকও পেয়ে গেলেন, নাম দিলেন ‘ফ্রাইডে’। এসবের মধ্য দিয়ে তিনি মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হলেন। 

এর পাশাপাশি জাহাজ থেকে ক্রুসো কিছু উপকরণ নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফসলের বীজ, খুন্তি, শাবল ইত্যাদি। এসবের সাহায্যে তিনি কিছু কাজের সাথে যুক্ত হলেন। ফলে তার সেই একাকী নির্জনবাসকে কখনোই বিচ্ছিন্নতা বলা যাবে না। অথচ আজ যে সমস্যাটা সর্বত্রই প্রকট আকার নিয়েছে, তা হলো আমরা সবাই অনেক মানুষের মাঝে থাকি বটে, কিন্তু আমরা আসলে বিচ্ছিন্ন। আমরা প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন, মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন, কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন।

কাজ থেকে বিচ্ছিন্নতাটা কিন্তু খুব মারাত্মক। কেন এটা ঘটে? কারণ যে কাজ করছি, তার ফল আমি পাচ্ছি না। পাচ্ছে আরেকজন। কাজটাকে তখন নিছক একটা কর্তব্য বলে মনে হয়। তাই সেই কাজের সাথে আমার কোনো সংযোগ গড়ে ওঠে না।

ক্রমাগত এভাবে চলতে থাকলে মানুষ একসময় নিজেকেই হারিয়ে ফেলে। নিজেকে চিনতে পারে না। সমন্বিতভাবে কোনোকিছু চিন্তা করতে পারে না। নিজেকে তখন খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন মনে হয়। আর এ থেকেই সৃষ্টি হয় হতাশা ও আসক্তি। আসে উদ্যোগহীনতা। কেউ-বা বিভ্রান্ত হয়ে পা বাড়ায় মাদক বা এ ধরনের ভুল পথে। কেউ হয়ে ওঠে সহিংস।

আজ আমাদের পরিবারগুলো হয়ে পড়েছে এই বিচ্ছিন্নতাবোধের সবচেয়ে নির্মম শিকার। ফলে কারো সাথে কারো সত্যিকার যোগাযোগটা আর হচ্ছে না। নতুন করে কোনো যোগাযোগ গড়েও উঠছে না। সে সুযোগও আর নেই ইদানীং। ইচ্ছে থাকলেও বাবা-মা সন্তানকে সময় দিতে পারছেন না। অর্থ উপার্জনের জন্যে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে লিপ্ত থাকতে হচ্ছে উভয়কেই। সেইসাথে সন্তানকেও তারা ক্রমাগত ঠেলে দিচ্ছেন আরেকটি প্রতিযোগিতার দিকে পরীক্ষায় ভালো করো। ভালো জীবিকার ব্যবস্থা করো। তা না হলে তুমি হেরে যাবে। 

এই লাগামহীন প্রতিযোগিতার প্রধানতম কারণ বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আজ মানুষের আশার সাথে শত্রুতা করছে। পুঁজিবাদ মানুষকে বিচ্ছিন্ন হতে শেখাচ্ছে। 

আমরা জানি, মানুষ বিকশিত হয় সামাজিকভাবে, সবার সাথে মিলেমিশে। সভ্যতার ক্রম-উত্তরণ এভাবেই ঘটে। অথচ পুঁজিবাদ বলে তোমার উন্নয়ন শুধুই তোমার জন্যে। লেখাপড়া করে নিজে বড় হও, অন্যকে গাড়ি চাপা দাও। এটাই পুঁজিবাদের শিক্ষা। 

এই যে আমরা আজ এত বলছি বিশ্বায়নের কথা, বিশ্বায়ন পুঁজিবাদেরই অন্য নাম। পুঁজিবাদ আর আন্তর্জাতিকতা এক নয়। আমরা আন্তর্জাতিকতা চাই, কিন্তু বিচ্ছিন্নতা কখনোই নয়। 

অথচ পুঁজিবাদের মরণ-আগ্রাসনের ফলে পরিবারে, সমাজে, দেশে যে সর্বগ্রাসী বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে, তা ক্রমশ বাড়ছে। এতে আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধগুলোও আজ ভীষণভাবে আক্রান্ত। 

