ঢাকা, সোমবার   ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪,   আশ্বিন ৮ ১৪৩১

ধর্ষণ চেষ্টার মামলা করায় সমাজচ্যুত গৃহবধূর পরিবার, মসজিদে যেতে বাধা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:২২ পিএম, ২২ মার্চ ২০২১ সোমবার | আপডেট: ১০:৩২ পিএম, ২২ মার্চ ২০২১ সোমবার

আদালতে ধর্ষণচেষ্টা মামলা করায় এক গৃহবধূ তাসলিমা বেগম-(২৫) ও তার পরিবারকে সমাজচ্যুত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলা চরক্লার্ক ইউনিয়নের কেরামতপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে।

সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি মসজিদে প্রবেশেও দেয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। স্থানীয় মসজিদ কমিটিকে ব্যবহার করে প্রভাশালীরা পরিবারের ওপর নানা ধরণের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়। প্রভাবশালীদের হুমকি-ধামকিতে ভিটেমাটি ছেড়ে দু’সন্তানকে নিয়ে দু’মাস ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ওই গৃহবধূ। অন্যদিকে গত ১০দিন ধরে গৃহবধূর বাবা ও পরিবারের সদস্যদের এক ঘরে করে রাখা হয়েছে। 

রোববার নির্যাতনের শিকার ওই নারীর বাড়িতে সরেজমিনে দেখা গেছে, বসত ঘরের দরজা বেধে রাখা হয়েছে। ঘরের পাশে আবাদ করা বিভিন্ন ধরণের সবজি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত দু’মাস ধরে এ বাড়িতে কেউ থাকেন না। 

ভুক্তভোগীর বাবা সাহাব উদ্দিন (৫৫) জানান, গত বছরের ৮ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে কেফায়েত উল্যাহ (৪৫) ও বাহার উদ্দিন (৪০) তাঁর মেয়ের ঘরে ঢুকে মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। মেয়ের চিৎকার শুনে আমি এগিয়ে গেলে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আমাকেও মারধর করে। পরে মেয়ে নোয়াখালীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতে ১০ আগস্ট একটি মামলা করেন।

তিনি বলেন, স্থানীয় দোকানপাটে আমাদের কাছে বিক্রি করতে নিষেধ করা হয়েছে। আমাদের সন্তানদের মোক্তবে, মসজিদে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি আমাকে (১২ মার্চ) জুম্মার নামাজ পড়তে গেলে মসজিদ কমিটির লোকজন মসজিদে আসতে নিষেধ করে দেয়। গত জুম্মার নামাজে (১৯ মার্চ) গেলে মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ কমিটির লোকজন আমাকে মারধর করে গলা ধাক্কা দিয়ে মসজিদ থেকে বের করে দেয়। 

গৃহবধূর বাবার অভিযোগ, কেফায়েতকে গ্রেফতারের পর তার পক্ষে মসজিদ কমিটির সভাপতি এমলাক সওদাগর, সেক্রেটারি সোলেমান সওদাগরসহ সমাজপতিরা গত দুই সপ্তাহ আগে বৈঠক করে। এসময় সমাজপতিরা আদালত থেকে মামলা তুলে নিতে বলেন। না হলে তাঁর মেয়ে এলাকায় থাকতে পারবেন না বলে সিদ্ধান্ত দেন। 

মামলার বাদী ওই গৃহবধূ টেলিফোনে জানান, মামলা তুলে না নিলে আমাকে সমাজে গ্রহণ করা হবে না। মামলা তুলে না নেয়ায় আমি ও আমার দুই সন্তান নিয়ে এলাকা থেকে পালিয়ে এসেছি। 

গৃহবধূর করা মামলার আইনজীবী মো. সাইফ উদ্দিন কামরুল বলেন, গত বছরের আগস্টে চরক্লার্ক ইউনিয়নের কেরামতপুর গ্রামের গৃহবধূ (তাসলিমা বেগম)-কে ধর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় একই গ্রামের মৃত. সুলতান আহম্মদের ছেলে কেয়ায়েত উল্যাহ (৪৫) ও তাজল হকের ছেলে বাহার উদ্দিন। এ ঘটনায় তাসলিমা নোয়াখালীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ২ মামলা করেন। মামলায় বিচার বিভাগীয় দুটি তদন্তে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগের সত্যতা পায় আদালত।
আদালত কেফায়েত উল্যাহর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এরপর মামলায় অভিযুক্ত ১নং আসামি কেফায়েত উল্যাহকে ১২ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করে চরজব্বর থানার পুলিশ। এরপর থেকেই ভিকটিমের পরিবারের ওপর মামলা তুলে নেয়ার জন্য হুমকি ও চাপ আসতে থাকে। মামলা তুলে না নেয়ায় ভিকটিমের স্বামী সাইফুল ইসলাম ও তার ছোটভাই আলাউদ্দিনকে আসামি করে মামলার ২নং আসামি বাহার উদ্দিনের স্ত্রী প্রিয়া বেগম (৩৫) একই আদালতে ধর্ষণ মামলা
দায়ের করেন। কিন্তু ধর্ষণের মামলাটি মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তা খারিজ করে দেয়। 

স্থানীয় মধ্যম কেরামতপুর আহমদিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা মসজিদের ইমাম বলেন, তাদেরকে সকল ধরণের সামাজিক আনুষ্ঠানিকতায় অংশগ্রহণে নিষেধ করা হয়েছে তবে মসজিদে আসতে নিষেধ করা হয়নি। 

কী কারণে নিষেধ করা হয়েছে জানতে চাইলে মসজিদ কমিটির সভাপতি এমরাত সওদাগর সামাজিক আনুষ্ঠানিকতায় অংশগ্রহণে নিষেধের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ধর্ষণের মামলা দেয়া হয়েছে। আমাদের এলাকায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। রাস্তার পাশে ছিমের বীজ বপনকে কেন্দ্র করে ঝগড়া বিবাদ হয়েছে। এই মহিলা মামলা করে এলাকাকে কলঙ্কিত করেছেন। সমাজের লোকজন সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের একঘরে করা হয়েছে। আমরা সামাজিকভাবে সিদ্ধান্ত দিয়েছি কিন্তু তারা (ভিকটিম
পরিবার) সে সিদ্ধান্ত মানেনি।

এ বিষয়ে, সুবর্ণচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এএসএম ইবনুল হাসান ইভেন বলেন, বিষয়টি জানার পরে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দিয়েছি। সমাজচ্যুত করাটা কোনো আইনগত প্রক্রিয়া নয়। মসজিদে যেতে দিবে না, বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে দিবে না এটা হতে পারে না। এ বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিতে বলেছি। 

চরক্লার্ক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল বাশার বলেন, আমি নিজে রাতে ওই এলাকায় যাচ্ছি। ইতোমধ্যে স্থানীয় মেম্বারকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
কেআই//