বাংলাদেশ একদিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দেশ হবে
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
প্রকাশিত : ০৪:৫৮ পিএম, ১০ মার্চ ২০২১ বুধবার
এই অডিটোরিয়ামে ঢুকে যে এত মানুষ দেখব, এ আমি কল্পনাও করি নি। আগে যদি জানতাম তাহলে হয়তো আসতামই না। ও আমার দরদী, আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না। কাছাকাছি কয়েকটা অডিটোরিয়ামে আরো নাকি লোকজন আছে শুনলাম। ভাগ্য ভালো আমি তাদের দেখতে পাচ্ছি না। তা না হলে এতক্ষণে জবান বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
যা-ই হোক, আমার আজ ঠিক অত কথা বলা উচিত না। কারণ যেদিন যার বই প্রকাশিত হয় সেদিন তার অবস্থা থাকে আমাদের সময়কার বিয়ের আসরের জামাইয়ের মতো। আমার মনে আছে, অকারণেই একটা রুমাল দিয়ে সেদিন মুখখানা ঢেকে রেখেছিলাম। তেমনি যার বই প্রকাশিত হচ্ছে, সে আবার কথা বলবে কেন? কিংবা ধরুন, বিয়ের আসরে কনে যদি হঠাৎ গান গাইতে শুরু করে! আজকাল আবার দেখি গায়ও। দেবদাস ফিল্মের মধ্যে দেখি পার্বতীও নাচে, তার শাশুড়িও নাচে। সবাই একসঙ্গে মিলে সে কী তুমুল নাচগান!
এবার আসল কথায় আসি। প্রথমেই বলি, জামিলুর রেজা চৌধুরী আমার এই বইয়ের বিক্রির সম্ভাবনা পুরোপুরি শেষ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বইটা বুঝতে তার সময় লাগবে। আমার মনে হয় বইটা না কেনার পক্ষে পাঠকের জন্যে এ কথাটাই যথেষ্ট যে, ‘আপনারা ভাই এ বই কিনবেন না। কিনলেও বুঝবেন না। আমি যখন বুঝি নি তখন কি আর আপনারা বুঝতে পারবেন?’ কথা তো সত্যিই। বাংলাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ার যা বুঝতে পারছেন না, অন্যের কী স্পর্ধা সেটা বোঝে! কিন্তু আপনাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি ভাই আমার ভাষা খুব সোজা। বক্তব্য অতি সরল। আমার মনে হয় আপনাদের অত অসুবিধা হবে না, হলে পরে জামিলুর রেজা চৌধুরী সাহেবের কাছে যাবেন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্যে।
জামিলুর রেজা চৌধুরী আসলে খুবই অসাধারণ একজন মানুষ। অনেক দেরিতে তাকে বই উৎসর্গ করেছি আমি। সে-কারণে আমি কিছুটা লজ্জিত এবং সংকুচিত বোধ করছি। এটা আরো অনেক আগেই করা উচিত ছিল আমার। কেন বলছি কথাটা?
