উন্নত হোক উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা
ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী
প্রকাশিত : ১০:০২ পিএম, ২ এপ্রিল ২০২১ শুক্রবার
গত বারো বছরে দেশে শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটলেও গুণগতমানসম্পন্ন শিক্ষা প্রসারের জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী বারবার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি উচ্চশিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি গবেষণামূলক কর্মকাণ্ডের ওপর জোর দিয়েছেন। ইউজিসি ছাড়াও বাংলাদেশ এ্যাক্রেডেন্সিয়াল কাউন্সিলও গঠন করা হয়েছে। করোনার মধ্যেও অনলাইনে পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু করোনাপূর্ব থেকে শিক্ষার মান উন্নয়নে অদ্যাবধি তেমন ফলপ্রসূ ঘটনা চোখে পড়ছে না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও কিছু কিছু জায়গায় শিক্ষা যেন এক অন্ধকার বৃত্তে আটকে আছে। শিক্ষার মান উন্নত করা এবং শিল্পের সঙ্গে শিক্ষার মৌলিকভাবে যুক্তকরণ আবশ্যক হয়ে পড়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ উল্লেখ করা আছে- গবেষণার কাজে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে একযোগে অংশগ্রহণ করতে হবে।
‘বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে মৌলিক গবেষণার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে’ (পৃঃ ২৩)। অথচ ইদানীং বিভিন্ন উল্টাপাল্টা অভিযোগ শোনা যায়। সেটি বড় কথা নয়। বরং প্রতিকারই বড় কথা। প্রথমত, ভারতের মতো এদেশে ইউজিসিও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত জার্নালসমূহকে অবশ্যই ইনডেক্সিং করার উদ্যোগ নিতে পারে। এ ব্যাপারে প্রয়োজন ইউজিসির জনবল পদায়ন করা, যাতে ইনডেক্সিংয়ের কাজ করা যায় তার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা অবশ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয় করতে পারে। আবার জাতীয় শিক্ষানীতিতে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে- ‘উচ্চশিক্ষা বাংলায় সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে ইংরেজীসহ অন্যান্য ভাষায় রচিত আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যবহারযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা বাংলা ভাষায় অনূদিত হওয়া প্রয়োজন।’ এ কাজটিতে ইউজিসির পাশাপাশি বাংলা একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলা একাডেমি পাঠ্যপুস্তক এবং অনুবাদকর্ম প্রকাশ করার পাশাপাশি ইতোপূর্বে যে সমস্ত পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেছে তার মুদ্রণ শেষ হয়ে গেলে আবার নতুন করে মুদ্রণের ব্যবস্থা করা উচিত। যারা পুরনো বই লেখকের নাম বদলিয়ে প্রকাশ করে থাকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। অথচ প্রকাশিত জার্নালগুলোতে বিদেশের মতো এদেশেও প্লেগারিজম (Plagarism) তথা চৌর্যবৃত্তি চলছে সেক্ষেত্রে সফটওয়্যার দ্বারা চেক করে জার্নালে প্রবন্ধসমূহ প্রকাশের ব্যবস্থা করা দরকার। স্বল্প কিছু জার্নালে প্লেগারিজম চেকের ব্যবস্থা থাকলেও সব জার্নালে বিদেশের নামী-দামী জার্নালসমূহের মানসম্মত ইনডেক্সিং করে সেগুলোকে অবশ্যই চেক করা দরকার। একই কথা যে কোন ধরনের গবেষণা বিশেষত, যখন কোন ডিগ্রী দেয়া হবে সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন। যেমন-মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডির ক্ষেত্রেও প্লেগারিজম সফটওয়্যার দ্বারা চেক করলে কেউ যদি নকল করে থাকেন, তবে তৎক্ষণাৎ বোঝা যাবে। যেহেতু গত বারো বছরে ডিজিটালাইজেশনে দেশ এগিয়ে গেছে, সেহেতু শিক্ষা ক্ষেত্রে ভাল দিকসমূহকেও আমরা দোষারোপ না করে নকলমুক্ত গবেষণা কর্ম করার জন্য, মৌলিক কর্মকা- অব্যাহত রাখার স্বার্থে, প্লেগারিজম চেক করার জন্য সফটওয়্যারের মধ্যে যেগুলো মানসম্মত সেগুলো যেমন, ট্রিনিটি সফটওয়্যার বাধ্যতামূলকভাবে কিভাবে ব্যবহার করা যায়, সেটি বিশদভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
এদিকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত মৌলিক কর্মকা-ের ক্ষেত্রে ধ২র (এ টু আই) বাংলার জন্য একটি প্লেগারিজম সফটওয়্যার তৈরি করে তা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়। বিদেশের যে সমস্ত স্কুপাস ইনডেক্স জার্নালের এডিটরিয়াল বোর্ডে আছি, দেখেছি যে তারা প্লেগারিজম চেক না করে দু’জন রেফারির কাছে লেখা পাঠায় না। ব্যাপকভাবে আমাদের মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডি থিসিসের ক্ষেত্রেও প্লেগারিজম সফটওয়্যারের ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই। দেশে আর্থিক টানাটানির মধ্যেও প্রচুর ভাল কাজ হয়, কিন্তু সে অনুপাতে ডাটা ব্যাংক নেই। ধরুন কেউ চাইল নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিযোগ ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে। কিন্তু তার জন্য পর্যাপ্ত তত্ত্ব-উপাত্ত আমাদের দেশে এক স্থানে পাওয়া যাবে। খ- খ- করে তত্ত্ব জোগাড় করতে হয়। আবার বিদেশে মানসম্মত অনেক লেখা প্রকাশ করতে হলে মোটা অর্থের প্রয়োজন হয়। তবে বিদেশেও দু’নম্বর/তিন নম্বর জার্নাল আছে। প্রিডেটরি জার্নালে লেখা প্রকাশ থেকে আমাদের গবেষকদের অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। শিক্ষকের মান, মর্যাদা ও আদর্শ নিজেদেরই সমুন্নত রাখতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কলেজে সহকারী অধ্যাপকের বদলে জ্যোষ্ঠ প্রভাষক পদ থাকবে। থাইল্যান্ডে যেমন থাই সাইটেশ্ন ইনডেক্স জার্নাল আছে- অতি সহজেই বোঝা যায় জার্নালটি ভাল কি মন্দ। স্কুপাস ইনডেক্সিং ছাড়াও এব ডিসিতে প্রকাশিত লেখাও কোন কোন উন্নত বিশ্বে বেশ নাম করে থাকে। এক্ষণে কেবল অর্থায়ন নয়, বরং যে বিষয়ে গবেষণা করা হয়েছে গবেষণাটি যাতে ভাল জার্নালে প্রকাশিত হয়, সে জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, বিভিন্ন ভাল উদ্যোগ বাস্তবায়নকারীদের জন্য শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে না- বরং উল্টো মুখে যাত্রা শুরু হয়। যারা ঠিকমতো ওপরের নির্দেশ বাস্তবায়ন করবেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়েছে। আসলে দেশকে ভালবেসে স্ব স্ব অবস্থানে থেকে কাজ করা উচিত।
সম্প্রতি ইউজিসি শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু পরিবর্তন আনতে চাচ্ছে। এই পরিবর্তনটি অতি প্রয়োজনীয়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েটের ফল বিবেচ্য নয়। ইউজিসি তার যে প্রস্তাবনা দিয়েছে তাতে ম্যাট্রিক এবং ইন্টারমিডিয়েটে যুক্তভাবে ৭ পয়েন্ট ৫ স্কেলে এবং প্রথম শ্রেণী থাকতে হবে অনার্স ও মাস্টার্সে কিংবা ৩.৫০ করে ৪ স্কেলে অনার্স ও মাস্টার্সে থাকতে হবে। প্রভাষক নিয়োগে নতুন পদ্ধতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক পাস করার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রীধারীরা ভাল করলে তা দেশে ভাল শিক্ষক তৈরিতে সহায়তা করবে- যা প্রকারান্তরে মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করবে। আবার উন্নতমানের গবেষণাগুলো স্ব-স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে দিতে হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার দেশে গুণগতমান সম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। তবে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে গবেষণা এবং দেশের জন্য সুনাম ও সুকৃতি বয়ে আনাকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা দরকার। মৌলিক গবেষণামূলক কর্মকা- অবশ্যই শিক্ষক নিয়োগের একটি বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। আবার কোন কোন বিষয় আছে যেগুলোতে সরাসরি শিল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। কত বছর এবং কোন ধরনের প্রতিষ্ঠানে কি ধরনের কাজ করেছে সেটি বিবেচ্য হওয়া উচিত। তারপরও আশা করি ইউজিসি শিক্ষক নিয়োগের যে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, তা যত দ্রুত বাস্তবায়ন করবে তত দেশের জন্য ভাল হবে। নচেত আমরা কেবল জিপিএ পাওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকা পাব। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তাদের কেউ কেউ ইতোপূর্বেকার আইনের জন্য ভাল শিক্ষক হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে পারেননি। শিক্ষকতায় যে নৈতিকতার প্রয়োজন সে বিষয়টি নিয়েও অবশ্যই কাজ করা দরকার।
সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে রোল মডেল হবে শিক্ষক-শিক্ষিকা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, কেউ কেউ রোল মডেল হতে ব্যর্থ হচ্ছেন। বরং অতিরিক্ত মাত্রায় স্যোশাল মিডিয়ায় এডিকটেড হচ্ছেন। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে পেরেন্টিং-এর প্রভাব থাকা দরকার, যাতে তাদের স্নেহ দ্বারা ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হতে পারে। যখন কাউকে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ দেয়া হয় তখন তার প্রেজেন্টেশন স্কিল দেখা উচিত। মেধাবী হলেই যে প্রেজেন্টেশন স্কিল ভাল হবে তার কোন সঠিক যুক্তি নেই। শিক্ষক-শিক্ষিকা যারা কষ্ট করে ফান্ড ছাড়া গবেষণা করেন, তারা জানেন যে, নানামুখী বাধার মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়। যতক্ষণ না দেশে ইউজিসি জার্নাল ইনডেক্সিং করবে ততক্ষণ এদেশের জার্নালের মান বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন’ এদেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মান যাতে একটি মর্যাদাপূর্ণ আসনে স্থিত হয় তার ব্যবস্থা করবে। ইউজিসি চেষ্টা করছে উচ্চ শিক্ষায় গবেষণা এবং শিক্ষার মান বৃদ্ধি কল্পে। কিন্তু দেশে ধীরে ধীরে মানিসেন্ট্রিক সোসাইটিতে উচ্চশিক্ষার জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন তা ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন থেকে আসছে না। তারপরও সরকার সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যে উচ্চশিক্ষা প্রদানে সচেষ্ট রয়েছে। গবেষণায় হয়ত অনেকেই নিজের নেশা-পেশা হিসেবে কাজ করে থাকেন। তবে নিরন্তর গবেষণা এবং গুণগত মানসম্পন্ন ছাত্র-ছাত্রী তৈরি করতে হলে অবশ্যই প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। বিদেশে যে ধরনের লোকবল প্রয়োজন, সে অনুপাতে তৈরি করতে হবে।
লেখক : ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট ও আইটি এক্সপার্ট
Pipulbd@gmil.com
আরকে//