একটা সময় ছিল, যখন সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানারকম অনুষ্ঠানগুলো ছিল মানুষে মানুষে মিলনের আনন্দময় ও কার্যকর ক্ষেত্র। যেমন : গ্রন্থাগারে যাওয়া, গান-আবৃত্তি-নাটকে অংশ নেয়া, একসাথে সিনেমা দেখতে যাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু এসবের প্রায় কিছুই এখন নেই। সিনেমাও এখন আর হলে গিয়ে দেখে না লোকজন, দেখে যার যার ঘরে বসে। অর্থাৎ পুঁজিবাদ মানুষকে একাকী ও ক্ষুদ্র পরিসরে ঠেলে দিচ্ছে। এভাবে ক্রমশ ছোট করে ফেলা হচ্ছে সবাইকে।

এই ক্ষুদ্রতা চলে এসেছে সবখানেই। গ্রামেগঞ্জে আগে ছিল সমবায় পদ্ধতি, সবাই মিলে একত্রে কিছু একটা করা। সকলের জন্যে কল্যাণকর ও লাভজনক কোনো উদ্যোগ নেয়া। তার বদলে এখন জায়গা করে নিয়েছে ক্ষুদ্র ঋণ। যারা ক্ষুদ্র ঋণ নিচ্ছে তারা কেউ কিন্তু কারো সাথে যুক্ত নয়, প্রত্যেকেই বিচ্ছিন্ন। কেউ কারো সহযোগী নয়, বরং পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী।

পুঁজিবাদ এভাবেই মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক করে। পরিণত করে একজন ভোগবাদী মানুষে এবং মুনাফালোভীতে। যার ফলে মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগের প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছে টাকা। পারস্পরিক যোগাযোগের কোনো মাধ্যমই এখন কার্যকর হচ্ছে না টাকা ছাড়া।

এর প্রতিকারের জন্যে চাই সামাজিক যোগাযোগ। ফেসবুকের জগতে ‘সামাজিক যোগাযোগ’ নয়, দরকার প্রত্যক্ষ মানবিক যোগাযোগ। আমি একা ঘরে বসে লিখছি, গাইছি, সিনেমা দেখছি এ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, মহল্লায় সবখানেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে সমষ্টিগত সাংস্কৃতিক যোগাযোগ।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ চর্চা না থাকলে ছাত্রদের পরস্পরের মধ্যে তো বটেই, শিক্ষকদের সাথেও শিক্ষার্থীদের যোগাযোগটা হয়ে পড়ে শুধুই ক্লাসরুম-কেন্দ্রিক। তখনো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার একটা সম্ভাবনা ওদের থাকে। অন্যদিকে খেলাধুলা বিতর্ক ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ক্লাসরুমের বাইরেও ছাত্র-শিক্ষক সবার মাঝেই একটি সুন্দর যোগাযোগ স্থাপিত হয়। 

আর এভাবেই পুঁজিবাদী বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে একটি চাঙ্গা প্রতিরোধ আমরা গড়ে তুলতে পারব বলে আমি মনে করি। শেষ পর্যন্ত এ ব্যবস্থার বদল আমাদের করতেই হবে। এর মধ্যে আমরা বাঁচতে পারব না। কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিশ্বজুড়ে সহিংসতা সৃষ্টি করছে। সর্বত্র বাড়িয়ে তুলছে সংঘর্ষ। মাদকের বিস্তার ও অস্ত্রের প্রতিযোগিতা ধারণ করেছে এক ভয়াবহ রূপ। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক প্রয়োজনীয় সবকিছুকেই পণ্যে পরিণত করেছে। হরণ করেছে নারীর সম্মান ও নিরাপত্তা। সেইসাথে বাড়ছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য। 

পুঁজিবাদের প্রভাবে কমে গেছে জ্ঞানের চর্চা। আমরা এখন কিছু নির্দিষ্ট বিদ্যা ও দক্ষতা অর্জন করছি কেবল পেশাগত সুবিধা এবং ভালো উপার্জনের জন্যে। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা তো হওয়া চাই সর্বাঙ্গীণ, যা মানুষকে সত্যিকার অর্থেই বিকশিত করবে। নতুন নতুন জ্ঞানের দরজা খুলে দেবে। যে জ্ঞান তাকে কোনো বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ রাখবে না, সে বেরিয়ে যাবে তার সকল বৃত্ত ভেঙে।