আপনারা জানেন, লক্ষ লক্ষ লোক আজকে বাংলাদেশ থেকে চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। বহু মানুষ যাচ্ছে চিরদিনের জন্যে। আর হয়তো ফিরে আসবে না। কিন্তু আমার ধারণা কোনো মানুষের মধ্যে যদি আলো থাকে, শক্তি থাকে, প্রতিভা থাকে তাহলে তিনি সাধারণত কখনোই দেশত্যাগ করেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি দেশেই ফিরে আসেন।
এমন বিস্তর নাম বলা যাবে, যারা দেশে ফিরে এসে আজ আমাদের জাতিকে গড়ে তুলছেন। তারা বিদেশে গিয়েছিলেন উচ্চতর পড়াশোনা বা পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর কাজে। কিন্তু একসময় ঠিক টের পেয়েছিলেন তার আত্মার আনন্দ ও তার জীবনের প্রকৃত যে পরিচয়, সেটা আছে কেবল তার মাতৃভূমিতে। বিদেশে এটা হয় না। ওখানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে বড় কাজ করা খুবই কঠিন।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বিদেশে ভালোভাবে থেকে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। অনেক উচ্চতর সাফল্যও তিনি সেখানে অর্জন করতে পারতেন। কিন্তু সেটা প্রত্যাখ্যান করে এই গরিব দেশটাকে তিনি ভালবেসেছেন। এদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের লক্ষ্যে ক্লান্তিহীন চেষ্টা করেছেন। শ্রম দিয়েছেন। আমি তাকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই। আমাদের সবার পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ একদিন অনেক বড় হবে। অনেক বড় বড় মানুষেরা আসবেন। আজকে ঢাকা শহরের সমস্ত বড় বড় রাস্তাগুলোর নামকরণ করা হয়েছে একেকজনের নামে। এই দেশে কি আর বড় মানুষ জন্মাবে না এদের চাইতে? যদি শেক্সপিয়ারের মতো একজন মানুষ আসেন, যদি প্লেটোর মতো একজন মানুষ জন্মে যান, তাকে কোন রাস্তা দেবেন আপনারা? একটা জাতির সবচেয়ে বড় রাস্তা কি আরো বড় মানুষের জন্যে অপেক্ষা করছে না?
আমার অনেক সময় মনে হয় এটা কেন করলাম আমরা? কারণ আমরা হয়তো ধরেই নিচ্ছি যে, এখানেই বাংলাদেশের শেষ। কিন্তু তা-তো নয়, বাংলাদেশ আরম্ভ হচ্ছে। মোটে জাগতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ এগোবে। বাংলাদেশ বড় হবে। বাংলাদেশ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দেশ হবে একদিন। এটা আমি নিজে গভীরভাবে বিশ্বাস করি। আমাদের জাতির মধ্যে মেধা আছে এবং বহু মানুষ আছে যাদের মধ্যে অফুরান কর্মোদ্যম রয়েছে। এ জাতিকে অনেক অনেক ওপরে নিয়ে যাবে তারা।
এজন্যে এখন যা দরকার আমাদের, সেটা হলো কাজ করে যাওয়া। শেষ পর্যন্ত কাজটাই মানুষকে জয়ী করে। কাজ হলো অথৈ সমুদ্রে একটা শক্তপোক্ত ভেলার মতো, যা মানুষকে ভাসিয়ে রাখে। কাজ না করলে মানুষ ডুবে যায়। সময়ের সমুদ্রে হারিয়ে যায়।
গ্রামের দিকে একটা কথা প্রচলিত আছে‘ভিক্ষুকের পায়ে লক্ষ্মী’। অর্থাৎ ভিক্ষা পেতে হলে হাঁটতে হয় এবং যে যত হাঁটবে তার প্রাপ্তি তত বেশি হবে। এটা একেবারে সহজ হিসাব। সুতরাং কোনোভাবেই বসে থাকা নয়। বসে থেকে নিঃশব্দে নিজের ভেতরে শেষ হয়ে যাওয়ার কোনোরকম সুযোগ জীবনে নেই। চিরদিন বাঁচব না আমরা কেউই, কিন্তু যে কয়দিন আছি এই পৃথিবীতে আমরা যেন কাজ করে যেতে পারি।
দিনকয় আগে আমাকে একটা অনুষ্ঠানে একজন বললেন যে, একদিন তো আমরা মরে যাব। আমি তখন বললাম, মরে যাব ঠিক আছে কিন্তু এখন কি বেঁচে আছি? যদি বেঁেচই থাকি তাহলে করণীয় কী আমার?
