ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু

ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

প্রকাশিত : ০৫:২২ পিএম, ২৯ মার্চ ২০২১ সোমবার

বাংলাদেশ আজ ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণালী দিন পালন করছে। এদেশের উন্নয়ন করোনা সংক্রমণের মধ্যেও অব্যাহত রয়েছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি প্রতিটি বাঙালীর কাছে আনন্দের, গৌরবের। মুজিব শতবর্ষ থেকে আরম্ভ করে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর প্রাপ্তি পালন বাঙালীকে গৌরবদীপ্ত করে, আনন্দিত করে। বর্তমানে দেশটি শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বগুণে দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। বর্তমানে উন্নয়নের মূল ভিত্তিভূমি রচনা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালীর আদর্শ এবং উন্নয়নের দিশারী ও বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ মহামানব, ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধাচরণকারী নেতা। তাঁর আদর্শ ও অবিচল নেতৃত্বে এদেশের মানুষের জন্য ব্রিটিশ-পাকিস্তান উভয় সময়কালে দাঁড়িয়ে সকল ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে বাঙালী সত্তার বিজয় ও স্বাধিকার অর্জন সম্ভব হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সে দেশকে সাড়ে তিন বছর শাসনামলে নানা ফ্রন্টে তিনি উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি করে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দিয়ে সুন্দর ও কৌশলগত বির্নিমাণে প্রয়াসী ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে আজ স্বাধীনভাবে আমরা বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পালন করছি এটি অত্যন্ত গৌরবের। ভারত সরকার বঙ্গবন্ধুকে গান্ধী শান্তি পুরস্কার ২০২০-এ ভূষিত করেছে, যা প্রশংসনীয়। দেশের সংবিধান প্রস্তাবনায় লেখা আছে, ‘জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে ঐতিহাসিক সংগ্রাম।’ মনে করি, মুজিবের তত্ত্বসমূহকে মুজিববাদ না বলে বরং মুজিবতত্ত্ব বলা উচিত। যত ঝড়-ঝাপটাই আসুক, সত্য উদ্ভাসিত হবে নতুনের বৈভবে। দুর্ভাগ্য এদেশের জন্য, সমগ্র জীবন উৎসর্গ করলেও কেবল তাঁকেই হিং¯্র দানবেরা পাশবিকভাবে হত্যা করেনি, তাঁর পরিবার-পরিজনকেও হত্যা করেছে।

বাঙালীর জন্য যে অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগ বঙ্গবন্ধু করেছিলেন তা বর্তমান প্রজন্মকে তার জীবনের প্রতি আকৃষ্ট করবে। প্রয়োজন হচ্ছে পঞ্চাশ বছর স্বাধীনতার পূর্তির সময়ে যারা অন্যায়কারী কিংবা বিভিন্ন সময় দেশে বা বিদেশে থেকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মিথ্যে প্রচারণা করেছে তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা। বিজয়ের এ মাহেন্দ্রক্ষণে বাঙালীকে তার আত্মগৌরব অনুধাবন করতে হলে আরও অধিকহারে মানুষকে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন ছিল। দুর্ভাগ্য যে, করোনার কারণে জনসমাবেশ সীমিত করা হয়েছে। মুজিববর্ষে গৃহহীনদের গৃহের উদ্যোগ নিয়ে শেখ হাসিনা প্রশংসিত হয়েছেন।

  ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ছিল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। কর্মসংস্থানের মাধ্যমেই কেবল সুচারুরূপে সাধারণ মানুষের মধ্যে বণ্টন ব্যবস্থা ঠিক করা যায় এবং মানুষের জীবনমান ও ক্রয়ক্ষমতার উন্নয়ন করা সম্ভব। পাকিস্তানীরা এদেশটিকে কেবল লুটের অংশই মনে করেছিল। বর্তমান সময়ে যেখানে অর্থনীতির আকার হচ্ছে প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সেখানে স্বাধীনতা পরবর্তীতে তিনি যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন ছিল মাত্র আট বিলিয়ন ডলার। একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রকে সাহসিকতার সঙ্গে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি। ভৌত কাঠামো বিনির্মাণ, অবকাঠামোর উন্নয়ন ছিল গৃহীত পদক্ষেপসমূহের অন্যতম। একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসেবে সব সময় তাঁর দৃষ্টি সমানভাবে দিতে সচেষ্ট ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামকালীন মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুকে তাদের মানসপটে ধারণ করে যুদ্ধ করেছেন, বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত হতেন এবং সুসংগঠিতভাবে এদেশে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক নীতিতে ভরপুর ছিলেন। মোশতাক-জিয়া-এরশাদ-খালেদা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ান। যখন কারোর গদি দুর্বল হয়ে পড়ে তখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ায়, যেটি মোশতাক-জিয়া-এরশাদ-খালেদা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রশ্নাতীতভাবে এদেশের জনগণই সব কিছুর মালিক নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু ওআইসি সম্মেলনে ২২ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে যোগদানের ফলে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর আগে ১৯৭৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য হয়। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিই আলজিরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে এদেশের সম্পর্ককে আরও গতিময়তা দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে যোগ দেন। বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৮ সেস্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্য রাষ্ট্র হয়। বঙ্গবন্ধু ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪ প্রথমবার বাংলায় জাতিসংঘে বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালীকে ভালবাসতেন। অকৃত্রিম ভালবাসা এবং জনকল্যাণ ও দেশপ্রেমের ধারায় সমুজ্জ্বল ছিলেন তিনি। দেশের ৯৯%-এর অধিক মানুষ তাঁকে পছন্দ করতেন এবং তাঁর চিন্তা-চেতনা ও কর্মপদ্ধতিকে ভালবাসতেন। বাঙালী জাতির তাঁর প্রতি ঋণের সীমা-পরিসীমা নেই। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিজয় অর্জন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল ডিসেম্বরে ৩ তারিখ ভারত তাতে সরাসরি যুক্ত হয়। এ যুদ্ধে ভারতের ৩৯০০ সৈনিক মারা যান এবং দশ হাজারের মতো আহত হন।

