মানুষ পরিচয়টাই সবচাইতে বড়
আফজাল হোসেন
প্রকাশিত : ১২:৫৬ পিএম, ১৯ মার্চ ২০২১ শুক্রবার | আপডেট: ০১:৫৫ পিএম, ১৯ মার্চ ২০২১ শুক্রবার
আমার খুব পড়ার নেশা। আর আছে জীবন সম্পর্কে জানার আগ্রহ। কীভাবে জীবন উন্নয়ন করতে হয়, কীভাবে সফল পেশাজীবী হতে হয় এসব বিষয়ে আমি প্রচুর পড়েছি। কিন্তু কোয়ান্টাম মেথড কোর্সে এসে আমার একটা উপলব্ধি হলো, পড়ে আসলে এগুলো কিছুই জানা হয় নি; কারণ পড়া মানে আমি শুধু পাঠকই থেকে গেছি, আর এ কোর্স থেকে যখন বাড়ি ফিরেছি মনে হয়েছে আমি সত্যিই একজন শিক্ষকের কাছ থেকে ফিরলাম।
আমি যা পড়েছি, গুরুজী এখানে তা-ই বলছেন। সবার উপযোগী করে বলছেন। এ কোর্সে যারা এসেছেন, তারা একেকজন একেক মাত্রার মানুষ। অর্থাৎ সমপরিমাণ মেধা ও অনুধাবন-ক্ষমতা এখানে সবার নেই। কিন্তু তিনি সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছাচ্ছেন। এটা একটা মহাযোগ্যতা। সবচেয়ে বড় কথা, কঠিন কথাগুলো তিনি বলেছেন হাস্যরসের মধ্য দিয়ে, যেন আমরা তা মনে রাখতে পারি। ধারণ করতে পারি।
আরেকটি ব্যাপার আমার ভালো লেগেছে, এ কোর্সের চার দিন যাদের সাথে কাটিয়েছি তাদের সবাইকে ‘আমার’ বলে মনে হয়েছে। অসম্ভব সুন্দর কিছু মানুষ এদেশে রয়েছেন তা পুনর্বার বিশ্বাস করতে হলো। এই চারটি দিন তারা সবাই একেবারে মুগ্ধ হয়ে প্রতিটি ভালো কথা শুনেছেন। যে সময়ে আমরা বাস করছি, যে সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত, আমরা প্রতিদিন অসংখ্য আবর্জনা গিলছি। তার মধ্যে ভালো কথা শোনা মানে হলো, মনে যে হতাশাটা ছিল সেটি আর থাকছে না।
মানুষের হতাশ হওয়ার নানান কারণ থাকে। আমার মধ্যেও কষ্ট-হতাশা কিছু আছে। আমি স্রষ্টায় বিশ্বাস করি এবং ব্যক্তিগত পারিবারিক পেশাগত জীবনে নিজেকে একজন সুখী মানুষ বলেই মনে করি। কিন্তু কথা হচ্ছে, সমাজে আমরা কেউ একা বাস করি না, আমি একা সুখী মানেই সুখী নই। আমার পাশের মানুষটি কী আচরণ করছে তা দিয়ে আমরা প্রভাবিত হই। এই হতাশাটি আমাকে প্রায়ই আক্রান্ত করে।
বন্ধুরা বলে, গায়ে মাখিস কেন? কিন্তু আমি তো হাঁস না, আমি মানুষ। গায়ে মাখব না কেন? চার দিন পর এটাই মনে হচ্ছে, মানুষ হিসেবে নিজের চিন্তাভাবনা দিয়ে আমরা যেন অন্যকে আক্রান্ত না করি।
অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেন আপনি অভিনয় করেন, বিজ্ঞাপন-নাটক নির্মাণ করেন, উপস্থাপনা করেন, ছবি আঁকেন, লেখেন— কোন পরিচয়টা আপনার কাছে সবচেয়ে বড়? আমি বলি ‘মানুষ’ পরিচয়টা আমার কাছে সবচাইতে বড়। আমার প্রতিটা কাজের মধ্য দিয়ে যদি আমার ভেতরের ‘ভালোত্ব’টাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তাহলে আমি যে ‘মানুষ’ হিসেবে জন্ম নিয়েছি, সে ঋণটা শোধ হয়।
অনেকে আবার জানতে চান, কেন কাজ করেন? কাজটা আমি করি আসলে উপভোগের জন্যে। আমি যে কাজগুলো করি তার মধ্যে একটা আনন্দ আর উপভোগের ব্যাপার আছে, আমি মূলত সেটাই খুঁজে বেড়াই। কারণ জীবনটা তো একবারের। তাই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ও কাজের মধ্য দিয়ে আমি ভিন্ন ভিন্ন একেকটি জগতকে বুঝতে, জানতে, আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছি সবসময়।