আমরা শিক্ষার কথা বলছি, এই শিক্ষার ক্ষেত্রে আবার মাতৃভাষার চর্চাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটাই সর্বাগ্রে দরকার। আমরা জাতীয়তাবাদের কথা বলি। জাতীয়তাবাদের উপাদানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ভাষা। ভাষাই জাতীয়তাবাদের প্রধান ভিত্তি। যেমন : ইউরোপে রেনেসাঁ ঘটেছিল মাতৃভাষা চর্চার ফলে। এর মধ্য দিয়ে ওখানে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটল। পরবর্তীতে পৃথিবীব্যাপী তারা রাজত্ব কায়েম করল। ভাষাই ছিল এর অন্যতম নেপথ্য-নিয়ামক। 

আবার, আরবরা ইরান দখল করে চারশ’ বছর শাসন করেছে। ইরানিরা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছে। কিন্তু ওরা ওদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে। এটা করতে পেরেছে বলেই ইরান আজও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাজেই ভাষার চর্চা প্রয়োজন। ব্যক্তি যদি ভাষা ব্যবহার করতে না পারে সে যেমন মূক-বধির হয়ে যায়, তেমনি জাতিও মূক হয়ে যায় যদি সে তার ভাষা ব্যবহার করতে না পারে।

আর উপনিবেশের প্রধান আগ্রাসন হচ্ছে ভাষার প্রতি। অস্ত্র ব্যবহার করে কোনো অঞ্চল দখল করা যায় বটে, কিন্তু নিজেকে ওখানে প্রতিষ্ঠিত করার উপায় হচ্ছে ভাষা ও সংস্কৃতি। কারণ ধর্মের সাহায্যে কাউকে সম্পূর্ণ অধীন করা না গেলেও এ দুয়ের সাহায্যে তা সহজেই পারা যায়।

ইংরেজরা কী করেছিল? ওরা এসেছিল বাণিজ্য করতে, কিন্তু নানান কায়দাকৌশল ও বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে এদেশ দখল করে নিল। তারা তাদের ভাষাটাকে এখানে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল, যেন এই দেশে তাদের অনুগত একটা শ্রেণি তৈরি হয়- যাদের চেহারা ও রক্ত এদেশীয় হলেও রুচি ও চিন্তা-চেতনায় তারা হবে ইংরেজদের মতো।

বর্তমানে আমরা কিছু তরুণকে উন্মাদনা ও সহিংসতার দিকে ঝুঁকতে দেখছি, এটা কিন্তু ঘটছে প্রকৃত জ্ঞানের অভাবেই। এক ধরনের বিভ্রান্তি ও আসক্তির বৃত্তে ওরা আটকে গেছে। পুঁজিবাদের প্রতি মোহও এর একটা কারণ। এরা মূলত পুঁজিবাদী মানসিকতার শিকার। 

ধর্মের দুটি দিক আছে। নৈতিক ও আনুষ্ঠানিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা বা বিভিন্ন ধর্মাচার পালনের আয়োজনই দেখা যায়। কিন্তু ধর্মের নৈতিক শিক্ষাগুলোও তো বেশ গুরুত্বপূর্ণ যা মানুষকে ভালবাসতে বলে, নিজের সৎগুণগুলোকে বিকশিত করতে বলে, অন্যের কল্যাণে কাজ করতে বলে, কারো প্রতি অন্যায় না করার আহ্বান জানায় এসবের কোনো অনুশীলন আমরা এখন কোথাও দেখি না। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। অনৈতিকতার চর্চা বাড়ছে।

এ দুর্দশা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের। এজন্যে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক পরিমণ্ডলে বাড়াতে হবে নৈতিক মূল্যবোধগুলোর চর্চা। এর পাশাপাশি চাই সঙ্ঘবদ্ধ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা। কারণ ব্যক্তি প্রধানত শক্তিহীন যদি না সে যুক্ত হতে পারে সমষ্টির সাথে। 

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক।