ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

মনুষ্যত্বের কাছে পাশবিকতা হার মানবেই

অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম

প্রকাশিত : ০২:৪৭ পিএম, ১১ মার্চ ২০২১ বৃহস্পতিবার

আমি তখন বিলেতে। একদিন শুনলাম, সে-দেশের পারমাণবিক কেন্দ্রে যারা কাজ করে প্রতিদিন কর্মস্থলে ঢোকার সময় ওদের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। বেরোবার সময়ও পুনরায় চেক-আপ করে দেখা হয়। কারণ কোনো কারণে হঠাৎ যদি সে ভুল করে একটা টিপ দিয়ে বসে, সারা পৃথিবী মুহূর্তেই শেষ! কিন্তু এভাবে পরীক্ষা করে কয়দিন? সারাদিন যন্ত্র নিয়ে কাজ করতে করতে যে মানুষ একেবারে যন্ত্রের বশীভূত হয়ে গেছে, তাকে তো যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

বর্তমান যুগ নিয়ে আমরা অনেক গর্ব করি। মানুষ মহাকাশে চলে যাচ্ছে, তার জীবনযাত্রার মান ও শক্তি-সম্পদ অকল্পনীয়ভাবে বেড়েছে। বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে প্রযুক্তি ও অর্থনীতিতে। কিন্তু ধন জ্ঞান জন, এ-ই কি সব? পাল্লা দিয়ে যে বাড়ছে নৃশংসতা লোভ ঘৃণা যুদ্ধ ও গণহত্যা! কমছে মমত্ববোধ ও সম্প্রীতি। তাই এ-কালে আমাদের অর্জন অনেক— এটা সত্যি, কিন্তু বিসর্জনও কম নয়। মনুষ্যত্বের বিকাশ ও বিবর্তনকে আজ ম্লান করে দিচ্ছে মানুষেরই নেতিবাচক দিক। 

এসব দেখে ম্যাক্সিম গোর্কি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘হায় রে মানুষ! তুমি কী বিচিত্র! তুমি পাখির মতো আকাশে উড়তে শিখেছ, মাছের মতো পানিতে সাঁতার কাটতে শিখেছ! কিন্তু মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাস করার যোগ্যতা তুমি এখনো অর্জন করলে না!’ কবি হাসান হাফিজুর রহমান বলেছিলেন, ‘এ যুগে আমাদের অর্জন যত বেশি হোক না কেন, এখন আর মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা নেই।’ আর স্বামী বিবেকানন্দের মতে, ‘মানুষ যদি মানুষের ওপর আস্থা হারায় তাহলে আর নির্ভর করার কিছু থাকে না।’

অর্থাৎ এ যুগের মূল সমস্যা অর্থনৈতিক বা প্রযুক্তিগত নয়, মূল্যবোধ-সংক্রান্ত। ১০ লক্ষ বছর আগে মানুষ পশুর মতো কাঁচা মাংস খেত, অন্যের ওপর দৌরায করত। ব্রিটিশ দার্শনিক হব্স-এর মতে, ‘ঐ সময়ের জীবন ছিল বিচ্ছিন্ন। সামাজিক বন্ধন, পরিবার, রাষ্ট্র এই ধারণাগুলো ছিল না। মানুষ বিশ্বাস করত, প্রকৃতিতে যা-কিছু আছে সব আমার। তার একমাত্র প্রবৃত্তি ছিল নিজের অবস্থানটা কী করে পোক্ত করা যায়।’

সেকালের প্রেক্ষাপটে এটা হয়তো যুক্তিযুক্ত। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে যখন সব বাধা পেরিয়ে আমরা মঙ্গল গ্রহে সুপেয় পানি খুঁজছি সেই সময় আশুলিয়া থেকে বুড়িগঙ্গা, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সবখানে দূষণ। ওষুধ খেতেও ভয় লাগে। মানুষের এ অবক্ষয়ের কারণ কী? বিপুল বিত্তের মধ্যে থেকেও চিত্তের এ মহা শূন্যতা কেন?

কারণ নৈতিকতার চেয়ে এখন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে পাশবিক প্রবৃত্তি। তাই মানুষ যুদ্ধে লিপ্ত— নিজের সাথে, সঙ্গীদের সাথে। পরিবেশের সাথেও! প্রশ্ন হলো, এত বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও মানুষ কেন যুদ্ধ করে?

