হেফাযত প্রতিরোধে তারুণ্যের ভূমিকা
আলী আদনান
প্রকাশিত : ০৭:২০ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২১ বুধবার
সময়ের সেরা সাহসী সন্তানরাই ছাত্রলীগ করে। যে যতো অপবাদ দিক না কেন আমি ছাত্রলীগের ভালোটাই দেখি। ছাত্রলীগ করতে সাহস লাগে৷ ছাত্রলীগ করতে সততা লাগে। ছাত্রলীগ করতে হলে দেশপ্রেমিক ও গণমুখী চিন্তার অধিকারী হতে হয়। ছাত্রলীগ করতে হলে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা শিখতে হয়। ডানে, বামে যেসব ছাত্রসংগঠন আছে তাদেরকে আমার সুবিধাবাদী মনে হয়। সেদিক থেকে নেতৃত্ব তৈরীতে ছাত্রলীগ সেরা।
একটা বিষয় খুব দুঃখের সাথে খেয়াল করছি, সাম্প্রতিক সময়ে যারা ছাত্রলীগ করছে তারা অফলাইনে যতোটা সোচ্চার অনলাইনে ততোটাই নিষ্ক্রিয়। অনলাইনে বেশীরভাগ ছাত্রলীগ কর্মীদের ব্যস্ততা নিজ নিজ বলয়ের ভাইয়ের সাথে সেলফি দেওয়া, 'সহমত ভাই', 'এগিয়ে যান ভাই' 'পাশে আছি ভাই' এমন কমেন্ট করা। এদের অধিকাংশকে রাজনৈতিক আদর্শ সম্পর্কে সচেতন মনে হয় না।
ছাত্রলীগের বিভিন্ন নিউজ লিংকে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি প্রকাশ্যে আক্রমন চালায়। কিন্তু ছাত্রলীগের ছেলেরা নীরব। তারা কোন ধরনের রিপ্লাই দেয় না বললেই চলে। সাবেক ছাত্রনেতা বিশেষ করে যারা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের মতামত হলো, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যেহেতু সুসময় পার করছে সেহেতু অনেক সুবিধাবাদী নিজের লাভের আশায় ছদ্মবেশে ছাত্রলীগের ব্যানারে ঢুকে গেছে। ওরা সেলফি নিতে আগ্রহী হলেও দুঃসময়ে দলের পক্ষে দাঁড়াতে মোটেও আগ্রহী নয়।
ফেসবুকে বিভিন্ন ভাইয়ের সাথে সেলফি দিতে বা ভাই বন্দনা করতে যতো ছাত্রলীগ দেখি তাদের এক চতুর্থাংশ যদি দলীয় পোষ্ট, নিউজ লিংকে লাইক কমেন্ট করে তাহলে শিবির- হেফাজত কর্মীরা এমন কমেন্ট করার সুযোগ পায় না। কমেন্ট করলেও সেটা ধোপে টিকবে না। কিন্তু আমাদের ভাইদের নির্লিপ্ততা হতাশার জন্ম দেয়।
আপনি আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, শিবির হেফাজতের কমেন্টে পাল্টা রিপ্লাই দিতে হবে কেন? রিপ্লাই এজন্যই দিতে হবে বা নিজেদের পোষ্টে নিজেরা এজন্যই সমর্থন দিতে হবে- যাতে করে জনগণ বুঝে ছাত্রলীগের জনসমর্থন আছে।
ওরা সংঘবদ্ধ। ওদের বিরুদ্ধে আপনারা সংঘবদ্ধ না হলে পাবলিক সাপোর্ট আপনার পক্ষে থাকবে না। ওদের কোন পোষ্টে আপনি কমেন্ট করে দেখুন। বা ওদের বিরুদ্ধে পোষ্ট দিয়ে দেখুন। ওদের সমর্থকরা ঝাঁকে ঝাঁকে এসে আপনাকে আক্রমন করবে। কিন্তু আমরা? আমাদের পোষ্টে ওরা যখন খোঁচা দিয়ে যায় আমরা পাল্টা উত্তর দিই না। আমাদের কাউকে যখন ওরা নাজেহাল করে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমরা নীরব থাকি। দেখেও না দেখার ভান করি।
আরে ভাই, আপনি যুক্তি দিতে না পারেন ভালো কথা, যে যুক্তি দিচ্ছে তাকে অন্তত সমর্থন দিন। সেটাও কী আপনাদের ভয় লাগে? নাকি লজ্জা লাগে? এর প্রভাব কিন্তু সাধারণ মানুষের উপর পড়ছে। সময় এখনো আছে ঘুরে দাঁড়াবার।
একটি রাষ্ট্রকে যখন সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা থেকে ধীরে ধীরে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়, তখন সে জাতির উপর ভর করে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, ধর্মীয় উগ্রতা ও নৈরাজ্যবাদীতা। এদেশেও ঠিক তাই হয়েছে। আজকে হেফাযতের যে আগ্রাসন তা মূলত আমাদেরই ব্যর্থতা।
ধর্মের দোহাই দিয়ে একের পর এক দেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যে আঘাত হানার যে কৌশল চলছে তা বন্ধ করার জন্য তরুনদের সংগঠিত না হয়ে আর কোন উপায় নেই৷ সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার বিকাশ ঘটানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