আর যে-কোনো কাজে দক্ষতা কিংবা সাফল্য অর্জনের জন্যে অধ্যবসায় তো লাগেই। এখানে সবকিছু অর্জন করে নিতে হয় এবং অধ্যবসায় দিয়েই সেটা করতে হয়। আমিও তা-ই করেছি। নিজেকে ক্রমাগত বদলে নিয়েছি। বর্তমান সময়ে অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিয়ে একজন অভিনেতা প্রচুর উপার্জন করতে পারেন। কিন্তু আমার কখনো মনে হয় নি আমি অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেব। কারণ প্রতিদিন একই কাজ, ওটাতে এক ধরনের একঘেয়েমি আছে। আমার সবসময় মনে হয়েছে একটা জায়গা দরকার, একটা ভাবনা দরকার, সেই ভাবনার জগতে ঢোকা দরকার এবং তাতে লেগে থাকা দরকার। আমি সেটাই করতে চেয়েছি। বাঁচতে চেয়েছি নতুন নতুন উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণায়।
চাওয়া আমারও আছে, কিন্তু তা আমাকে লোভী করে না। লোভ থাকলে প্রতিমুহূর্তেই মনে হতো, আমি যা করছি তা আমার উপার্জনের জন্যে যথেষ্ট নয়। ফলে অশান্তি বাড়ত, শরীর-মনে অসুখ ঢুকত। মনে হতো, প্রতিদিন কেন নাটক করছি না? করলে তো লোকে নিত্য প্রশংসা করত। এমনি নানা অভাব, অতৃপ্তি, মনোযাতনা, পীড়ন আসতে পারত।
বরাবরই জীবনকে উপভোগ করতে চেয়েছি বলে আমার ক্ষেত্রে এটা ঘটে নি। আমি বলতে পারি, কোনোকিছুই আমাকে আমার ভেতর থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারে না। আমার মতো থাকতে দেয়। আমি দাবি করতে পারি, আমি ভালো আছি। আমার জীবন অর্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। আমার কাছে জীবনের প্রতিটা দিনই তাই গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয়।
আমি ও আমার বন্ধু হুমায়ূন ফরিদী, আমরা দুজন একই বয়সের, একইসাথে অভিনয় করেছি। কিন্তু আজ ও নেই, আমি বেঁচে আছি! এ পৃথিবীর আলো বাতাস বন্ধুসঙ্গ সবই উপভোগ করছি। এই বেঁচে থাকাটাই তো একটা স্মরণীয় ঘটনা। আমি নিশ্চিত জানি— আমিও একদিন থাকব না, তখনো এ পৃথিবীর সবকিছু এভাবেই চলবে। ভালোভাবেই চলবে। সৃষ্টিকর্তা এখনো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, এজন্যে আমি কৃতজ্ঞ।
কোয়ান্টাম মেথড কোর্সে দেখেছি, কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিভঙ্গি এবং এ-জাতীয় বিষয়গুলো নিয়ে এখানে বার বার বলা হয়েছে। এতে এ ধরনের অনুভূতি ও উপলব্ধিগুলো আরো শাণিত হয়ে ওঠে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো প্রাপ্তির আশা নিয়ে কোয়ান্টামে আসি নি। নানারকম কাজে ব্যস্ত থাকি, কয়েকটা দিন আমার অবসর দরকার ছিল। একটু ভিন্ন মাত্রার অবসর। সে হিসেবে বলতে পারি, সময়টা আমার খুব ভালো কেটেছে। আমি উপভোগ করেছি। আর সেটাই তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমি আবার এখানে আসব, বন্ধুদের নিয়ে আসব কোনো প্রাপ্তির আশায় নয়, আসব শুধু এই ভালো কথাগুলো শোনার জন্যে। আশা তো জাগায় ভালো কথা, ভালো কাজ। আমাদের দেশটায় ভালো কথার খুব অভাব রয়েছে। কোর্সে যতক্ষণ ছিলাম, মনে হয়েছে, এ কথাগুলো যদি দেশের সব অঞ্চলের সব মানুষকে শোনানো যেত, সচেতন করা যেত, খুব ভালো হতো।