শোকরগোজার দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়
খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ
প্রকাশিত : ০৩:৫২ পিএম, ১৮ মার্চ ২০২১ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০১:৫৩ পিএম, ১৯ মার্চ ২০২১ শুক্রবার
নদী পার হতে নৌকার প্রয়োজন আছে, কিন্তু নৌকার ভেতরে যদি পানি ঢুকতে শুরু করে তবে নৌকা তো চলবে না, পানিতে ভেসে চলার পরিবর্তে ডুবে যাবে। তেমনি এই পৃথিবীতেও আমাদের দেহটা হলো নৌকা। এর ভেতরে যেন দুনিয়া প্রবেশ না করে, করলেই বিপত্তি। এটা বলে গেছেন মহাকবি শেখ সাদী।
ব্যাপারটা আমরা আরেকটি ঘটনার মাধ্যমে বুঝতে পারি। হযরত আব্দুল কাদের জিলানীর (র) ঘটনা। একবার তার এক খাদেম এসে জানালেন— হুজুর একটা দুঃসংবাদ! আমাদের মালপত্র বোঝাই একটা জাহাজ সমুদ্রে ডুবে গেছে, ফলে বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে। শুনে তিনি বললেন, শোকর আলহামদুলিল্লাহ!
দুদিন পর আবার খবর এলো ঝড় উঠেছিল ঠিকই কিন্তু জাহাজডুবি আর হয় নি। ডুবতে ডুবতে বেঁচে গেছে। এবারও তিনি বললেন, শোকর আলহামদুলিল্লাহ! খাদেম মহাবিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলেন হুজুর! আজ ভালো খবর দিলাম, আপনি বললেন আলহামদুলিল্লাহ। ঐদিনের খারাপ খবরেও একইরকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। শোকরগোজার ছিলেন। আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন দয়া করে।
হযরত আবদুল কাদের জিলানী (র) বললেন, তুমি যখন একটা খারাপ সংবাদ দিলে তখন আমি মনকে জিজ্ঞেস করলাম মন, তুই কি কষ্ট পেয়েছিস? মন বলল, না। আজ ভালো খবর শুনে আবার জিজ্ঞেস করলাম মন, তুই কি খুশি হয়েছিস? বলল, না। অর্থাৎ লোকসান হলেও আলহামদুলিল্লাহ, লাভ হলেও আলহামদুলিল্লাহ। প্রকৃতপক্ষে দুনিয়ায় এই শোকরগোজার দৃষ্টিভঙ্গিই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায়।
পরশপাথর কবিতায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক দরিদ্র পরিবারের কথা তুলে ধরেছেন। সেই পরিবারে স্ত্রী একদিন স্বামীকে বলল, পরশপাথর বলে একটা পাথর আছে যার স্পর্শে লোহাও সোনা হয়ে যায়। দেখ তো খুঁজে পাও কিনা।
তো, স্বামী খুঁজতে বেরোল; কিন্তু কোথাও খুঁজে পায় না পরশপাথর। একদিন মরুভূমির মধ্যে দেখল, এক সাধু তপস্যা করছেন। সে বলল, বাবা আমার একটা পরশপাথর দরকার। কোথায় পাব? শুনে সাধু তার থলে থেকে একটা পাথর বের করে বললেন যে, এটা?
সত্যিই তা-ই হলো। পাথরটি যেই লোহাতে ছোঁয়ানো হলো অমনি দেখা গেল, ওটা সোনা হয়ে গেছে। সে মহাখুশিতে এক দৌড় দিল তার বাড়ির দিকে। কিছুদূর গিয়ে তার মনে হলো আমাকে পরশপাথর এমনি এমনি দিয়ে দিল! তার মানে ঐ সাধুর কাছে নিশ্চয়ই আরো মূল্যবান কোনো জিনিস আছে। সে আবার গেল সাধুর কাছে।
কবিতার একপর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, আত্মনিমগ্নতার মধ্য দিয়ে সত্যিই সেই সাধু পরশপাথরের চেয়েও মূল্যবান কিছু পেয়েছিলেন। আর তা হলো সত্যজ্ঞান।
তাই আমরা বলতে পারি যে, জ্ঞান ও শিক্ষা এক নয়। প্রচলিত শিক্ষা না পেয়েও একজন মানুষ জ্ঞানী হতে পারেন। আত্মনিমগ্নতার পথ ধরেই মুনি-ঋষি, সুফিসাধক ও সন্ন্যাসীরা জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। প্রকৃত মানুষ হতে হলে প্রয়োজন এই আত্মনিমগ্নতা।
লেখক : বিশিষ্ট ব্যাংকার