১৯৩২ সালে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন আক্ষেপ করে মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডকে লিখেছিলেন, ‘নিজেদের যারা শিক্ষিত সুসভ্য বলে দাবি করে, তারা কী করে সংকীর্ণ স্বার্থের দোহাই দিয়ে ছোটখাটো ঝগড়াঝাঁটি থেকে শুরু করে মহাযুদ্ধ পর্যন্ত করার ইন্ধন জোগায়?’ উত্তরে ফ্রয়েড লেখেন, ‘মোটাদাগে কাউকে ভালো বা মন্দ বলা যাবে না। সব মানুষের মধ্যেই ঝগড়াটে স্বভাব ও সৌহার্দ্যবোধ সমভাবে ক্রিয়াশীল। এ দুটো বিপরীত শক্তির চলমান লড়াইয়ে মানুষ যদি কোনো কারণে তার আগ্রাসী মনোভাবের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ে, তখনই আরম্ভ হয় বিবাদ। মানুষের সৌহার্দ্যবোধকে সুদৃঢ় করার জন্যে তাই প্রয়োজন সুশিক্ষা ও সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ’।

শিক্ষা মানুষেরই দরকার। কারণ মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। একটা গরুর বাচ্চা জন্মের পর পরই লেজ উঁচিয়ে লাফাতে থাকে। আবার যে মানবশিশু জন্মের পর সবচেয়ে অসহায় প্রাণী, সে-ই একসময় হয়ে উঠতে পারে বিশ্বখ্যাত কেউ। আবার ঠিকপথে পরিচালিত না হলে সে হয় কুখ্যাত অপরাধী। অর্থাৎ মনুষ্যত্ব অর্জনের জন্যে সুশিক্ষার পথে এগিয়ে গেলে নর হতে পারে নারায়ণ। উল্টোপথে চললে নরাধম।

কিন্তু শিক্ষা মানে কি কেবল প্রশিক্ষণ? একজন সার্জন মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ শিশুকে বাঁচিয়ে তুলতে পারেন, আবার রোগীকে মেরেও ফেলতে পারেন। তাই শিক্ষা শুধু কিছু জানা বা আয়ত্ত করা নয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য ‘মানুষ’ তৈরি করা। শিক্ষাই জৈবিক ব্যক্তিকে নৈতিক মানুষে রূপান্তরিত করে। সত্যিকার শিক্ষার মধ্যে চাই কিছু মূল্যবোধ। প্রথমত, সত্যনিষ্ঠা। সত্যের জন্যে সবকিছুকে ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনোকিছুর জন্যেই সত্যকে ত্যাগ করা যায় না। দ্বিতীয়ত, সৌন্দর্যবোধ। তৃতীয়ত, কল্যাণ চেতনা। সত্য সুন্দর কল্যাণের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ মানুষ কখনো মন্দ কাজ করতে পারে না।

বাইবেলে আছে, ‘ঈশ্বরের রাজত্ব বাইরে নয়! তোমার মধ্যেই তা আছে, সেই রাজ্যে প্রবেশ করার উপায় হলো নিজেকে ও পরিবেশকে পরিবর্তন করার নিষ্ঠা ও সংকল্প। এজন্যে চাই সৎ, সাহসী, আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ। এ কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণায় লেখা ছিল এই প্রতিষ্ঠান শুধু জ্ঞান বিতরণের জন্যে স্থাপন করা হচ্ছে না। নেতৃত্বগুণসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ মানুষ গড়ে তোলাই এর মূল উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য সফল করার সময় এখনো শেষ হয়ে যায় নি। অতীতের ভুলগুলো সংশোধন করে নতুনভাবে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। 

অনেকে বলে, বাংলাদেশ গেল গেল গেল। কিন্তু আমি হতাশাবাদী নই। এই দেশ বারো ভূঁইয়ার দেশ, যারা মোঘল সিংহাসন কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ব্রিটিশ আমল থেকে দফায় দফায় আন্দোলন করে আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি। সেই প্রেরণা এখনো আমাদের রক্তের মধ্যে আছে। আমাদের তরুণেরা আজ সারা পৃথিবীতে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে।

কাজেই পরিস্থিতি যেমনই হোক, হতাশ হলে চলবে না। মনুষ্যত্বের কাছে পাশবিকতা শেষ পর্যন্ত হার মানবেই। তাই অপশক্তির মোকাবেলা করতে হবে সাধ্যমতো। সংহত করতে হবে আমাদের নৈতিক-মানবিক আদর্শ। তাহলেই বিশ্ব এগিয়ে যাবে নৈতিক প্রগতির পথে। 

এজন্যে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমমর্মিতা বাড়াতে হবে। দল-মত-পথ নির্বিশেষে একসাথে কাজ করতে হবে। মানুষের মধ্যে ভিন্নতা সত্ত্বেও খুঁজে নিতে হবে ভেদের মধ্যে অভেদ, অনাত্মীয়তার মধ্যে আত্মীয়তা। এভাবেই সারা পৃথিবী ক্রমান্বয়ে শান্তির দিকে অগ্রসর হবে বলে আমার বিশ্বাস।
[মুক্ত আলোচনা, ২ জানুয়ারি ২০১৭]
এসএ/