আমার একটাই কর্তব্য এই জীবনকে তার সর্বোচ্চ মহিমা দান করা। আমাদের সেটা পারতে হবে। তাহলেই আমরা অশান্তির হাত থেকে বাঁচব। দুঃখের হাত থেকে বাঁচব। হতাশার আক্রমণ থেকে বাঁচব। নৈরাশ্যের কবল থেকে বাঁচব। একটা আনন্দময় জীবন পার করে এই পৃথিবী থেকে চলে যাব। সেটাই তো আমাদের সবার কাম্য।
আমি সবসময় বলি, আমাদের অনেক দুঃখের মূল কারণটা হচ্ছে আশা হারিয়ে ফেলা। তাই আশাটা যেন আমাদের সবসময় থাকে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নৈরাশ্য বলে কোনো জিনিসের অস্তিত্বই নেই।
ধরা যাক, একটা গাড়ি পাহাড় বেয়ে উঠছে ওপরের দিকে। আপনি কী বলবেন? গাড়িটা উঠছে। ওপরে যাচ্ছে অর্থাৎ উত্থান হচ্ছে। কিন্তু গাড়িটা যখন আবার পাহাড়টা পার হয়ে নিচের দিকে নামে তখন কি আপনি বলতে পারবেন যে, ওর পতন হচ্ছে? না, কখনোই তা নয়, এটা কিছুতেই আপনি বলতে পারবেন না। কেন?
কারণ গাড়িটা নিচের দিকে নামলেও ওর চাকাটা কোন দিকে যাচ্ছে? সামনের দিকে না পেছন দিকে? সামনের দিকে। তাহলে তো এগোচ্ছে। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে যাকে আমরা নৈরাশ্য বলে মনে করছি অর্থাৎ পতন মনে করছি, সেটা তো আসলে সামনের আরেকটা পাহাড়ে উঠবে বলে। সেটা তো তাহলে উত্থান।
সুতরাং আমরা চিরদিন আসলে উত্থানের মধ্যেই আছি। পতন বলে কিছু নেই পৃথিবীতে। হতাশা বা নৈরাশ্য বলে কিছু নেই। এগুলো আমাদের মস্তিষ্কের অলীক কল্পনা দিয়ে তৈরি। দুঃখ আছে, মৃত্যু আছে, কষ্টও আছে কিন্তু সেগুলোই শেষ কথা নয়। ওটা সাময়িক। একে অতিক্রম করতে হবে। সেই গাড়ির মতোই আমাদের উঠতে হবে। নামতেও হবে। কারণ নামাটাও আসলে এক ধরনের ওঠা। পরবর্তী পাহাড়ে সে উঠতে যাচ্ছে। জীবনকে আমাদের দেখতে হবে এই দৃষ্টিতে। রবীন্দ্রনাথ তো এজন্যই তার গানে বলেছেন—
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে ॥
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ—
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে ॥
আমি আশাবাদে বিশ্বাস করি। তার মানে এই না যে, মাঝেমধ্যে একটু কুঁইকাঁই করি না। এটা সবারই হবে। আমি যত বড় আশাবাদীই হই, আমাকে যদি কেউ ভীষণভাবে আঘাত করে, আমার অজান্তেই আমার ভেতর থেকে একটা আর্তনাদের শব্দ বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সেই আর্তনাদই শেষ কথা নয়। ওটাই চূড়ান্ত সত্য নয়। আমাদের গন্তব্য হচ্ছে আরো অনেক দূরে। অনেক সামনে।
আমাদের জীবন আসলে মহিমান্বিত হয়ে ওঠে আমাদের শ্রমের মধ্য দিয়ে, আমাদের কাজের মধ্য দিয়ে, আমাদের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।
তাই আমি সবাইকে বলব যে, নৈরাশ্যে বিশ্বাস করবেন না। নৈরাশ্য নেই এ পৃথিবীতে। নৈরাশ্য হচ্ছে একটা বিভ্রম, একটা মায়া ও মরীচিকা যেটা আমি প্রায়ই বলি। এর কোনো অস্তিত্বই নেই। আমরা যাকে নৈরাশ্য বলি, সেটা হচ্ছে আশারই একটা অন্য রূপ মাত্র। সুতরাং আসুন, আমরা সবাই আশা করি। আমরা সবাই বিশ্বাস করি—He who liveth, he who believeth, shall never die.
(বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখা প্রবন্ধের বই ‘ভাঙো দুর্দশার চক্র’র প্রকাশনা অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্য থেকে সংক্ষেপিত। প্রকাশনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ জামিলুর রেজা চৌধুরী।)