মানুষে মানুষে কেন এতো বিরোধ?
বাপ্পী রহমান
প্রকাশিত : ০৬:৫৩ পিএম, ১৯ মার্চ ২০২১ শুক্রবার | আপডেট: ০৭:৪৮ পিএম, ১৯ মার্চ ২০২১ শুক্রবার
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে কয়েক শ মানুষ। হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হককে নিয়ে এক ব্যক্তির ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জের ধরে তার কয়েক শ অনুসারী ওই গ্রামে হামলা চালায়। প্রিয় পাঠক, মামুনুল হককে চিনতে পারছেন তো! গত বছরের শেষের দিকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে তা অবিলম্বে বন্ধের দাবি জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা মামুনুল হক। মামুনুল হক বলেছিলেন, “ধোলাইখালে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি স্থাপন বঙ্গবন্ধুর আত্মার সঙ্গে গাদ্দারি করার শামিল। যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন করে তারা বঙ্গবন্ধুর সু-সন্তান হতে পারে না। এর মাধ্যমে মসজিদের শহরকে মূর্তির শহরে পরিণত করার অপচেষ্টা চলছে। এ মূর্তি স্থাপন বন্ধ করুন। যদি আমাদের আবেদন মানা না হয়, আবারও তওহিদি জনতা নিয়ে শাপলা চত্ত্বর কায়েম হবে।” মামুনুল হক তওহিদি জনতা নিয়ে শাপলা চত্ত্বর কায়েম হননি তবে তার উসকানিমূলক বক্তব্যের পর পরই কুষ্টিয়া শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়েছিল।
শাল্লা উপজেলায় হিন্দু গ্রামে হেফাজতের হামলার ঘটনা একটু ভিন্নতর। গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের অনুসারীরা নোয়াগাঁও গ্রামের মসজিদের মাইকে মুসলমানদের হামলায় অংশ নিতে আহ্বান জানান এবং গ্রামের বাড়িতে লুটপাটসহ নারীদের নির্যাতন করে। পুরুষরা হাজারো আক্রমণকারীদের সশস্ত্র অবস্থায় দেখে আশপাশের গ্রামে পালিয়ে গিয়ে রক্ষা পান। ‘তরা মুক্তিযোদ্ধা আগে তরারে বাইচ দিতাম। হালার মালাউনের বাচ্চারা আর তরারে ছাড়তাম না। তরা আমরার বড় হুজুরের সম্মান নষ্ট খরছস’ বলে মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে খুঁজে হামলা করে। বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র দাস, কাজল চন্দ্র দাস, সুনু রঞ্জন দাস, কাজল চন্দ্র দাস, অনিল কান্তি দাসসহ গ্রামের সাতজন মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘরে হামলা করে। মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্রের পাকা ঘরের দরজা-জানালা ভেঙে প্রবেশ করে সব কিছু তছনছ করে। এ সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিলে হামলাকারীরা আরো আগ্রাসী হয়ে ওঠে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে খিস্তি-খেউড় করে। মুক্তিযোদ্ধাদের মালাউন আখ্যায়িত করে তাদের বাড়িঘর ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। বর্বরোচিত এ ঘটনায় নির্বাক হয়ে গেছেন গ্রামের মানুষ।
‘ধম্মং শরণং গচ্ছামি’। ধর্মের নামে অশান্তি ডেকে আনার এই ঘনঘোর সংকটে এবং ধর্মকে খুব সহজেই রাজনীতির বর্শায় বিদ্ধ এক শিকার হতে দেখেও শেষতক আমি ধর্মেরই শরণ নিলাম!
‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে বাদ দিয়ে ওরা যাদের উপাসনা করে, ওদের (সে দেবতাদের) গালি দিও না। যদি দাও তাহলে ওরা অজ্ঞতাবশত (বাড়াবাড়ি করে) আল্লাহকে গালি দেবে। (সূরা আনআ’ম, ৬:১০৮) ।
ইসলাম মানে শান্তির জন্য আত্মসমর্পণ। হাদিস শরিফে আছে, ‘প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও জবান থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদে থাকে বা কষ্ট না পায়। ইসলামী ব্যবস্থা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা, সহমর্মিতা, সহযোগিতা, সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং ঐক্যবদ্ধ জীবনযাপনকে অপরিহার্য করে দিয়েছে। পক্ষান্তরে যেসব বিষয় মানুষের মধ্যে বিভেদ, অনৈক্য, হিংসা- বিদ্বেষ, হানাহানি, খুন খারাপী, নিপীড়ন এবং স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যে চিড় ধরায়, ইসলাম এ সকল বিষয়কে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। একই সাথে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য ইসলাম বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে। পন্ডিত সলিমুল্লাহ খান তার বয়ানে বলছেন “এই দুনিয়ায় ধর্মের সহিত ধর্মের কোন বিরোধ নাই। বিরোধ যদি থাকে তো তাহা কেবল লোকের সহিত লোকের। এই বিরোধ স্বার্থের সহিত স্বার্থের-পরমার্থের সহিত পরমার্থের মোটেও নহে” ।
‘সর্বে সুখিনা ভবন্তু, সর্বে সন্তু নিরাময়া’। ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাওয়া বাড়ি হয়তো ফিরে আসবে আবার কিন্তু ‘বিশ্বাস’ আর ফিরে আসবে কীনা জানিনা। তার পরও প্রার্থনা করলাম, জগতের সকল প্রাণী অন্তত একবারের জন্য সুখি হোক!
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
আরকে//