যে রবীন্দ্রনাথ চর্চা করে সে কখনো মৌলবাদী হবে না। যে লালন বুঝে সে কখনো সাম্প্রদায়িক হয় না। যে বেগম রোকেয়া পড়েছে, হুমায়ুন আজাদ পড়েছে সে কখনো লৈঙ্গিক বৈষম্য প্রশ্রয় দিবে না। একসময় গ্রামে গ্রামে যাত্রাপালা হতো। জারি সারি গান হতো। কবিগানের প্রচলন হারিয়ে গেছে। এসবের চর্চার বিকল্প নেই।
সব মায়ের দায়িত্ব ছোট বেলায় সন্তানের হাতে বইয়ের পাশাপাশি হারমোনিয়াম তবলার নূন্যতম চর্চা করানো। ছবি আঁকতে উৎসাহী করা। পাড়ায় পাড়ায় নাটক মঞ্চস্থ করার যে ঐতিহ্য আমাদের ছিল তার জাগরন আবার ঘটানো উচিত। গ্রাম বাংলার মানুষ এখন নৌকা বাইচ ভুলে গেছে। এর চর্চা করানো উচিত। এসব চর্চা অব্যাহত থাকলে মোল্লারা তাদের অবস্থান শক্ত করার সুযোগ পাবে না।
গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন দিবস ও ঋতুভিত্তিক উৎসবগুলো পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিত। বৈশাখী মেলা, বর্ষা উৎসব, শরৎ উৎসব, নবান্ন উৎসব, পৌষ পার্বন, পিঠা উৎসব, বারোমাসী ফল উৎসব, বসন্ত উৎসব, স্বাধীনতা মেলা, বিজয় মেলা, প্রভাত ফেরী, বই মেলা, কবিতা উৎসব- এসবের চর্চা যতো বেশী ঘটানো যায় ততোই ভাল। তরুনরা এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকলে শুধু মৌলবাদীতা বা সাম্প্রদায়িকতা রোধ পাবে তাই নয় বরং নানা ধরনের কিশোর অপরাধ, সন্ত্রাশ, ধর্ষন এসব বন্ধ হবে।
গতদশকেও সাহিত্য পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের বেশ চর্চা ছিল৷ কিন্তু ভার্চুয়াল জগতের দাপটে এখন সেই চর্চা হ্রাস পাচ্ছে দ্রুতগতিতে৷ এই চর্চা চিন্তার পথ বিকশিত করে। প্রশ্ন করার পাশাপাশি সমালোচনায় দক্ষ করে তোলে। বিনা যুক্তিতে কোন কিছু মেনে নেওয়ার যে প্রবনতা তা বন্ধ হবে। যুক্তি তর্কের ধাক্কা ধাক্কিতে অন্ধত্ব ও কুসংস্কার নির্মূল হবে। ফলে ধর্মকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে ফায়দা লোটা বন্ধ হবে।
মানুষের জীবনে বিনোদন নেই। মানুষের জীবনে আনন্দ নেই। নানা ধরনের হতাশা ও অস্থিরতায় চেপে বসছে মানুষের কাঁধে। মানুষ সামান্য স্বস্তির জন্য ছুটছে মিথ্যা, বানোয়াট কল্পকাহিনীতে ভরপুর ওয়াজ মাহফিলে। মানুষকে আমরা কীভাবে দোষ দিব? আমরা তো বিকল্প কিছু দিতে পারছি না। ষাট সত্তর আশির দশকে গ্রামে গ্রামে প্রচুর ক্লাব ছিল। নব্বইয়ের দশকেও প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফুটবল টুর্নামেন্টের প্রচলন ছিল। বিভিন্ন সংগঠন বার্ষিক ক্রীড়াপ্রতিযোগিতার আয়োজন করত। এখন সেসব নেই বললেই চলে। শ্রান্ত, ক্লান্ত মানুষ দিন শেষে আশ্রয় নেয় তারেক মনোয়ার, আমীর হামজা, রফিকুল্লাহ আফসারী, কুয়াকাটা, চরমোনাই, তাহেরী, এনায়েতউল্লাহ আব্বাসী, আলাউদ্দিন জেহাদীদের প্যান্ডেলের নিচে। যেখানে সারাবিশ্বের তরুনরা গবেষনায়, উদ্ভাবনে, প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে আমাদের তরুনরা হুজুরের প্রতিটা কথায় চিৎকার করে 'ঠিক' বলা অভ্যাস করছে। অন্যান্য দেশের মানুষ যখন মঙ্গলে বাড়ী বানানোর পরিকল্পনা করছে, আমরা তখন চাঁদে মানুষের মাথা দেখি!
এদেশের মানুষ অতীতেও মৌলবাদীতাকে প্রশ্রয় দেয়নি। ভবিষ্যতেও দিবে না৷ কিন্তু সে ক্ষেত্রটা আমাদেরকেই প্রস্তুত করতে হবে। প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন হিসেবে এক্ষেত্রে তৃণমূল ছাত্রলীগের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রগতিশীল তরুণদের হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধের আকাংখিত যে বাংলাদেশ তা প্রতিষ্ঠা পাবে শীঘ্রই।
(লেখকঃ আলী আদনান, লেখক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট।)
আরকে//