আমাদের দেশের কিছু বুদ্ধিজীবী আছে যারা নিজের চেয়ে অন্যের চরকায় তেল দিতে ব্যস্ত থাকে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর উলঙ্গ রাজা কবিতার মতো ঐ সমস্ত বুদ্ধিজীবীর অবস্থা। বেবী মওদুদ তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবার’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, টুঙ্গিপাড়া থেকে চলে আসার মুহূর্তে মাটি ঘাস পাতা প্রকৃতি, মধুমতি নদী, নদীর বাতাস বুক ছুঁয়ে থাকে- ভীষণ এক মমতায় জড়িয়ে রাখে, যেন স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, কোন এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতর।’ (পৃঃ ৭৮)। কতিপয় লোভী মানুষ, দুর্নীতিবাজ ও ষড়যন্ত্রকারী নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে বঙ্গবন্ধুর ভালবাসার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে সেদিন সাধারণ মানুষের মধ্যে নিকটজনকে হারানোর বেদনা অনুভূত হয়েছিল। তবে কতিপয় স্বার্থপর মোশতাকের মন্ত্রিসভায় নিজেদের আখের গোছাতে যুক্ত হয়েছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীসহ জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান গত ১৭ মার্চ, ২০২১ থেকে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে দশদিনব্যাপী পালিত হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদিসহ পাঁচটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ভার্চুয়ালি আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে বন্ধুপ্রতিম ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির টুইটটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সেটি বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়- মানবাধিকার ও স্বাধীনতার চ্যাম্পিয়ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা। তিনি সকল ভারতীয়ের জন্য নায়কও বটে। মুজিববর্ষ উদ্যাপনের জন্য এ মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশ সফর করা আমার জন্য সম্মানের ব্যাপার। যথারীতি বাংলাদেশের সম্মানিত মেহমান হিসেবে সফর করছেন তিনি। এ সফর আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সাহায্য করবে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে এবং জিরো আওয়ার্সে বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তাতে বলীয়ান হয়ে অত্যাচারিত বাঙালীরা পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড়ায়। আজ পাকিস্তানী শোষক, রক্ত পিশাচরা নেই। নবপ্রজন্মের অনেকেই পরাধীনতার শৃঙ্খলের কথা জানে না। বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ ও দূরদৃষ্টি না থাকলে দেশ স্বাধীন হতো না। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী যে মন্দা ছিল তা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সূত্রপাত হয়েছিল। ওপেকের তেলের দাম বাড়ানো, মার্কিন যুুক্তরাষ্ট্রে তেল রফতানি বন্ধ করার প্রয়াসে গ্যাসের দামের উর্ধমুখী, ভিয়েতনাম যুদ্ধের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী ব্যয় এবং ওয়াল স্ট্রীটের স্টক দুর্ঘটনা অন্যতম ছিল। এত কিছুর পরও বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেন। দেশের সাধারণ মানুষের উপযোগী ও সেবা প্রদানকারী বিভিন্ন সংস্থা তৈরির প্রয়াস নেন। জাতীয়করণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে সঠিক মাত্রা প্রদান করেন। এমনকি ব্যাংকের ঋণের সুদের ক্ষেত্রেও পল্লী ও শহরাঞ্চলের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সাধারণ জনমানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, অন্যের ভূসম্পত্তি দখল না করার নিশ্চয়তা, পরসম্পদ লুণ্ঠনকারীদের হাত থেকে বাঁচা, কোন ছোটখাটো প্রতিষ্ঠানে বসেই রাজা-বাদশা, না হওয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে তেঁতুলিয়া সর্বত্র যাতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে, সম্বলহীনরা সত্যিকার অর্থে বেঁচে থাকার মতো রসদ পান- সেসবের নিশ্চয়তা প্রদান। যে অকৃত্রিম সহযোগিতায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জীবন ও জীবিকার মধ্যে মেলবন্ধন ঘটাচ্ছেন তা যেন বজায় থাকে।

লেখক: ম্যাক্রো ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট ও আইটি এক্সপার্ট

pipulbd@gmail.com

আরকে//